(হালিমা চমকিয়া উঠিলেন, ফিরোজা পাশ ফিরিয়া জলসিক্ত চোখে তাহার বাবার দিকে তাকাইল – মির্জা সাহেব পায়চারি করিতে লাগিলেন।)
ফিরোজা :
আব্বা! আমার পাশে এসে বসো।
মির্জা সাহেব :
(কাঁপিয়া উঠিলেন)…হালিমা! তুমি ফিরোজাকে দেখো, আমি ডাক্তার ডাকতে চললাম।
ফিরোজা :
আব্বা! আব্বা! দেখছ না কীরকম ঝড়-বৃষ্টি শুরু হল আবার। তুমি যেয়ো না। আমি আর ওষুধ খাব না। একটু কাছে এসে বসো আজ লক্ষ্মীটি।
মির্জা সাহেব :
(হঠাৎ শুষ্ক হইয়া উঠিলেন।) কিন্তু আমি থাকলে তো তোমার অসুখ আরো বেড়ে উঠবে মা!
ফিরোজা :
না, আজ আর বাড়বে না। তুমি এসো (মির্জা সাহেব তাহার শয্যাপার্শ্বে বসিয়া তাহার ললাটে হাত বুলাইয়া দিতে লাগিলেন) … আব্বা, আজ আমি খুব যা-তা বকব, তুমি কিছু বলবে না বলো।
মির্জা সাহেব :
আচ্ছা মা, বলো।
ফিরোজা :
তুমি ওই পুব-জানলাটা খুলতে দাও না কেন?
মির্জা সাহেব :
(হঠাৎ কঠোর হইয়া উঠিলেন) ও ব্যাটা পাজি, নচ্ছার, বাঁদর!…কিন্তু মা, তুমি ভালো হয়ে ওঠো। ও যদি বি. এ. পাশ করতে পারে এবার, তাহলে ওই বাঁদরের গলাতেই মোতির মালা দেব – এও তো বলে রেখেছি।
ফিরোজা :
কিন্তু আমি তো আর ভালো হব না আব্বা।
মির্জা সাহেব :
(শিহরিয়া উঠিলেন) না, মা, ভালো হবে। এখনই তো ডাক্তার আসবে।
ফিরোজা :
উঁহুঁ, কিছুতেই ভালো হব না আমি।…আচ্ছা আব্বা, তুমি ওকে এ-বাড়ি আসতে দাও না কেন?
মির্জা সাহেব :
(হঠাৎ বিছানা হইতে উঠিয়া চিৎকার করিয়া) আমি ওকে খুন করব। শয়তান আমার মেয়েকে খুন করেছে।
(বাহির দ্বারে করাঘাত শোনা গেল)
হাবিব :
আমি এসেছি। আমায় খুন করুন। … মা, একটিবার দোর খুলে দিন।
মির্জা সাহেব :
খবরদার! কেউ দোর খুলো না। বেরোও পাজি এখান থেকে।
হাবিব :
পাশের খবর বের হয়েছে।
মির্জা সাহেব :
পাশ করেছ?
হাবিব :
এখনও খবর পাইনি। তার করেছি। হয়তো এখনই খবর আসবে।
মির্জা সাহেব :
মিথ্যাবাদী! আগে খবর আসুক, তারপর এসো। এখন বেরোও। মেয়ের অসুখ বেড়েছে।
হালিমা :
আহা, দাও না বাছাকে আসতে। একটু দেখে যাবে বই তো নয়! কদিন থেকে ছেলেটা যেন ছটফটিয়ে মরছে।
মির্জা সাহেব :
হাঁ, আর সেই দুঃখে নতুন নতুন গান গাওয়া হচ্ছে। চুপ করো তুমি। (চিৎকার করিয়া) এখনও দাঁড়িয়ে আছ?
হাবিব :
আছি। আমায় খুন করবেন বলেছিলেন। খুন করুন, তবুও একবার দোর খুলুন মির্জা সাহেব।
মির্জা সাহেব :
দেখেছ ব্যাটার মতোলব। নিশ্চয় সাথে পুলিশ নিয়ে এসেছে। আমায় বলিয়ে নিতে চায় যে, আমি খুন করব বলেছি। আমি কখখনো খুন করব বলিনি, তুমি লক্ষ্মী-ছেলের মতো বাড়ি গিয়ে শুয়ে পড়ো।
ফিরোজা :
কেন এত অপমান সইছ আমার জন্যে, তুমি যাও। আমি তোমায় পেয়েছি।
হাবিব :
পেয়েছ?
