তরুণদের ট্রেনিং দেওয়যার ব্যাপারে অবশ্য ভারতীয় প্রশাসনের সকল অংশের সমান উৎসাহ ছিল না। যেমন ট্রেনিং প্রদান এবং বিশেষত ‘এই সব বিদ্রোহী ও বামপন্থীদের হাতে অস্ত্র সরবরাহের ব্যাপারে ঊধ্বর্তন ভারতীয় সামরিক কর্তৃপক্ষের আপত্তি প্রথম দিকে ছিল অতিশয় প্রবল। এর অন্যতম প্রধান কারণ ছিল, নক্সালবাদী, নাগা, মিজো প্রভৃতি সশস্ত্র বিদ্রোহীদের তৎপরতা-হেতু পশ্চিমবঙ্গ ও ভারতীয় পূর্বাঞ্চলের নিরাপত্তা সম্পর্কে এদের উদ্বেগ। বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বরাদ্দকৃত অস্ত্র এই সব সন্ত্রাসবাদী বা বিদ্রোহীদের হাতে যে পৌঁছবে না, এ নিশ্চয়তাবোধ গড়ে তুলতে বেশ কিছু সময় লাগে। মুক্তিযোদ্ধা রিক্রুটিং-এর ব্যাপারে যে পদ্ধতি অনুসরণ করা হয় তাতে এই নিশ্চয়তাবোধ ক্রমে গড়ে ওঠে।প্রথম দিকে রিক্রুটিং সীমাবদ্ধ ছিল কেবল আওয়ামী লীগ দলীয় যুবকদের মধ্যে। পূর্বাঞ্চলের নিরাপত্তার দৃষ্টিকোণ থেকে এ ব্যবস্হা ছিল ভারতীয় সেনাবাহিনীরও মনঃপূত। মুক্তিযুদ্ধে যোগদানে আগ্রহীদের বিরাট সংখ্যার অনুপাতে ট্রেনিং-এর সুযোগ ছিল নিতান্ত কম। ট্রেনিং-এর আগে পর্যন্ত তরুণদের একত্রিত রাখা এবং
তাদের মনোবল ও দৈহিক সুস্থতা বজায় রাখার জন্য সীমান্তের বিভিন্ন এলাকায় ‘যুব শিবির’ ও ‘অভ্যর্থনা শিবির’ স্হাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই সব শিবিরে ভর্তি করার জন্য যে স্ক্রীনিং পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়, তদনুযায়ী ‘বহির্দেশীয় আনুগত্য’ (Extra Territorial Loyalty) থেকে যারা মুক্ত, কেবল সে সব তরুণরাই আওয়ামী পরিষদ সদস্যদের দ্বারা সনাক্তকৃত হবার পর ভর্তির অনুমতি পেত। পাকিস্তানী রাজনৈতিক পুলিশের এই বহুল ব্যবহৃত শব্দ ধার করে এমন ব্যবস্হা খাড়া করা হয় যাতে এই সব শিবিরে বামপন্থী কর্মীদের প্রবেশের কোন সুযোগ না ঘটে।
বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরের নিজস্ব ব্যবস্থাপনা ছাড়াও, প্রত্যেক যুব শিবিরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন পদমর্যাদাবিশিষ্ট একজন ক্যাম্প প্রশাসক নিযুক্ত থাকার ব্যবস্থা ছিল। সম্ভবত এই ক্যাম্প প্রশাসকের উপস্থিতির ফলে ট্রেনিং-এর জন্য বাছাই করা তরুণদের রাজনৈতিক প্রবণতা সম্পর্কে ভারতীয় নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষের মানসিক দুশ্চিন্তা বহুলাংশে হ্রাস পেত। অবশ্য পরে, আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে, সামগ্রিক সমস্যার চাপে ভারত সরকারের নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে যখন দক্ষিণপন্থীদের প্রভাব হ্রাস পায় এবং বাংলাদেশ মন্ত্রিসভার মধ্যে তাজউদ্দিনের অবস্হান অপেক্ষাকৃত সবল হয়, তখন বাংলাদেশের বামপন্থী তরুণদের বিরুদ্ধে এই বিধি-নিষেধ বহুলাংশে অপসারণ করা হয়। জন-সংগঠন হিসাবে আওয়ামী লীগের তুলনামূলক বিরাটত্বের দরুন মুক্তিবাহিনীতেও আওয়ামী লীগপন্থীদের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা ঘটা ছিল খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু যে প্রক্রিয়ায় এবং দলীয় পক্ষপাতিত্বের ভিত্তিতে রিক্রুটিং করা হয়, তা কেবল অনাবশ্যকই ছিল না, অধিকন্তু তা দুই ধরনের অবাঞ্ছিত প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে।
