মৌরী :
মিতিন! দেখেছিস একটা লোক লুকিয়ে আমাদের দেখচে – চল আমরা চলে যাই –
ঝুমরো :
হাসে নাচে গায় ঝাঁক বেঁধে যায় জংলা পাখি।
বিঁধব কারে তীর দিয়ে গো কারে পিঁজরায় রাখি॥
নিঠুর আমার খেলা
দিনের বেলায় আঘাত হেনে
কাঁদি রাতের বেলা
যেন সুন্দর-বনের বাঘ চমকে ওঠে
দেখে বন-হরিণীর ডাগর আঁখি॥
তৃতীয় খণ্ড
মৌরী :
বেদের দুলাল! তুই পাখি শিকার করিস কেন?
ঝুমরো :
বেদের মেয়ে! তুই সাপ নাচাস কেন?
মৌরী :
সাপ নাচাই? সাপের মতো চোখ যার – তাকে বশ করতে – শুনবি –
বাঁকা ছুরির মতো বেঁকে উঠল যে তোর আঁখি।
বেদের দুলাল আমার সাথে সাপ খেলাবি নাকি?
তোর জোড়া-ভুরুর ধনু আমি চিনি
পাখি আমি নই বেদিয়া আমি যে সাপিনী
ভয় করি না হাসিকে
ডর লাগে তোর বাঁশিকে
তোর মনের ঝাঁপি খোলা পেলে সেথায় গিয়ে থাকি॥
মৌরী :
শুনলি তো? আচ্ছা বেদের-দুলাল তুই ফুল পাড়তে পারিস – ওই গাছের আগায় কত ফুল দেখেছিস – আমায় পেড়ে দিবি?
ঝুমরো :
ফুলের দাম দিবি তো?
মৌরী :
দাম? যা!
ঝুমরো :
আচ্ছা দাম নাই দিলি – আমি যে ফুল পেড়ে দেব – তাই দিয়ে বিনি সুতোর মালা গেঁথে আমায় দিবি তো?
মৌরী :
বারে! তা হলে তো দাম দেওয়া হয়েই গেল। দাম পেলে চলে যাবি – আর দাম না পেলে পাওয়ার আশায় আবার ফিরে আসবি।
ঝুমরো :
ফিরে এলে যদি দেখা পাই – তাহলে দাম চাইনে – তাহলে কাল আবার ফিরে আসবি?
মৌরী :
জানি না!
ঝুমরো :
(তির ছোঁড়া ও ফুল পাড়ার শব্দ) এই নে একডাল ফুল তির দিয়ে পেড়ে দিলাম – তোর আঁচলের ডালি কই?
চতুর্থ খণ্ড
মৌরী :
চুপ, ঝোপের আড়ালে মিতিন আড়ি পেতে রয়েছে –
ঝুমরো :
তুই চুপ করে আমার পানে চেয়ে থাক –
নিম-ফুলের মউ পিয়ে ঝিম হয়েছে ভোমরা
মিঠে হাসির নূপুর বাজাও গো ঝুমুর নাচো তোমরা
কভু কেয়া কাঁটায় কভু বাবলা আঠায়
বারে বারে প্রজাপতির পাখা জড়ায়
দেখে হেসে লুটিয়ে পড়ে ফুলের দেশের বউরা।
মৌরী :
যাঃ ! মিতিন সব দেখে ফেলেছে – কী লজ্জা – আমি পালাই –
ঝুমরো :
তাহলে আমিও যাই – হ্যাঁ ভালো কথা – বেদের মেয়ে, তোর নাম?
মৌরী :
আমার নাম মৌরী – বেদের ছেলে, তোর নাম?
ঝুমরো :
আমার নাম ঝুমরো –
মৌরী :
আবার আসিস।
পঞ্চম খন্ড
মৌরী :
মিতিন! ওই সে পাহাড়-চুড়োয় বসে বাঁশি বাজাচ্ছে – তুই যা ওকে ডেকে আন – আজ দু বেলা ওকে দেখিনি। আমি বসে গাই সে শুনতে পাবে আমার মাথার দিব্যি দিয়ে তাকে একবার আসতে বল –
নিশি ভোরের বেলা কাহার পাহাড়ি–বাঁশি বাজে।
তার বাঁশরির সুর বেদের নিঠুর তিরের মতো আসি বাজে॥
আমি তো নহি বনের পাখি
গাঁয়ের কন্যা ভিন গাঁয়ে থাকি
কেন নূপুর বাজায়ে কুসুম ঝরায়ে ঘুম ভাসায়ে চলে যায়
সে উদাসী বন-মাঝে॥
আসি রোজ সকালে আমার চাঁপার ডালে
কী যেন বেড়ায় খুঁজি
চাঁপার মুকুল দেখে অমনি দাঁড়ায় বেঁকে
সোনার নূপুর ভাবে বুঝি!
