কিন্তু সকলের অজ্ঞাতে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন চীনের সঙ্গে সেতুবন্ধ রচনার কাজে জেনারেল ইয়াহিয়াকে গুরুত্বপূর্ণ সোপান হিসাবে ব্যবহার করায়, অন্য সকল কারণ বাদেও ইয়াহিয়ার বিরুদ্ধে কোন গুরুতর মার্কিনী চাপ প্রয়োগের সম্ভাবনা ছিল না। ইয়াহিয়ার পক্ষেও শেখ মুজিব তথা আওয়ামী লীগের সাথে পুনরায় আলাপ করার পথ ছিল বন্ধ। ২৬শে মার্চ শেখ মুজিবকে “রাষ্ট্রদ্রোহী’ এবং আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণার মাধ্যমে ইয়াহিয়ার নিজের হাতেই এই পথ বন্ধ হয়। ফলে মে মাসে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নিজেদের সামরিক ও প্রশাসনিক কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠার পরেও পাকিস্তানী শাসকেরা সম্ভাব্য রাজনৈতিক সুযোগ সদ্ব্যবহারে ব্যর্থ হয়। মার্চ-এপ্রিলে লক্ষ মানুষের প্রাণ সংহারের পর এইরূপ রাজনৈতিক মীমাংসার অবকাশ কতটুকু ছিল তা অবশ্য স্বতন্ত্র কথা। মীমাংসার সুযোগ যত সামান্যই থাকুক, রাজনৈতিক উদ্যোগের সম্যক অভাবে পাকিস্তানের সামরিক অভিযান অব্যাহত থাকে, কতকটা উদ্দেশ্যহীনভাবেই।
এদিকে বাংলাদেশ প্রশ্নে মে-জুন মাসে ভারতের নাজুক ভূমিকা বাংলাদেশ মন্ত্রিসভা এবং আওয়ামী লীগের নেতৃমহলে বেশ কিছু বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে। এপ্রিলে ও মে মাসের শুরুতে বাংলাদেশ মন্ত্রিসভার বিভিন্ন সদস্য পৃথক পৃথকভাবে ইন্দিরা গান্ধীর সাথে সাক্ষাৎ লাভের ব্যগ্রতা প্রকাশ করেন। এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য সম্ভবত দিল্লীর অজ্ঞাত ছিল না। মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী এবং প্রধান সেনাপতি কর্নেল ওসমানীসহ সমগ্র মন্ত্রিসভা দিল্লীতে আমন্ত্রিত হন এবং ইন্দিরা গান্ধী সবার সঙ্গে একত্রে মিলিত হন। সেখানে বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা স্বভাবতই ভারতীয় নীতির অস্পষ্টতা সম্পর্কে নানা প্রশ্ন তোলেন এবং বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতিদানে বিলম্ব করায় তাদের ক্ষোভ ব্যক্ত করেন। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে পি. এন. হাকসার ভারতের অসুবিধার কথা ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে এক পর্যায়ে আমন্ত্রিতদের কাছে। জানতে চান, এই স্বীকৃতি না দেওয়ায় বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে ভারতের ভূখণ্ড থেকে অবাধে কাজ করার তথা মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করার ক্ষেত্রে কোন বাস্তব অন্তরায় সৃষ্টি হয়েছে কিনা। পরে সম্ভবত ধৈর্যের মাত্রা আরও হ্রাস পেলে হাকসার বলেন, ভারতের স্বীকৃতি লাভের জন্য তাদের পীড়াপীড়ির অন্তরির্নহিত আকাক্ষা যদি এই হয় যে ভারতের সেনাবাহিনীকে অবিলম্বে ঢাকার উদ্দেশে রওয়ানা হতে হবে, তবে তা স্পষ্ট করেই ব্যক্ত হওয়া বিধেয়। এই সব কথাবার্তা অধিকাংশ আমন্ত্রিতদের কেবল নৈরাশ্য ও ক্ষোভ বৃদ্ধিতেই সহায়ক হয়।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সাহায্য করার পক্ষে ইন্দিরা গান্ধী যদিও তার প্রতিশ্রুতি পুনর্বার জ্ঞাপন করেন, তবুও বৈঠকে আমন্ত্রিত অধিকাংশ সদস্য এই ধারণা নিয়ে ফিরে আসেন যে ভারত বাংলাদেশ সরকারকে শীঘ্র স্বীকৃতি দানে অনিচ্ছুক, ভবিষ্যতে কবে এই স্বীকৃতি দেওয়া হবে তাও অনিশ্চিত। কিন্তু ভারত কেন অনিচ্ছুক, তা উপলব্ধির প্রচেষ্টা তাদের কতদূর ছিল বলা শক্ত। একদিকে মন্ত্রিসভার একাংশের এই সন্দেহ এবং অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রশস্ত্র প্রদানে বিলম্ব ও গড়িমসির ফলে ক্রমেই এই ধারণা বিস্তার লাভ করতে শুরু করে যে, ভারত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সাহায্য