প্রশাসন বিভাগের পাশাপাশি দলীয় প্রভাবমুক্ত প্রতিষ্ঠান হিসাবে গড়ে ওঠে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের পাঁচটি ক্ষয়িত ব্যাটালিয়ানের সঙ্গে ইপিআর বাহিনীর লোকজনদের একত্রিত করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী (জুলাই থেকে ‘নিয়মিত বাহিনী’ নামে পরিচিত) প্রতিষ্ঠা করা হয়। তার প্রধান সেনাপতি কর্নেল (অবঃ) ওসমানী ছিলেন সামরিক ব্যাপারে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের বিরোধী। যদিও মুক্তিযুদ্ধ মূলতই রাজনৈতিক যুদ্ধ, তবুও ওসমানী রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ও হস্তক্ষেপ ব্যতিরেকেই সেনাবাহিনী সংগঠন ও পরিচালনার পূর্ণ সুযোগ পান। প্রধানমন্ত্রী ও দেশরক্ষা মন্ত্রী হিসাবে তাজউদ্দিনের দৃঢ় সমর্থন ব্যতিরেকে বিভিন্ন সেক্টর কমান্ডার এবং রাজনৈতিক মহল উভয় দিকের বিরোধিতার ফলে ওসমানী সম্ভবত অসমর্থ হয়ে পড়তেন। নিয়মিত বাহিনী ছাড়া দেশের অভ্যন্তরে অনিয়মিত লড়াই চালাবার জন্য যে মুক্তিবাহিনী গঠনের প্রস্তুতি চলছিল তার নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনার বিষয়টি অবশ্য তখনও বেশ অনির্দিষ্ট রয়ে যায়।
বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসনিক ও সামরিক কাঠামো সংগঠিত করার পাশাপাশি সর্বাধিক সংখ্যক সশস্ত্র স্বেচ্ছা-সংগ্রামীকে দেশের ভিতরে পাঠানোকেই তাজউদ্দিন সব চাইতে বড় কাজ হিসাবে গ্রহণ করেন। কিন্তু এই অনিয়মিত লড়াইয়ের জন্য সারা দেশে দু’তিনটি এলাকা বাদে না ছিল কোন নিরাপদ গোপন ঘাঁটি, না ছিল নূ্যনতম রাজনৈতিক সংগঠন। স্বাধীনতা সমর্থক রাজনৈতিক কর্মীরা সকলেই প্রায় দেশের বাইরে। রাজনৈতিক অবকাঠামোর অভাবে গেরিলা পদ্ধতির যুদ্ধ সম্ভব নয়। এই অবস্থায় সুসংগঠিত গেরিলা যুদ্ধে প্রতিপক্ষকে পর্যুদস্ত করার পরিবর্তে কমান্ডো ধরনের অনিয়মিত আক্রমণে শত্রুপক্ষের কিছু ক্ষয়ক্ষতি সাধনই কেবল সম্ভব ছিল। অথচ বাংলাদেশের নিজস্ব শক্তিতে স্বাধীনতাযুদ্ধ সফলভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজন ছিল ব্যাপক গেরিলা যুদ্ধের।
অধ্যায় ০৫: মে – জুন
মে মাসে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং এর জন্য ভারত সরকার নিজস্ব সেনাবাহিনী নিযুক্ত করেন। এ ছাড়াও ভারত সরকার স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের জন্য একটি ট্রান্সমিটার বরাদ্দ করে বাংলাদেশ সরকারের আর একটি অনুরোধ পূরণ করেন। এতদসত্ত্বেও এমন বলার উপায় নেই যে, ভারত সরকারের নীতি তখনও বিভিন্নমুখী বিচার বিবেচনা, পরস্পরবিরোধী স্বার্থের টানাপোড়েন এবং অস্পষ্টতা কাটিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের সহায়তায় প্রযুক্ত হয়েছে। বস্তুত ভারতীয় সীমান্ত উন্মুক্ত হবার পর, পাকিস্তান যে হারে সাধারণ মানুষকে ভিটে-মাটি থেকে উচ্ছেদ করে ভারত অভিমুখে পাঠাতে শুরু করে, তাতে অচিরেই ভারতীয় কর্তৃপক্ষ উপলব্ধি করেন, বাংলাদেশ আন্দোলনকে সাহায্য করার সামরিক ঝুঁকি প্রায় সীমাহীন। কাজেই মে ও জুনে ভারতীয় নীতিনির্ধারকগণ ঝুঁকি ও লাভের নিরুত্তপ্ত হিসাব-নিকাশ এবং আঞ্চলিক শক্তির ভারসাম্যের চুলচেরা বিশেষণে ব্যাপত হন। এই সব বিচার বিশ্লেষণকে কেন্দ্র করে ভারতের উচ্চতর ক্ষমতার কেন্দ্রে মতপার্থক্য ও স্বার্থের দ্বন্দ্ব, বিশেষত তাদের মধ্যে বাম ও দক্ষিণের টানাপোড়েন ঘটতে থাকে। তার ফলে বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারত সরকারের প্রকৃত ভূমিকা বাংলাদেশ নেতৃত্বের অধিকাংশের জন্য দুর্বোধ্য হয়ে পড়ে।