ফিরোজা :
হাঁ, পেয়েছি।
হাবিব :
কিন্তু, আমি তো পাইনি।
ফিরোজা :
কাল পাবে। আমি আজ তোমার উদ্দেশে যাব পুব-জানলা দিয়ে। তুমি তোমার বাতায়নের ঝিলিমিলি খুলে রেখো।
হাবিব :
কিন্তু তোমার বাতায়ন তো রুদ্ধ।
ফিরোজা :
যখন যাব তখন আপনি খুলে যাবে।
হাবিব :
তবে যাই আমি।
ফিরোজা :
যাও। যাওয়ার কালে আমার ঝিলিমিলি-তলে সেই যাওয়ার গানটা শুনিয়ে যাও।
[হাবিবের গাহিতে গাহিতে প্রস্থান]
শুকাল মিলন-মালা, আমি তবে যাই।
কী যেন এ নদী-কূলে খুঁজিনু বৃথাই॥
রহিল আমার ব্যথা।
দলিত কুসুমে গাঁথা,
ঝুরে বলে ঝরা পাতা –
নাই কেহ নাই॥
যে-বিরহে গ্রহতারা সৃজিল আলোক,
সে-বিরহে এ-জীবন জ্বলি পুণ্য হোক।
চক্রবাক চক্রবাকী
করে যেমন ডাকাডাকি,
তেমনই এ-কূলে থাকি
ও-কূলে তাকাই॥
ফিরোজা :
মা! মা! আমার কেমন করছে! মাগো, তুমি আমায় ধরো! আব্বা, তুমি যাও। তোমায় ভালো লাগে না। … মা! মা! এত বাতি জ্বলে উঠল কেন! (মূর্ছিত হইয়া পড়িল)
হালিমা :
ওগো, তোমার পায়ে পড়ি, যাও ডাক্তারকে দেখ একটু! মা! সোনা মা আমার! লক্ষ্মী মা! ফিরোজ!
মির্জা সাহেব :
ফিরোজ! মা! তুই ফিরে আয়! আমি হাবিবকে ফেরাতে যাচ্ছি।
[বিদ্যুৎবেগে বাহির হইয়া গেলেন।]
দ্বিতীয় দৃশ্য
[স্থান স্বপ্নপুরি। সাদা মেঘের পাল-টাঙানো সপ্তমী চাঁদের পানসিতে চড়িয়া হাবিব ও ফিরোজা ভাসিয়া চলিতেছে। শ্বেত-মরালীর সারি ডানা দিয়া দাঁড় টানিতেছে। তাহাদের ভিড় করিয়া ঘিরিয়াছে চকোর-চকোরী। ময়ূরকণ্ঠী আলোতে হাবিবের মুখ এবং ফিরোজার মুখ রাঙিয়া উঠিয়াছে। সারা আকাশ যেন জুঁই-বাগানের মতো বিকশিয়া উঠিয়াছে।]
ফিরোজা :
এ আমরা কোথায় এসেছি, হাবিব?
হাবিব :
(হাসিয়া) ছি, নাম ধরে ডাকতে নেই এখানে! এখানে আসতে হয় নাম ছারিয়ে, সকল নামের দিশা ছড়িয়ে। এখানে হাবিবও আসতে পারে না, ফিরোজাও আসতে পারে না।
ফিরোজা :
তবে যে আমরা এসেছি।
হাবিব :
একবার চাঁদের জ্যোৎস্না-মুকুরে ভালো করে নিজের মুখ দেখো দেখি।
ফিরোজা :
(সভয়ে) এ কী, আমি যে আমায় চিনতে পারছিনে! এ আমি কে?
হাবিব :
(হাসিয়া) কার মতো বোধ হয়?
ফিরোজা :
এ যেন – এ যেন সকলের মুখ! এ যেন শকুন্তলার, এ যেন মালবিকার, এ যেন মহাশ্বেতার মুখ! এ যেন লায়লির, এ যেন শিরীর মুখ!
হাবিব :
সত্যিই তাই, তোমার মুখে আজ নিখিল-বিরহিণী ভিড় করেছে। এখানে আসতে হয় শুধু ‘প্রিয়’ আর ‘প্রিয়া’ হয়ে। এখানে নর-নারী অ-নামিক। এ লোকে নর-নারীর পরিচয়-সংকেত ‘প্রিয়’ আর ‘প্রিয়া’। এখানে ডাকতে হয় শুধু ‘প্রিয়তম’ বলে।
ফিরোজা :
(লজ্জায় রাঙিয়া উঠিল, চাঁদকে ঘিরিয়া রামধনুর সাত-রঙা শোভা বিজলির মতো খেলিয়া গেল!) যাও! (কানে কানে) চকোর-চকোরী শুনতে পাবে যে!
