অন্তরীক্ষে গান
হর হর শংকর! জয় শিব শংকর!
দানব-সন্ত্রাস জয় প্রলয়ংকর!
জয় শিব শংকর॥
নিপীড়িত জন-মন-মন্থন দেবতা!
আনো অভয়ংকর স্বর্গের বারতা!
জাগো মৃত্যুঞ্জয় সংঘাত-সংহর।
জয় শিব শংকর॥
এসো উৎপীড়িতের রোদনের বোধনে
বজ্রাগ্নির দাহ লয়ে রোষ-নয়নে॥
ভীম কৃপাণে লয়ে মৃত্যুর দণ্ড
দৈত্যারি-বেশে এসো উন্মাদ চণ্ড
ধ্বংস-প্রতীক মরু-শ্মশান-সঞ্চর!
জয় শিব শংকর॥
[ঊর্ধ্বে ঝঞ্ঝা, পদ্মা, বজ্রশিখা, মেঘ, পবন। নিম্নে তরঙ্গ-সেনা, সেতু জলদেবীগণ, মীনকুমারীগণ, ভারবাহী পশু ও মানুষ, পীড়িত মানবাত্মা।]
ভারবাহী মানুষ :
(অন্তরীক্ষ লক্ষ করিয়া) জাগো দেবতা! আর এ ভার বইতে পারিনে। যন্ত্র-রাজা আমাদের ক্ষুধার অন্নের বিনিময়ে আমাদের সর্বস্ব হরণ করেছে। আমাদের আত্মাকে হত্যা করে পশু করে তুলেছে। আমাদের পিঠে হয়েছে কুব্জ, আমাদের দেহ হয়েছে রোগ-জীর্ণ, খর্ব। আমাদের কর্তব্য হয়েছে ওদের ভার বহন। জাগো, দেবতা, জাগো!
ভারবাহী পশু :
জাগো রুদ্র জাগো! নিপীড়িত কুলিরও অধম হয়েছি আমরা। যন্ত্ররাজের পশুত্ব আমাদেরও নীচে গিয়ে পৌঁছেছে। ক্ষুধায় তৃষ্ণায় ওষ্ঠাগত-প্রাণ আমরা। আমরা দিবসে হই তার ভারবাহী, নিশীথে হই ক্ষুধার আহার্য। জাগো রুদ্র, এই অপমৃত্যুর হাত হতে আমাদের রক্ষা করো!
পদ্মা :
ওই শোনো, শোনো দেবরাজ-সেনাপতি! নিম্নে পীড়িত মানবাত্মা, ভারবাহী পশুর ক্রন্দন-ধ্বনি! আমারই কূলে ওরা ওদের শান্ত নীড় রচনা করেছিল। যন্ত্রপতি ওদের ধরে আমারই সর্বনাশ করিয়েছে। হানো তোমার বজ্রাঘাত, আর আমি সইতে পারিনে!
ঝঞ্ঝা :
মাভৈঃ! ভয় নাই দেবী। যন্ত্ররাজের পাপের ভরা পূর্ণ হয়েছে। ওকে আরও অগ্রসর হতে দিতে দিলে আমাদের স্বর্গের সদর-দ্বারে গিয়ে সে হানা দিবে। আমি বিধাতার ইঙ্গিত নিয়ে এসেছি। (বজ্রকে দেখাইয়া) ওই দেখো তার মৃত্যুদণ্ড – জ্বলন্ত অগ্নি-শিখায় লিখা! – পবন! মেঘরাজ! – তরঙ্গসেনা! – বন্যাধারা! সকলে প্রস্তুত তো?
[ঊর্ধ্বে ও নিম্নে সমবেত কণ্ঠের জয়ধ্বনি উত্থিত হইল। সেতু-বন্ধ কাঁপিয়া উঠিল।]
এইবার আমাদের প্রলয়-নাচের পালা শুরু হোক।… দেবী! তুমি নিম্নে গিয়ে তোমার তরঙ্গসেনা বন্যাধারাকে পরিচালিত করো। … পবন! তুমি তোমার পরিপূর্ণ গতিবেগ নিয়ে সেতু-বন্ধের ঊর্ধ্বদেশ আক্রমণ করেো। বন্যা-ধারাকে, তরঙ্গ-সেনাদলকে পশ্চাতে থেকে শক্তি দাও, সাহস দাও, পরিচালিত করো, ওদের মাঝে আরও আরও গতিবেগ সঞ্চারিত করো। মেঘ! তুমি সাগর শূন্য করে সকল গিরি-শির রিক্ত করে জলধারা বর্ষণ করো! তরঙ্গ-সেনা তোমার শক্তিতে, অধীর উন্মাদনায় উন্মত্ত ফেনায়মান হয়ে উঠুক!… বজ্রশিখা! তুমি তোমার অগ্নিদণ্ড নিয়ে সেতু-বন্ধের শিরোদেশে, পদমূলে আঘাতের পর আঘাত করো। – ধরণিধর বাসুকীকে খবর দাও, সে তার ফণা আস্ফালন করে ধরণিকে কাঁপিয়ে তুলুক। ভেঙে ফেলুক ওই অসুরের দম্ভ সেতু-বন্ধ!
