উল্লেখিত দুদিনে আলোচনা অধিকাংশ সময় আমাদের দুজনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে–মোট প্রায় সাত-আট ঘণ্টা ধরে। দেশের সর্বশেষ আভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি, প্রবাসী সরকার এবং রাজনৈতিক দলসমূহের দ্বন্দ্ব সমন্বয় প্রচেষ্টা, বিদ্রোহী সেনাদের অস্ত্র, মনোবল ও প্রস্তুতির সমস্যা, মুক্তিসংগ্রামের প্রশ্নে ভারতীয় রাজনৈতিক দলসমূহের ভূমিকা ও মনোভাব, ভারত সরকার প্রদত্ত বিভিন্ন সাহায্য ও সাহায্যের প্রতিশ্রুতি, পাকিস্তানের সম্ভাব্য বিকল্প পদক্ষেপ, অমীমাংসিত পাক-ভারত যুদ্ধের আশঙ্কা–এই সমুদয় বিষয় নিয়েই কমবেশী আলোচনা হয়। আলোচনার এক পর্যায়ে, ভারত সরকার বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামকে কতদূর অবধি সাহায্য করতে সম হবে, এ প্রশ্ন আমি তুলি। এর কোন প্রত্যক্ষ জবাব না দিয়ে তাজউদ্দিন কেবল জানান, মুক্তিযুদ্ধকে সাহায্য করার ক্ষেত্রে ইন্দিরা গান্ধীর ব্যক্তিগত সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা সম্পর্কে তার কোন সন্দেহ নেই।
কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই ভারতের সমক্ষতা সম্পর্কে উত্থাপিত প্রশ্নকে আরও বেশী নৈর্ব্যক্তিক ও বস্তুনিষ্ঠভাবে বিশ্লেষণ করে দেখার প্রয়াস চলে। আমার বিবেচনায় ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সাহায্যের প্রতিশ্রুতি যদি আক্ষরিক অর্থে পালিত হয়, তবে তার ফলে একদিকে যেমন মুক্তিযুদ্ধের তীব্রতা বৃদ্ধি পাওয়া সম্ভব, তেমনি অন্যদিকে তার পাল্টা ব্যবস্থা হিসাবে পাকিস্তানের পক্ষেও সংঘর্ষকে তার নিজের সীমান্তের বাইরের সম্প্রসারিত করা স্বাভাবিক। এবং সম্ভবত এক্ষেত্রে পাকিস্তানের পক্ষে চীনের প্রত্যক্ষ সামরিক সহযোগিতা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক সমর্থন ও সামরিক সাহায্য লাভ করা খুবই স্বাভাবিক। পক্ষান্তরে, সামরিক দিক থেকে ভারত মূলত নিঃসঙ্গ এবং সেই কারণে তুলনামূলকভাবে দুর্বল। চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য সহযোগিতার উপর ভিত্তি করে পাকিস্তান যদি তার গৃহযুদ্ধকে পাক-ভারত যুদ্ধে পরিণত করতে চায়, তবে সেই ঝুঁকি মাথায় করে একাকী ভারতের পক্ষে মুক্তিযুদ্ধকে সাহায্য করা বেশীদূর কি সম্ভব হবে?
বিষয়টি আর গভীরভাবে বিবেচনা করে দেখার প্রয়োজনীয়তা স্বীকৃত হয় দুটি মূল প্রতিপাদ্য থেকে। প্রথমত, আঞ্চলিক শক্তির ভারসাম্যে নিজস্ব দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার জন্য ভারতের পক্ষে অবশিষ্ট বিকল্প শক্তি তথা সোভিয়েট ইউনিয়নের সঙ্গে কোন নির্দিষ্ট সমঝোতায় পৌঁছানো সম্ভব কিনা। চীনের উত্তর সীমান্তে উসুরী নদী বরাবর এবং সিনকিয়াং প্রদেশের পশ্চিমে মোতায়েন সোভিয়েট ইউনিয়নের অন্ন চল্লিশ ডিভিশন সৈন্য চীনের ভারতবিরোধী সামরিক প্রবণতার সম্ভাব্য প্রতিবন্ধক হতে পারে বলে আমরা মনে করি। কিন্তু বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রামকে সাহায্য করার উদ্ভূত ঝুঁকি প্রতিবিধানের জন্য সোভিয়েট ইউনিয়নের তদ্রপ সমঝোতা ও সহযোগিতার আশ্বাস ভারতের পক্ষে সংগ্রহ করা সম্ভব কিনা, তা আমাদের অজানা ছিল। দ্বিতীয়ত, আমাদের আরও জানা প্রয়োজন ছিল, বহু শ্রেণীর