একদিকে পাকিস্তানী হামলার মুখে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রতিরোধ সংগ্রামের অধোগতি এবং অপরদিকে প্রবাসী আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের ক্রমবর্ধমান উপদলীয় কলহের ফলে ভারতের নীতিনির্ধারকগণ ক্রমশ সন্দিহান হয়ে পড়েন যে এই প্রবাসী নেতৃত্ব দেশের অভ্যন্তরে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় আদৌ সক্ষম কিনা। এই অবস্থায় বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া তথা পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার মত ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষেত্রে ভারতের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব মোটামুটি বোধগম্য–বিশেষত সামরিক দিক থেকে যখন তারা অপ্রস্তুত। সামরিক প্রস্তুতি সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। সম্ভাব্য পাক-ভারত যুদ্ধে চীনের যোগদানের সম্ভাবনা উপস্থিত বলে বিবেচিত হওয়ায় এই প্রস্তুতির পরিসর ছিল আরও বিস্তৃত ও জটিল। তা ছাড়া কূটনৈতিক ক্ষেত্রে পৃথিবীর কোন রাষ্ট্র তখন বাংলাদেশের স্বাধীনতার অধিকার স্বীকার করতে প্রস্তুত নয়। শরণার্থী সম্পর্কে বিস্তর সহানুভূতি, উদ্বেগ ও নিন্দা জ্ঞাপন সত্ত্বেও সমগ্র ঘটনা তখনও তাদের চোখে মূলতই পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার।
বিশ্বজনমত আরও জোরদার হলে এবং পাকিস্তানের পৃষ্ঠপোষকেরা বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চাপ প্রয়োগ করলে ইয়াহিয়া জান্তা শেখ মুজিবকে মুক্তি দিয়ে উদ্ভূত সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান ঘটাতে বাধ্য হবে এমন আশাবাদ তখনও বিভিন্ন মহলে বিদ্যমান। ভারতীয় নীতি-নির্ধারকমহলের দক্ষিণপন্থী অংশ মোটামুটিভাবে এই মার্কিন সদিচ্ছা উদ্রেক করার পক্ষে তাদের সরকারী শক্তিকে নিয়োগ করার পক্ষপাতী। পক্ষান্তরে তাদের কেন্দ্রের বাম হিসাবে পরিচিত অংশটি-ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সচিব পি. এন. হাকসার এদের অন্যতম–যে সব যুক্তির সমাবেশ ঘটান তার ফলে স্থির হয়, মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং-এ সহায়তা করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিদ্রোহ ও গোলযোগ অব্যাহত রাখা এবং অধিক কার্যকর নীতির অন্বেষায় অপেক্ষা করা আপাতত অধিক যুক্তিযুক্ত।৪৪ মে মাসে সীমিত সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধাকে ট্রেনিং ও অস্ত্র প্রদানের জন্য ভারত সরকারের সম্মতি এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের জন্য ট্রান্সমিটার ব্যবহারের অনুমতি উপরোক্ত পরিস্থিতির আলোকেই বিচার্য। যতক্ষণ পর্যন্ত এই সব সাহায্যের প্রকৃতি ও পরিমাণ পাকিস্তানী শাসকবর্গের সহ্যশক্তির মাত্রাকে অতিক্রম না করে, ততক্ষণ পর্যন্ত বৃহত্তর যুদ্ধের ঝুঁকি ছিল তুলনামূলকভাবে কম। বস্তুত পাকিস্তান যেখানে এক দশক ধরে নাগা ও মিজো বিদ্রোহীদের আশ্রয় দান থেকে শুরু করে ট্রেনিং ও অস্ত্রশস্ত্র প্রদান করে এসেছে, সেখানে ভারতের পক্ষে বাংলাদেশের বিদ্রোহীদের অনুরূপ সহায়তা প্রদান না ছিল কোন দৃষ্টান্তবর্জিত কাজ, না ছিল বৃহত্তর যুদ্ধের নিশ্চিত প্ররোচনা এবং সর্বোপরি, না ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপক্ষে কোন চূড়ান্ত প্রতিশ্রুতি। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামকে সীমিতভাবে সাহায্য করা এবং প্রতীক্ষা করাই ছিল এই অন্তর্বর্তীকালে ভারতের ভূমিকা। তবে ভারতের ক্ষমতার কেন্দ্রে সম্ভবত সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই ছিলেন উদ্ভূত সমস্যার ‘রাজনৈতিক সমাধানের স্বপক্ষে, অন্তত জুলাই এর মাঝামাঝি অবধি সাগ্রহে তারা অপেক্ষমাণ ছিলেন মার্কিন প্রভাবের যাদুদণ্ডে যদি উদ্ভূত সঙ্কটের অবসান ঘটে।