হৃদয় জুড়ে আছে বলে
এড়িয়ে চলি নানান ছলে;
আছ আমার অন্তরে, তাই
অন্তরালে রই লুকিয়ে॥
আমার কথা শুনাই না গো
তোমার কথা শোনার আশায়;
ভরে আছে অন্তর মোর
বন্ধ তোমার ভালোবাসায়।
তোমায় ভালো বাসতে পেরে
পেয়েছি মোর আনন্দেরে,
অমর হলাম প্রিয়, তোমার
বিরহেরই সুধা পিয়ে॥
কবি আর তাঁর মানসী দ্রাক্ষা-কুঞ্জে চোখে চোখে কথা কয়; সুরে সুরে মনের ভাবের মালা গাঁথে – এ ওর গলায় দেয়; আর সাকি পরিবেশন করে তাদের আনন্দের শিরাজি। তার আপন হৃদয়-পেয়ালা থাকে শূন্য, তাকে মুখ-ভরা হাসি নিয়ে তাদের বাসি হৃদয়কে সঞ্জীবনী-সুধা দিয়ে জীবন্ত করতে হয়। ও যেন ব্রজের ললিতা। রাধা-কৃষ্ণের মিলন ঘটিয়ে তিনি তাঁর উপবাসী মনের প্রসাদ পান। তাই সাকির তৃষিত-আত্মা যে গান গেয়ে ওঠে, তারই ভাষা ফুটে ওঠে কবির রবাবে।
(গান)
(যবে) আঁখিতে আঁখিতে ওরা কহে কথা
দু-টি বনের পাখি।
শুধু শিরাজি ঢালি, আমি চোখের বালি
আমি পাষাণ সাকি॥
রিক্ত ওদের হৃদয়-পেয়ালায়
আমি অমৃত ঢালি,
আমারই অন্তর শুধু পাইল না প্রেম-মধু
রহিল খালি।
(আমি) রহি আভরণ-হীনা বাঁধি ওদের
হাতে প্রেমের রাখি॥
আমি হাসিয়া রচি যার কুঞ্জ-বাসর
দুয়ারে দাঁড়ায়ে তারই জাগি রাতি;
আমি শিয়রে রহি হায় নিজেরে দহি
যেন মোমের বাতি।
আমি গাঁথিয়া মালা, দিই সখীর হতে,
দেখি কে দেয় কার মালা কার গলাতে;
শিরাজি ঢালিতে হায় পেয়ালা ভাঙিয়া যায়
নিরালায় বন্ধুর মিলন-ছবি
আমি হৃদয়ে আঁকি॥
ফুল-চোর বুলবুল কেবলই গুঞ্জন-গানে গুল-বাগিচা প্রতিধ্বনিত করে তোলে। তার নিবেদনের বাণী যেমন অশান্ত, তেমনই মধুর, তেমনই ব্যাকুল। তার স্তব্ধ গানের সুর দখিন হাওয়ার বুকে আবর্ত তোলে, সে যেন ফাল্গুন-মাসের ঘূর্ণি হাওয়া। কবিতার উদাসীনা ধরা-না-দেওয়া প্রিয়ার শ্রবণে কেবলই গানের দুল দুলতে থাকে –
মোর প্রিয়া হবে এসো রানি, দিব
খোঁপায় তারার ফুল।
কর্ণে দুলাব তৃতীয়া তিথির
চৈতি চাঁদের দুল॥
কণ্ঠে তোমার দুলাব বালিকা
হংস-সারির দুলানো মালিকা,
বিজলি-জরিন ফিতায় জড়াব
মেঘ-রং এলোচুল॥
রামধনু হতে লাল রং ছানি
আলতা পরাব পায়;
চাঁদ হতে এনে চন্দন, প্রিয়
মাখাব তোমার গায়।
গোলাপ-ফুলের পাপড়ি আনিয়া
রচিব তোমার বাসর, লো প্রিয়া
তোমারে ঘিরিয়া কাঁদিবে আমার
কবিতার বুলবুল॥
কবির কাব্যশ্রী যাকে ঘিরে সুষমায় বিভূষিত হয়ে ওঠে, সেই কবিতার দেবী কবির টলমল হৃদয়-কমলে টলতে টলতে গেয়ে ওঠেন –
সাকি! বুলবুলি কেন কাঁদে গুল-বাগিচায়।
ও কি মধু যাচে, কেন আসে না কাছে
অকরুণ পিয়াসে কেন মুখ-পানে চায়॥
ওর
করুণ বিলাপ শুনি লতার গোলাপ আমি
ঝুরিয়া মরি।
আমি কাঁটা-লতায় বাঁধা কুলবধূ, হায়
যাই কেমন করি!