[ঊর্ধ্বে নিম্নে ঘন ঘন জয়ধ্বনি উঠিতে লাগিল – “জয় গন্ধর্ব-লোকের জয়! জয় দেবরাজ ইন্দ্রের জয়! জয় মা ভবানী! জয় শংকর”!… পৃথিবী টলমল করিয়া উঠিল। ঘন ঘন বজ্রপাত ও অবিরল ধারে বৃষ্টি হইতে লাগিল। দেখিতে দেখিতে পদ্মার ঢেউ ভীম নর্তনে দুই কূল প্লাবিয়া তুলিল। তরঙ্গ-সেনাদলের গিরিমাটি-রাঙা উত্তরীয় পবন-বেগে উৎক্ষিপ্ত হইয়া উঠিল। জলদেবীগণ, মীনকুমারীগণ, হাঙ্গর, কুমির – সকলে উন্মত্ত হইয়া উঠিল। সকলে সেতুবন্ধে আঘাত করিতে লাগিল। ক্রমে শত শবভারবাহী মানুষ ও পশুর দল হাতুড়ি শাবল গাঁইতি এবং শৃঙ্গ লইয়া সেতুবন্ধকে আক্রমণ করিল। সেতুবন্ধ কাঁপিয়া উঠিল।]
সেতু :
জয়, যন্ত্ররাজের জয়! সাবধান স্বর্গ স্বর্গ-বিলাসীর দল! ও-আঘাত আমার অচেনা নয়। বহুবার ওর শক্তি পরীক্ষা করেছি। (হঠাৎ বজ্রাঘাতে টলমলায়মান হইয়া) উঃ! যন্ত্ররাজ! আর পারিনে। দেবতাই বুঝি জয়ী হল!
(বাষ্পরথে সসৈন্যে যন্ত্ররাজের আগমন)
যন্ত্ররাজ :
জাগো যন্ত্ররাজ-সেনা, জাগো! স্বর্গের চক্রান্তকে চিরদিনের মতো ব্যর্থ করতে চাই। আজকার জয় দিয়ে স্বর্গরাজ্য জয়ের কল্পনা বাস্তবে পরিণত করতে হবে। জাগো যন্ত্রী, জাগো সেনাদল!
[ইঁট, কাঠ পাথর প্রভৃতি যন্ত্ররাজ-সেনার ও সেনাপতি যন্ত্রের ঘন ঘন জয়ধ্বনি করিতে লাগিল।…দেবাসুরের ভীষণ রণ-কোলাহল ক্লেদে ধরণি আকাশ পঙ্কিল ধূম্রাক্ত হইয়া উঠিল।]
ঝঞ্ঝা :
কোথায় নিশিত পাশুপতাস্ত্র! জাগো! দেবতার উদ্যত দণ্ড হয়ে যন্ত্ররাজের বক্ষ ভেদ করো। সাবাস! (পাশুপতাস্ত্র নিক্ষেপ ও যন্ত্ররাজের পতন। সঙ্গে সঙ্গে সেতুবন্ধও ভীষণ শব্দে পদ্মাগর্ভে নিপতিত হইল।)
পদ্মা :
জয় মা ভবানী। জয় দেব-শক্তির! গন্ধর্ব-লোকের জয়! (যন্ত্ররাজের বুকে ত্রিশূল হানিয়া) আজ হতে মর্ত্যে পশুর রাজত্বের অবসান হল! (যন্ত্ররাজের বিকট আর্তনাদে আকাশ যেন ফাটিয়া চৌচির হইয়া গেল।)
ঝঞ্ঝা :
জয় দেবরাজ ইন্দ্রের! জয় মন্দাকিনী-সূতা পদ্মাদেবী! আজ গন্ধর্ব-লোকের সাথে স্বর্গও অসুর-ত্রাস থেকে মুক্ত হল। জয় শিব শংকর!
[তরঙ্গ-সেনাদল দলে দলে আসিয়া পতিত সেতুবন্ধের উপর পড়িয়া তাহাকে গ্রাস করিতে লাগিল। দেখিতে দেখিতে বিপুল সেতুবন্ধ পদ্মাগর্ভে লীন হইল। উৎক্ষিপ্ত তরঙ্গ গগন-চুম্বন-প্রয়াসী হইয়া উঠিল।…দেখিতে দেখিতে মেঘ কাটিয়া গিয়া পূর্ব গগন রাস-রঙা রামধনু-শোভিত হইয়া উঠিল। অস্তপাট সোনার গোধূলি-রঙে রাঙিয়া উঠিল। সূর্যদেব সহস্র কর বর্ষণ করিয়া পৃথিবীকে আশীর্বাদ করিলেন। পদ্মা তরঙ্গ-শিরে একরাশ ছিন্ন শতদল লইয়া স্বর্গের পানে তুলিয়া ধরিলেন, ঝঞ্ঝার ধূর্জটি-কেশে পরাইয়া দিলেন। দূর মেঘ-লোকে বিজয়-দামামা-ধ্বনি শ্রুত হইতে লাগিল।]
যন্ত্র :
(মৃত্যু-কাতর কণ্ঠে) আমার মৃত্যু নাই। দেবী! আজ তোমারই জয় হল। দেবতার মতো দানবও বলে, – ‘সম্ভবামি যুগে যুগে।’ আমি আবার নতুন দেহ নিয়ে আসব। আবার তোমার বুকের ওপর দিয়ে আমার স্বর্গজয়ের সেতু নির্মিত হবে।
পদ্মা :
জানি যন্ত্ররাজ! তুমি বারেবারে আসবে, কিন্তু প্রতিবারেই তোমায় এমনি লাঞ্ছনার মৃত্যু-দণ্ড নিয়ে ফিরে যেতে হবে!