করার ব্যাপারে অনিচ্ছুক, ভারতের ভূমিকা ও উদ্দেশ্য উভয়ই সন্দেহজনক; সম্ভবত ভাগ্যাহত দালাইলামা ও তিব্বতী শরণার্থীদের পরিণতিই তাদের জন্য অপেক্ষা করছে। তাজউদ্দিন স্বীকৃতির ব্যাপারে ভারতের এই বিলম্বকে অযৌক্তিক বোধ করেননি। ভারতে আশ্রয় গ্রহণের পর কয়েক সপ্তাহ ধরে ভারত সরকারের সঙ্গে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক পর্যায়ে তার যে সব যোগাযোগ ও আদানপ্রদান ঘটে, তা থেকে পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানী আধিপত্য বিলুপ্তির ব্যাপারে বাংলাদেশ ও ভারতের এক ধরনের স্বার্থের পারস্পরিকতা তিনি লক্ষ্য করেন। একদিকে বাংলাদেশ নেতৃত্বের পক্ষে দেশের স্বাধীনতা বাস্তবায়নের জন্য পাকিস্তানের নগ্ন সামরিক দখলকে বিলোপ করা যেমন অপরিহার্য ছিল, তেমনি অন্যদিকে ভারতের নেতৃত্বের অন্তত একাংশের কাম্য ছিল তাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীর ভূসামরিক ক্ষমতা খর্বিত করে পূর্বাঞ্চলের নিরাপত্তা সুদৃঢ় করা। এই পারস্পরিক স্বার্থ পূর্ণমাত্রায় প্রতিফলিত হয় শরণার্থীদের ক্রমবর্ধমান ভিড়ে–একদিকে যেমন ছিল বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যক মানুষের পূর্ণ নিরাপত্তাসহ দেশে ফেরার ঐকান্তিকতা, অন্যদিকে তেমনি ছিল শরণার্থীদের যথাশীঘ্র ফেরৎ পাঠিয়ে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক চাপ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য ভারতের ব্যগ্রতা। স্বার্থের এই পারস্পরিকতার দরুন বাংলাদেশের মুক্তি সম্পর্কে উভয় তরফের আগ্রহ বা ইচ্ছা নিয়ে কোন প্রশ্ন ছিল না। প্রশ্ন ছিল কেবল বাস্তব সামর্থ্যের ব্যাপারে এবং তা ছিল উভয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করার ব্যাপারে আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভার বাস্তব সামর্থ্য সম্পর্কে ভারতের যেমন প্রভূত সংশয় সৃষ্টি হয়েছিল, তেমনি আঞ্চলিক সামরিক ভারসাম্যের পটভূমিতে যুদ্ধের ঝুঁকি নিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামকে পূর্ণমাত্রায় সাহায্য করার ব্যাপারে ভারতের সামর্থ্য রয়েছে কিনা সে সম্পর্কে গুরুতর প্রশ্ন ছিল বাংলাদেশ মহলেও।
অধ্যায় ০৬: মে – জুন
আঞ্চলিক সামরিক ভারসাম্যের ক্ষেত্রে ভারতের তুলনামূলক দুর্বলতা ও একাকিত্ব এবং বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের ক্ষেত্রে এর সঠিক তাৎপর্য অন্বেষণই ১২ই ও ১৩ই মে কোলকাতায় প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন ও আমার মধ্যকার প্রথম বৈঠকের প্রধান আলোচ্য বিষয়ে পরিণত হয়। এপ্রিল মাসে ঢাকায় কিছু রাজনীতি সচেতন ব্যক্তির সহযোগে এক গোপন প্রতিরোধ সংগঠন গড়ে তোলার এক পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধের নীতি ও কৌশল সম্পর্কে প্রবাসী সরকারের সঙ্গে মতবিনিময়ের প্রয়োজন অনুভূত হয় এবং তদনুসারে ‘মুজিবনগরের উদ্দেশে স্বল্পকালের জন্য আমি ঢাকা ত্যাগ। করি। ঢাকা টেলিভিশনের তদানীন্তন মহা-ব্যবস্থাপক জামিল চৌধুরী আমার সহযাত্রী ছিলেন। ৫ই মে আগরতলা অঞ্চলে সীমান্ত অতিক্রম করার পর সপ্তাহকালের মধ্যে কোলকাতায় প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের সাথে আমার সাক্ষাতের ব্যবস্থা হয়। তাজউদ্দিন তার আগের দিন দিল্লী থেকে তাঁর দ্বিতীয় সফর শেষ করে ফিরেছেন। প্রায় সাত সপ্তাহের ব্যবধানে তার সাথে আমার দেখা–প্রবাসে এবং সম্পূর্ণ পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে। কয়েকদিন ধরে কোলকাতায় বাংলাদেশের রাজনৈতিক মহলে মুক্তিযুদ্ধের ভবিষ্যত সম্পর্কে কিছু অনিশ্চয়তাবোধ ও হতাশার ভাব লক্ষ্য করার পর তাজউদ্দিনকে আমি দেখতে পাই স্বাধীনতাযুদ্ধের সাফল্য সম্পর্কে অবিচল আস্থাশীল।