ও যে-শিরাজি মাগে, দিতে ভয় লাগে,
তাহা সঞ্চিত থাক অন্তর-পেয়ালায়॥
কত চামেলি হেনা ওর আছে চেনা,
আমি কণ্টক-বিজড়িত গোলাপ-কলি,
মোর ডাক-নাম ধরে কেন ডাকে ঘুম-ঘোরে
ভিখারির বেশে চাহে প্রেমাঞ্জলি।
ও কি
বুঝিতে পারে না মোর মৌন ভাষা,
রক্তিম হৃদয়ের ভালোবাসা,
ঝরার আগে সাকি ওরে আমি পাব না কি
শুধু ক্ষণিকের তরে তৃষিত হিয়ায়॥
বহু রস-পিয়াসি বৈচিত্র্য-বিলাসী কবি-মন যায় সাকির পাশে। তার না-বলা বাণী সে যেন তার অতীন্দ্রিয় শ্রবণ দিয়ে শুনতে পায়।
প্রেমের কণ্টক-বিদ্ধ কবি সাকির দ্বারে গিয়ে ফিরে আসে। মুক্তপক্ষ মুক্ত আকাশের পাখিকে ডাকে নীড়ের মায়া। গুল-বাগের ছায়া-কুঞ্জে প্রেমের যে শান্ত নীড় রচেছে কবি-মানসী, তার মায়া মুক্তপক্ষের পাখা কণ্টক-বিদ্ধ করেছে – বহু-রূপের পিয়াসি-চিত্ত এক-রূপে আত্মস্থ হয়ে আজি শান্তি পেতে চায়। সাকি গুল-বাগিচার বুলবুলের হৃদয়ের প্রসাদ অনুভব করে। ভীরু কবিকে উদ্দেশ করে সে গেয়ে ওঠে –
(গান)
মুখের কথায় নাই জানালে
জানিয়ো গানের ভাষায়।
এসেছিলে মোর কাছে, হে পথিক,
কীসের আশায়॥
আপন মনের কামনারে
রাখলে আড়াল অন্ধকারে
আপনি তুমি করলে হেলা
আপন ভালোবাসায়॥
সাধ ছিল যে-হাত দিয়ে গো
পরিয়ে দেবে হার,
দ্বিধা ভরে সেই হাতে, হায়
করলে নমস্কার!
নিশুত রাতে বলো সুরে
কেন থাক দূরে দূরে,
কেন এমন গোপন কর
বুক-ভরা পিয়াসায়॥
ঝিলিমিলি
প্রথম দৃশ্য
[মির্জা সাহেবের দ্বিতল বাড়ির উপর-তলার প্রকোষ্ঠ। মির্জা সাহেবের ষোড়শী মেয়ে ফিরোজা রোগশয্যায় শায়িতা। সব জানালা বন্ধ, শুধু পশ্চিম দরজা খোলা। বাহিরে বৃষ্টি হইতেছে। পার্শ্বে বসিয়া মির্জা সাহেবের পত্নী হালিমা বিবি মেয়েকে পাখা করিতেছেন। বাদলায় ও বেলাশেষের অন্ধকারে ঘরের আঁধার গাঢ়তর হইয়া উঠিতেছিল। হালিমা বিবি উঠিয়া হারিকেন জ্বালিলেন।]
ফিরোজা :
মা!
হালিমা :
(ছুটিয়া আসিয়া ফিরোজার মুখের কাছে মুখ রাখিলেন) কী মা! সোনা আমার!
ফিরোজা :
বাতি নিবিয়ে দাও!
হালিমা :
কেন মা? বড্ড আঁধার যে! ভয় করবিনে।
ফিরোজা :
উঁহুঁ। তুমি আমায় ধরে বসে থাকো। (মা-কে জড়াইয়া ধরিল) বাতি বিশ্রী লাগে।
হালিমা :
তা তো লাগবেই মা! (দীর্ঘশ্বাস গোপন করিলেন) আচ্ছা, আমি কাগজ আড়াল করে দিই। কেমন?
ফিরোজা :
না। তুমি নিবিয়ে দাও। (রোগশীর্ণ কণ্ঠে চিৎকার করিয়া উঠিল) দাও শিগগির!