হাবিব :
শুনুক। ধরায় আমাদের যে কথা কানাকানি হয়ে আছে, তারায় তারায় আজ তারই জানাজানির হুল্লোড় পড়ে গেছে। দেখছ না প্রিয়তম! কত নব নব তারা জন্ম লাভ করল সৃষ্টির নীহারিকা-লোকে, শুধু ওই কানে-কথাটি শুনবার লোভে। ওই কানে-কথা শুনবে বলেই তো চন্দ্রলোকে এত চকোর-চকোরীর ভিড়!
ফিরোজা :
এ কোন লোক, প্রিয়তম? (চাঁদ দুলিয়া উঠিল)
হাবিব :
দেখলে? চাঁদ দুলে উঠল তোমার ‘প্রিয়তম’ ডাকের নেশায়! …এ স্বপ্ন-লোক।
ফিরোজা :
স্বপ্ন-লোক! তাহলে এ-স্বপ্ন টুটে যাবে? আবার তোমায় হারাব?
হাবিব :
হয়তো হারাবে, হয়তো হারাবে না; জানিনে। তো … এ স্বপ্ন-লোক এত ক্ষণিক বলেই এত সুন্দর।…না, না, এ স্বপ্ন-লোক চিরদিনের, এ সুন্দরের আকাঙ্ক্ষা-লোক, এর কি মৃত্যু আছে? এর কি শেষ আছে?
ফিরোজা :
তবে ভয় হয় কেন? এখনই এর শেষ হয়ে যাবে মনে করে?
হাবিব :
ওই শেষের ভয় – ওই হারাবার ভয় আছে বলেই এত মধুর এ-লোক। তাই তো এমন জড়িয়ে ধরে আছি পরস্পরকে। চোখের পাতা ফেললেই এ স্বপ্ন টুটে যাবে ভয়েই তো এমন পলক-হারা হয়ে চোখে চোখে চেয়ে থাকি। ওই হারাবার ভয়েই তো চন্দ্র-সূর্য গ্রহ-নক্ষত্র এমন বিপুল আবেগে পরস্পর পরস্পরের দৃষ্টি এড়িয়ে যাচ্ছে না – পায়ে পায়ে ঘুরে ফিরছে।
ফিরোজা :
তাহলে এই বেহেশ্ত?
হাবিব :
এই বেহেশ্ত।
ফিরোজা :
তাহলে আর যারা বেহেশ্তে এসেছে তারা কই? শিরী, লায়লি, জুলেখা? আর ফরহাদ, মজনু, ইউসুফ?
হাবিব :
আমাকে ভালো করে দেখো দেখি।
ফিরোজা :
(সভয়ে হাবিবকে জড়াইয়া ধরিল) ওগো, একী! তোমার এত বিপুলতা আমি সইতে পারব না। তুমি যেন নিখিল-পুরুষ, তুমি যেন অনন্তকাল ধরে কাঁদছ।
হাবিব :
(হাসিয়া ফিরোজার কপোলে তর্জনী ও মধ্যমা অঙ্গুলি দিয়া মৃদু আঘাত করিতে লাগিল) ভয় নেই, প্রিয়তম! আর একবার দেখো, তুমি যাকে দেখতে চাইবে তাকেই দেখতে পাবে আমার মুখে।
ফিরোজা :
(তাকাইয়া স্বস্তির নিশ্বাস ফেলিল) আচ্ছা বেহেশ্তের হুরপরি কই?
হাবিব :
তুমি ইচ্ছা করলেই তারা আসবে। এখানে বাসনা দিয়ে তাদের সৃজন করতে হয়।
ফিরোজা :
তারাও সব তাহলে আমাদের মধ্যে?
হাবিব :
হাঁ, এখানে – এই স্বর্গলোকে – শুধু দুটি নরনারী – তুমি আর আমি – অনন্তকাল ধরে মুখোমুখি বসে আছে। তাদের চোখে পলক নেই। বুঝি পলক পড়লেই বিশ্ব কেঁদে উঠবে। হারিয়ে যাবে সুন্দর এ স্বর্গলোক। হারিয়ে যাব আমি আর তুমি।
ফিরোজা :
(হাবিবকে জড়াইয়া ধরিল) প্রিয়তম!
হাবিব :
(ফিরোজার কপোলে কপোল রাখিয়া) প্রিয়তম!
[চন্দ্র সাথে দোল খাইতে লাগিল। চকোর-চকোরী উন্মত্ত হইয়া উঠিল। হাবিব ও ফিরোজ চাঁদের সাথে দোল খাইতে খাইতে অস্ত গেল।]