- বইয়ের নামঃ মূলধারা ’৭১
- লেখকের নামঃ মঈদুল হাসান
- প্রকাশনাঃ দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড(ইউ পি এল)
- বিভাগসমূহঃ মুক্তিযুদ্ধের-বই
অধ্যায় ০১: ২৫ শে মার্চের প্রাক্কাল
বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের দূরবর্তী কারণ অনেক ছিল। এর মাঝে সর্ববৃহৎ কারণ ছিল ১৯৪৭ সালে–বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের সমাপ্তিকালে–ভাষা, সমাজ, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ভৌগোলিক অবস্থানের সকল বিরুদ্ধতাকে উপেক্ষা করে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র গঠন পরিকল্পনার অভিনবত্বে। দ্বিতীয় বৃহৎ কারণ ছিল ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন নানা ভাষাভাষীদের নিয়ে একটি ঐক্যবদ্ধ জাতি গঠনের উপযোগী রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো অন্বেষণে পাকিস্তানী নেতৃবর্গের সম্যক ব্যর্থতা। ফলে পাকিস্তানের কাঠামোগত স্ববিরোধিতার সমাধান না ঘটে বরং দ্বন্দ ও সংঘাতের স্রোত উত্তরোত্তর প্রবল হয়ে ওঠে। পাকিস্তান গঠনের পর থেকেই বাঙালীরা রাষ্ট্র জীবনের সর্বক্ষেত্রে উপেক্ষিত,বঞ্চিত ও শোষিত হতে শুরু করে। এর প্রতিক্রিয়া হিসাবে তারা কখনো রাষ্ট্রভাষার আন্দোলন,কখনো স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন,কখনো জনসংখ্যাভিত্তিক আইন পরিষদ গঠনের দাবী এবং কখনো অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণের দাবী করে এসেছে।
পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে পূর্ব বাংলার মানুষের সংগ্রামের ইতিহাস দীর্ঘ। নানা জোয়ার ও ভাটা,ঐক্য ও বিভেদ সত্ত্বেও এই সংগ্রামের ধারা সর্বদা প্রবহমান ছিল। পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে পূর্ব বাংলার মানুষের সুস্পষ্ট অভিমত প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৫৪ সালে সংঘটিত প্রাদেশিক সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে। বিরোধীদলীয় যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী কর্মসূচী ‘একুশ-দফায় বলা হয়, দেশরক্ষা, পররাষ্ট্র ও মুদ্রা ব্যতীত অপর সকল বিষয় প্রাদেশিক সরকারের অধীনে আনা প্রয়োজন। নব নির্বাচিত প্রাদেশিক পরিষদে যুক্তফ্রন্ট বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু অচিরেই পাকিস্তানের শাসকবৃন্দ যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙ্গে দিয়ে পূর্ব বাংলায় কেন্দ্রের শাসন আরোপ করে ব্যাপক দমনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এর পর শুরু হয় স্বায়ত্তশাসনকামী দলসমূহের মধ্যে দ্বন্দ্ব,বিভেদ ও তাদের একাংশের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের ইতিহাস।
প্রায় একই সময়ে আন্তর্জাতিক ঠাণ্ডাযুদ্ধ দক্ষিণ এশিয়ায় সম্প্রসারিত হয় এবং পাকিস্তানের সামরিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাওয়ার এক পর্যায়ে ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর প্রধান আইয়ুব খান রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে। ফলে পাকিস্তানের ক্রমবর্ধমান আঞ্চলিক সমস্যা নিরসনের রাজনৈতিক প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে পড়ে। সামরিক আইনের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ১৯৬০ সাল থেকে পূর্ব বাংলার অর্থনীতিবিদ, সাংবাদিক ও সমাজের বিভিন্ন অংশ থেকে আঞ্চলিক বৈষম্য দূর করার উপায় হিসেবে পূর্ব বাংলার সম্পদের একতরফা পাচার রোধ এবং সেই সম্পদ সদ্ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রদেশের পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার দাবী ক্রমশ প্রবল হয়ে ওঠে। আওয়ামী লীগ নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর তার একনিষ্ঠ অনুগামী শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৩ সালে আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবিত করেন এবং এই দলকে পুনরায় পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের পক্ষাবলম্বী করে তোলেন। ১৯৬৫ সালে কাশ্মীর প্রশ্নে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যকার যুদ্ধ অমীমাংসিতভাবে শেষ হওয়ার পর পাকিস্তানে যে তীব্র অর্থনৈতিক মন্দা শুরু হয়, সেই পটভূমিতে শেখ মুজিব তার বিখ্যাত ছ’দফা কর্মসূচী ঘোষণা করেন। এই ঘোষণা ছিল পাকিস্তানী রাষ্ট্রকাঠামোর অধীনে বাঙালীর স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার সর্বোচ্চ দাবী।
পূর্ব ও পশ্চিমের এই বিরোধ ছাড়াও সামরিক বনাম বেসামরিক শাসনের বিষয় ছিল দেশের আর একটি প্রধান রাজনৈতিক বিতর্ক। এই শেষোক্ত বিতর্কের সূত্র ধরে ১৯৬৮ সালের অক্টোবরে পশ্চিম পাকিস্তানে আইয়ুবের ১০ বছর স্থায়ী স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে ব্যাপক গণ আন্দোলন শুরু হয়। তার কিছু পরে পূর্ব পাকিস্তানে যখন এই আন্দোলনের ঢেউ এসে লাগে,তখন গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা ও আঞ্চলিক অর্থনৈতিক স্বাধিকারের দাবী সম্বলিত ছ’ দফা কর্মসূচীর প্রবক্তা শেখ মুজিব বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।
আইয়ুবের পতনের পর সেনাবাহিনী রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা সংরক্ষণের জন্য সরাসরি দায়িত্বভার গ্রহণ করলেও গণ-অভ্যুত্থানের ব্যাপকতাদৃষ্টে একথা তাদের কাছেও স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে দেশে প্রত্যক্ষ সামরিক শাসনের পুনঃপ্রবর্তন অসম্ভব এবং সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের গণদাবী অপ্রতিরোধ্য। এই অবস্হায় সেনাবাহিনী রাজনৈতিক দলসমূহের এক দুর্বল যুক্ত সরকার গঠন করে নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্য সচেষ্ট হয়। কেন্দ্রে একটি বেসামরিক কোয়ালিশন সরকার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে ক্ষমতাসীন সামরিকচক্র বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে নানা দ্বিপাক্ষিক গোপন সমঝোতা গড়ে তুলতে থাকে। তারই ভিত্তিতে ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
পাকিস্তানের অনন্যসাধারণ গঠন-কাঠামোর দরুন এবং বিশেষত পূর্ব বাংলার উপর অর্থনৈতিক শোষণ ও রাজনৈতিক নিপীড়নের ফল হিসেবে এই অঞ্চলে নির্বাচনের রায় প্রায় সর্বাংশে যায় আওয়ামী লীগের ছ’দফার পক্ষে। পূর্ব পাকিস্তান থেকে ১৬৯ আসনের মধ্যে ১৬৭ আসন দখল করে আওয়ামী লীগ ৩১৩ আসন-বিশিষ্ট পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে এবং সরকার গঠনে ও শাসনতন্ত্র প্রণয়নের যোগ্যতা অর্জন করে। ঘটনাটি ছিল পাকিস্তানের কায়েমী স্বার্থের বিরুদ্ধে সমূহ আঘাত।