দূরে ত্রিকূট পাহাড়-চূড়াতে
ভোরের চাঁদ কাঁধে আমার সাথে
নিশীথে নিদ্রাহীন – আনমনা সারাদিন॥
ষষ্ঠ খণ্ড
ঝুমরো :
একী মৌরী তুই কাঁদছিস? কী হয়েছে তোর?
মৌরী :
কী হয়েছে তোর? কেন এসেছিলি তুই আমার সামনে – কেন হেসেছিল – কেন তুই …
ঝুমরো :
ও! তাই বল – আসতে দেরি হয়েছে বলে – শোন আমাদের সর্দারকে লুকিয়ে আসতে হয় কিনা তাই – আচ্ছা আমি আজই সর্দারকে বলে তার দল ছেড়ে দিয়ে তোকে নিয়ে ঘর বাঁধব – তুই আর কাঁদিসনি – আমি তোকে ছেড়ে যাব না– যাব না…
সর্দার :
হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ তোকে ছেড়ে যাব না – তোকে নিয়ে ঘর বাঁধব – ঝুমরো তুই জানিস বেদেরা ঘর বাঁধে না – ঘর তাদের বাঁধতে মানা – সারা দুনিয়াটাই তাদের ঘর….. আর কার সাথে তোর মিতালি – আমার দুশমন সেই রঘু সর্দারের মেয়ে সাথে – ঠিক করেছিস – যে আগুন সে আমার বুকে জ্বেলেছে – সেই আগুন রেখে গেলাম তার মেয়ের বুকে জ্বেলে – চল এখুনি আমরা এ বন ছেড়ে চলে যাব।
মৌরী :
ওগো কার পাপে কার সাজা – ওকে নিয়ে যেয়ো না – ওকে ছেড়ে আমি বাঁচব না…
সর্দার :
হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ প্রতিশোধ – বেদের প্রতিশোধ – উঠাও ডেরা –
মৌরী :
উঃ …. মা –
উঠাও ডেরা এবার দূরে যেতে হবে।
নিবিড় হলে মনের বাঁধন
গভীর ব্যথা পেতে হবে॥
কোথায় শূন্য মরুভূমি
ডাকো মোদের ডাকো তুমি
চিড়িয়াখানায় সিংহ গেলে
নিঠুর চাবুক খেতে হবে
বেদের মেয়ের চোখের জল বনের ঝরা ফুল
বেদের মেয়ে কাঁদে ভাসে নদীর দুকূল।
বাঙালি ঘরে হিন্দি গান
সঙ্গীত : ‘গহরী গহরী নদিয়া’ … কও।
ছাত্রী : ‘গহড়ী গহড়ী’
সঙ্গীত শিক্ষক : আরে আরে ! ‘ড়’ না, ‘গহড়ী’ না ‘গহরী’! ‘ব’ এ বিন্দু ‘র’।
ছাত্রী : ও! বুঝতে পেরেছি।
শিক্ষক : হ্যাঁ! কও দেহি।
(গান)
গহরী গহরী নদিয়া
ছাত্রীর ঠাকুরমা : আহা-হা -হা ! কী গানই গাইতেছে বিমলী! নদিয়ায়, নবদ্বীপের গান! বিমলী কি গান গাইতাছে মাস্টার? গৌর নিতাই নদিয়ায় না?
শিক্ষক : আইজ্ঞা হ্যাঁ। এইটা হইল হিন্দি গান। গহরী গহরী নদিয়ায়।
ঠাকুরমা : অর মানেডা কি হইল?
শিক্ষক : আইজ্ঞা, ওই যে গহরজান বাইজি, গহরজান বাইজি নদিয়া যাইতাছেন, গানে তাই কইতাছেন।
ঠাকুরমা : কী কও? নদিয়ায় বাইজি নাচব? গৌর নিতাই যেহানে নাচছে সেহানে কি না বাইজি নাচব? অরে পিঠ্ঠার বারি মাইরা খেদাইমু।
ছাত্রী : আঃ কী কর ঠাকুরমা? ও কি সত্য সত্যই নদিয়ায় যাইতাছে নাকি? গানে কইতাছে।
ঠাকুরমা : তুই র! তুই কী বুঝস? ধর্ম নষ্ট হইব না?
শিক্ষক : অ ! আচ্ছা, তবে থাক, তবে থাক। এই গানটা থাক। ধর্ম যদি নষ্ট হয় তবে এই গানটা থাক। আচ্ছা এই গানটা শোনেন দেহি: