(গান)
অ্যাই, সাঁইয়া নাহি বোলুঙ্গী
কও দেহি :
(ছাত্রী ও শিক্ষক উভয়ের গান)
সাঁইয়া নাহি বোলুঙ্গী
ঠাকুরমা : এ আবার কোন ছাতার গান গাইতে আছ? অডার মানে কী?
শিক্ষক : আইজ্ঞা, এইডার মানে হইল গিয়া এই, সাঁইয়ারে কইতাছে যে আমি নামুম, একটা লুঙ্গি লইয়া আসি । সাঁইয়া নাহিব, লুঙ্গি, সাঁইয়ার কাছে লুঙ্গি চাইতাছে।
ঠাকুরমা : কী কও! বামুনের বাড়ি লুঙ্গি কও! এই গান তুমি মিয়াঁ সাহেবদের বাড়ি গিয়া শিখাও গিয়া। আরে কাপড় না চাইয়া চাও কিনা লুঙ্গি! কী ছাতার লুঙ্গির গান…
শিক্ষক : আঃ ! আচ্ছা মুশকিল পড়ছি এই বুড়িটারে লইয়া আচ্ছা, আচ্ছা, এই গানটা শোনেন দেহি – আমার মনে হয় ই গানটা আপনার ভালো লাগবই, এইটা শোনেন দেহি, এই দেখেন:
(গান)
বিছুনানা মোরি বাজে ঝনন
সাসহুঁ জাগে, ননদহুঁ জাগে
আউর জাগে সব কুটুমকে লোগুয়া
মহম্মদ শা সাথ সদারঙ্গ জাগে,
ক্যায়সে মিলুঁ ম্যায় হরিকে চরণ॥
ঠাকুরমা : আহা-হা হা ! এই না কয় গান! হরির চরণ বাতলাইবার চায়। অর মানেডা তাই না মাস্টর? হরির চরণ বাতলাইবার চায় না?
শিক্ষক : আজ্ঞে না, তা ঠিক না, আজ্ঞে হাঁ – আজ্ঞে হ হ – ঠিক তাই-ই তাই-ই, তবে কিনা – আমাদের শ্রীরাধিকা, আমাদের শ্রীরাধিকা কইতাছেন যে বিছুনানা বাজে ঝন ঝন ঝন ঝন অর্থাৎ কিনা বিছানা ঝন ঝন কইরা বাজতাছে।
ঠাকুরমা : আরে হ হ, বাত হইলে ওই রকম বাজে।
শিক্ষক : আজ্ঞে হ, আজ্ঞে হ, বাত হইলে ওই রকম বাজে; আর কইতাছেন কী – কইতাছেন শাশুড়ি জাগে, ননদিনি জাগে, কুটুমে জাগে, হগ্গলে জাগে।
ঠাকুরমা : জাগব না? ঘরের বউ হইয়া পরের কাছে যায় : নিশ্চয় জাগব। হাজার বার জাগব।
শিক্ষক : আজ্ঞে হ, এরা তো জাগতেই আছেন; আর জাগতে আছেন কে? জাগতে আছেন মহম্মদ শা, জাগতে আছেন সদারঙ্গ মিয়াঁ; সদারঙ্গ মিয়াঁরে লইয়া মহম্মদ শা জাগতে আছেন। তাই রাধিকা কইতাছেন যে কেমন কইরা হরির কাছে যাইমু?
ঠাকুরমা : কী কও? সদারঙ্গ মিয়াঁ আইল কোন থাইক্যা? মিয়াঁ সাহেবেরে উইঠ্যা যাইবার কও। আমাগো রাধা শ্রীহরির কাছে যাইবার পথ পাইতেছ না।
শিক্ষক : আজ্ঞে, উনি যাইবেন কেমন কইর্যা ? গানটা যে ওঁরই লেখা।
ঠাকুরমা : আচ্ছা, আচ্ছা, মিয়াঁ সাহেবের মুরগি কিন্যা খাইবার পয়সা দিমু। ওঁরে এখনই উইঠ্যা যাইবার কও।
শিক্ষক : আমি কি ওনারে উঠাইতে পারি?