প্রথমত, মুক্তিযোদ্ধা রিক্রুটিং-এর ব্যাপারে পরিষদ সদস্যদের সুপারিশ করার যে বিধান ছিল, অনেক ক্ষেত্রে সেই সুপারিশের অপব্যবহার ঘটতে দেখা গেছে। এদের অনেকে স্থানীয় রাজনীতির সুবিধার্থে অধিক সংখ্যায় কেবল নিজ নিজ এলাকার তরুণদের মুক্তিবাহিনীতে ঢোকাবার প্রবণতা দেখাতেন। অনেক ক্ষেত্রে প্রার্থীর দৈহিক যোগ্যতা, সংগ্রামী স্পৃহা এবং চারিত্রিক গুণাগুণ শিথিলভাবে বিচার করা হয়েছে। অংশত এর ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের বৃহত্তর অংশ পরবর্তীকালে লড়াই থেকে সম্পূর্ণ দূরে সরে থাকে, এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ অপেক্ষা গ্রামীণ বিবাগ ও ব্যক্তিগত রেষারেষির নিষ্পত্তিতে, এমনকি সরাসরি লুটতরাজে অংশগ্রহণ করে।
দ্বিতীয়ত, স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগদানেচ্ছু অপর নানা দল ও মতের ছাত্র-যুবকদের জন্য রিক্রুটিং-এর ব্যাপারে আওয়ামী লীগের একাধিপত্য ছিল প্রবল ক্ষোভ ও হতাশার কারণ। দেশের ভিতরে পাকিস্তানী নির্যাতন যতই গ্রাম-গ্রামান্তরে বিশেষভাবে তরুণ সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়েছে, ততই প্রতিদিন হাজার হাজার ছাত্র-যুবক ট্রেনিং লাভের আশায় ভারতে এসে ভিড় করেছে, মাসের পর মাস। অপেক্ষা করেছে সাধারণ শরণার্থী শিবিরে অথবা সরকার অননুমোদিত ক্যাম্পের অবর্ণনীয় দুর্দশার পরিবেশে। মার্চ-এপ্রিলে পাকিস্তানের হত্যাযজ্ঞের মুখে বিভিন্ন দল, মত ও শ্রেণীর মানুষের মধ্যে স্বাধীনতার স্বপক্ষে এক স্বতঃস্ফুর্ত ঐক্য গড়ে উঠেছিল। মুক্তিযোদ্ধা মনোনয়ন ও ট্রেনিং এর ক্ষেত্রে প্রদর্শিত বৈষম্য তরুণদের সেই একতাবোধকে বহুলাংশে বিনষ্ট করে। সেপ্টেম্বরে রিক্রুটিং এর ক্ষেত্রে দলীয় বৈষম্যের নীতি অনেকখানি হ্রাস পেলেও মুক্তিযোদ্ধাদের পর্যায়ে অবিশ্বাস, রেষারেষি ও দ্বন্দ্বের জের মূলত চলতেই থাকে।
ট্রেনিং-এর ক্ষেত্রে সঙ্কীর্ণ দলীয় একাধিপত্যের নীতি প্রথম থেকেই ছিল তাজউদ্দিনের মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত রাজনৈতিক পরিকল্পনার পরিপন্থী। ১০ই এপ্রিলের বেতার বক্তৃতায় তাজউদ্দিন ‘আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামে যোগ দেবার জন্য বিশেষভাবে সকল রাজনৈতিক দলের নেতাকে আমন্ত্রণ জানান। তাজউদ্দিনের ইচ্ছা ছিল আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সদস্যদের সমবায়ে মন্ত্রিসভা গঠনের পাশাপাশি বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং সরকারকে সমর্থনদানকারী সব ক’টি রাজনৈতিক দলের সমবায়ে একটি মোর্চা বা ফ্রন্ট গঠন করা এবং দেশের অভ্যন্তরে মুক্তিযুদ্ধ সমন্বয়ের দায়িত্ব এই ফ্রন্টের হাতে অর্পণ করা।