স্বার্থ ও মতের টানাপোড়েনে গঠিত ভারতের জাতীয় সরকার এবং বিশেষত এর দক্ষিণপন্থী অংশ ভারতের? বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এমন মৌলিক রূপান্তর আদৌ কার্যকর হতে দেবে কিনা। এই দুই প্রশ্নের যথার্থ উত্তরের উপর ভিত্তি করে ভারতের সমতা সম্পর্কে মোটামুটি সঠিক সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব বলে আমরা মনে করি। ভারতের উত্তর সীমান্তের নিরাপত্তা সুদৃঢ় করে তার সামরিক ঝুঁকি গ্রহণের ক্ষমতা না বাড়ানো অবধি মুক্তিবাহিনীর ব্যাপক সংখ্যা বৃদ্ধি, তথা প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রায়িতকরণ, সীমান্তযুদ্ধ পরিচালন, ভারতের সীমান্তে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি স্থাপন ও সংরক্ষণ ইত্যাদি সকল ব্যাপারে অগ্রগতির সম্ভাবনা সীমিত বলে আমাদের আশঙ্কা জন্মায়। ভারতের ক্ষমতাসীন মহলে বেসরকারী আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে উপরোক্ত বিষয় দুটি সম্পর্কে যথার্থ ধারণা গঠনের উদ্দেশ্যে তাজউদ্দিন আমাকে দিল্লী যেতে এবং আমার ঢাকা প্রত্যাবর্তনের কর্মসূচী পরিত্যাগ করে পলিসি পরিকল্পনায় তাকে সাহায্য করতে অনুরোধ করেন।
তারপর আরো এক সপ্তাহ ধরে কোলকাতায় বিষয়টির সংশ্লিষ্ট অপরাপর দিক নিয়ে তাজউদ্দিনের সাথে আরও তিন/চার-দফা আলোচনা হয়। ফলে আমাদের প্রেক্ষিতবোধ আরও কিছুটা প্রসারিত হয়। ভারতের নিরাপত্তা বৃদ্ধির জন্য সোভিয়েট সহযোগিতা লাভের উদ্যোগ মূলত ভারতেরই নিজস্ব ব্যাপার। তবু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধই যেহেতু ভারতের এই নতুন নিরাপত্তাহীনতাবোধের মূলে, সেহেতু বাংলাদেশের পক্ষ থেকেও এই মুক্তিযুদ্ধকে একটা বিবেচনাযোগ্য বিষয় হিসাবে সোভিয়েট ইউনিয়নের কাছে উপস্থিত করার প্রয়োজন আমরা অনুভব করি। এর কিছু আগে সোভিয়েট সমর্থন লাভের জন্য আবদুস সামাদ আজাদ বুডাপেস্টে শান্তি সম্মেলনে যোগদান শেষে মস্কোতে প্রেরিত হন। বুড়াপেস্ট শান্তি সম্মেলনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের স্বপক্ষে সমাজতন্ত্রী দেশগুলির উৎসাহব্যঞ্জক সাড়া পাওয়া যায়। কিন্তু মস্কোতে ঐকান্তিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও তিনি সোভিয়েট সরকার বা পার্টির কারো সঙ্গে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠায় অসমর্থ হন।৪৯ পাকিস্তানী হত্যাযজ্ঞের কঠোর সমালোচনা করে রক্তপাত বন্ধের জন্য ইয়াহিয়ার প্রতি সোভিয়েট প্রেসিডেন্ট পোদগর্নি জোরাল আবেদন জানালেও বাংলাদেশের স্বাধীনতা তখনও সোভিয়েট ইউনিয়নের নিকট কোন বিবেচনাযোগ্য রাজনৈতিক ইস্যু নয়। বস্তুত ১৯৭১ সালের মার্চে ভারতে ইন্দিরা গান্ধী এবং তার কিছু পূর্বে শ্রীলঙ্কায় শ্রীমাভো বন্দরনায়েক ও পাকিস্তানে শেখ মুজিব বিপুল ভোটাধিক্যে জয়যুক্ত হওয়ায় সমগ্র উপমহাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সোভিয়েট ইউনিয়নের সন্তুষ্ট বোধ করার কারণ ছিল। এই অবস্থায় রক্তাক্ত অভিযান থেকে ইয়াহিয়াকে নিবৃত্ত করে পাকিস্তানে শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠাই যদি পোদগর্নির ২রা এপ্রিলের বিবৃতির প্রধান লক্ষ্য হয়ে থাকে, তবে তাকে অযৌক্তিক মনে করার কারণ নেই।