ঠাকুরমা : তুমি না পার পুলিশে খবর দাও, চৌকিদারে খবর দাও, থানায় খবর দাও, আমাগো দারোয়ান ডাকতে হইব মাস্টর, আমাগো দারোয়ান ডাকতে হইব।
শিক্ষক : কী কপালই করছি রে বাবা গান শিখাইতে আইসা।
বাসন্তিকা
কুশীলব
(পুরুষ)
ফাল্গুনী হৃদয়-রাজ্যের রাজা
দখিন হাওয়া ওই মন্ত্রী
কোকিল ওই দূত
পঞ্চশর ওই সেনাপতি
ভ্রমর, মৌমাছি, প্রজাপতি দোয়েল শ্যামা… বৈতালিক দল।
(নারী)
বাসন্তিকা ফুলের দেশের রানি
চৈতালি রানির প্রিয় সহচরী
প্রথম দৃশ্য
প্রেক্ষাগৃহের সম্মুখে ধোঁয়া রঙের যবনিকা। সেই যবনিকার এক পাশে অস্পষ্ট শ্বেতকরবীর গাছ আঁকা। গাছ থেকে কতক ফুল ঝরে পড়েছে, কতক ফুল ঝর-ঝর। আরেক পাশে আঁকা পল্লবহীন শিমুলতরু – তাতে দু-একটি কুঁড়ি দেখা দিয়েছে। যেন শীত ফুরিয়েছে, বসন্ত আসছে। … যবনিকা তোলার সঙ্গে সঙ্গে রাজাধিরাজ ফাল্গুনীর অগ্রদূত কোকিল মুহুর্মুহু কু্হুস্বরে রাজার আগমনবার্তা ঘোষণা করল। দূরে মৃদঙ্গ বীণা বেণুকা বেজে উঠল।
ভ্রমর, মধু-মক্ষী, প্রজাপতি, দোয়েল, শ্যামা প্রভৃতি বৈতালিকদল সমস্বরে গেয়ে উঠল :
(গান)
এল ওই বনান্তে পাগল বসন্ত।
বনে বনে মনে মনে রং সে ছড়ায় রে
চঞ্চল তরুণ দুরন্ত॥
বাঁশিতে বাজায় সে বিধুর
পরজ-বসন্তের সুর
পাণ্ডু কপোলে জাগে রং নব অনুরাগে,
রাঙা হল ধূসর দিগন্ত॥
কিশলয়-পর্ণে অশান্ত
ওড়ে তার অঞ্চলপ্রান্ত,
পলাশকলিতে তার ফুলধনু লঘুভার
ফুলে ফুলে হাসি অফুরন্ত॥
এলোমেলো দখিনা মলয় রে
প্রলাপ বকিছে বনময় রে,
অকারণ মনোমাঝে বিরহের বেণু বাজে
জেগে ওঠে বেদনা ঘুমন্ত॥
চৈতালি :
ভয় কী সম্রাজ্ঞী! তব কণ্ঠের বিভব
সীমাহীন মহীয়ান বৈচিত্রে সুরের!
বহুরূপী কণ্ঠে তব বহু সুরে গান
শুনিয়াছি বহুবার, মেনেছি বিস্ময়।
গাহো গান আনন্দের। যদি সে পথিক
সত্যই আসিয়া যায়, সে যেন জানিতে
না পারে তোমার সখী মরমের কথা।
সে যেন আসিয়া হেরে, তুমি মূর্তিমতী
আনন্দ-প্রতিমা, তুমি সম্রাজ্ঞী বনের।
রাজাই সে হয় যদি, এসে দেখে যাক
রানির মহিমা তব, শির নত করি
উদ্দেশে সে নিবেদন করুক প্রণাম।
বাসন্তিকা :
সেই ভালো, গাহি গান আমি আনমনে,
এই অবসরে তুই বনরাজ্যে মোর
বিশৃঙ্খল যাহা কিছু অসুন্দর যত
সংযত সুন্দর করি রাখিবি সাজায়ে।
অসুন্দর কোনো কিছু হেরি রাজ্যে মোর
সুন্দরের আঁখি যেন ব্যথা নাহি পায়।
(গান)
দোলা লাগিল দখিনার বনে বনে।
বাঁশরি বাজিল ছায়ানটে মনে মনে॥
চিত্তে চপল নৃত্যে কে
ছন্দে ছন্দে যায় ডেকে,
যৌবনের বিহঙ্গ ওই ডেকে ওঠে ক্ষণে ক্ষণে॥
বাজে বিজয়ডঙ্কা তারই এল তরুণ ফাল্গুনী।
জাগো ঘুমন্ত দিকে দিকে ওই গান শুনি।
টুটিল সব অন্ধকার
খোলো খোলো বন্ধ দ্বার,
বাইরে কে যাবি আয় সে শুধায় জনে জনে॥
চৈতালি :
রানি রানি। শোনো ওই দূরাগত গান,
কে যেন পথিক বুঝি পরান-পসারি
পরানের পসরা সে যায় হেঁকে গানে।
প্রথম দিনের দেখা তব সে তরুণ
এ যদি লো সেই হয় কী করিবে তবে?
মুখপানে চেয়ে রবে নির্নিমেষ আঁখি?