হালিমা :
কেঁদো না মণি, মা আমার! এই আমি নিবিয়ে দিচ্ছি। (বাতি নিবাইতে গেলেন। ততক্ষণে কতকগুলো বাদলা পোকা আসিয়া বাতি ঘিরিয়া নৃত্য করিতেছিল। ফিরোজা তাহাই এক মনে দেখিতে লাগিল।)
ফিরোজা :
নিবিয়ো না, মা! আমি বাদলা পোকা দেখব!
হালিমা :
(হাসিয়া ফিরিয়া আসিলেন) খ্যাপা মেয়ে! আচ্ছা নিবাব না। পোকা যে গায়ে মুখে এসে পড়বে মা, বাতিটা একটু সরিয়ে রাখি।
ফিরোজা :
(চিৎকার করিয়া কাঁদিয়া উঠিল) না! আমি বলছি, বাদলা পোকা দেখব!
হালিমা :
(কন্যাকে চুমু দিলেন) লক্ষ্মী মা আমার! অত জোরে কথা কোয়ো না! ওতে অসুখ বেশি হয়! আমি বাতি সরাচ্ছি নে।
ফিরোজা :
(চুপ করিয়া বাদলা পোকা দেখিতে লাগিল) মা, আমায় একটা বাদলা পোকা ধরে দাও না!
হালিমা :
ছি মানিক! পোকা ছুঁতে নেই! তুই আজ অমন করছিস কেন ফিরোজা?
ফিরোজা :
(কান্নার সুরে) দাও বলছি। নইলে চেঁচিয়ে রাখব না কিছু।
হালিমা :
লক্ষ্মী, মা! কেঁদো না। এই দিচ্ছি। (একটা বাদলা পোকা ধরিয়া মেয়ের হাতে দিলেন। ফিরোজা হাতে করিয়া এক মনে বাদলা পোকা দেখিতে লাগিল।)
ফিরোজা :
এই যা! পাখা খসে গেল! আ-হা-রে! আচ্ছা মা! বাদলা পোকার খুব লাগল?
হালিমা :
তা লাগল বইকী!
ফিরোজা :
তা হলে ছেড়ে দিই ওকে। মা, তুমি ওকে নীচে রেখে এসো (হালিমা বাদলা পোকা নীচে রাখিয়া আসিলেন) … মা, বাইরে খুব বৃষ্টি হচ্ছে, না?
হালিমা :
হাঁ মা, খুব বৃষ্টি। শুনছ না ঝমঝমানি?
ফিরোজা :
আমার খুব ভালো লাগে ওই বৃষ্টির শব্দ। … মা, আব্বা কোথায়?
হালিমা :
বাইরে, দহলিজে বোধ হয়।
ফিরোজা :
এখন যদি আমি খুব জোরে কাঁদি, আব্বা শুনতে পাবেন?
হালিমা :
ছি মা, কাঁদবে কেন? ওঁকে ডেকে পাঠাব?
ফিরোজা :
না, না, ডেকো না। মা খুব লক্ষ্মী মেয়ে! আচ্ছা মা, তুমি যদি এখন গান কর, আব্বা শুনতে পাবেন?
হালিমা :
ওরে দুষ্টু! বুঝেছি তোমার মতলব। … না, মা, এখন কি আর গান করে, তোর আব্বা শুনলে রাগ করবেন।
ফিরোজা :
এত বৃষ্টিতে শুনতে পাচ্ছেন কিনা! মা, লক্ষ্মী মা, সোনা-মা, আস্তে আস্তে গাও না! সেই বৃষ্টি ঝরার গানটা।
হালিমা :
আচ্ছা, গাচ্ছি আস্তে আস্তে। এখন কি আর গান আসে রে ফিরোজা। সেই কখন ছেলেবেলায় গেয়েছি গান। এখানে এসেই তা ভুলতে চেষ্টা করেছি। তোর আব্বা বড্ডো রাগ করেন গান শুনলে।
ফিরোজা :
আচ্ছা মা, গান শুনেও কেউ রাগে? আব্বা আচ্ছা মানুষ যা হোক!
হালিমা :
আগে কিছুদিন রাগ করতেন না। … গান তো প্রায় ভুলেই যাচ্ছিলাম। কেবল তোর জন্যেই আজও দু-একটা মনে আছে।
ফিরোজা :
আব্বা আগে রাগ করতেন না মা, তুমি গান করলে?
হালিমা :
না! ………. তুই এখন গান শোন।