গান
চরণ ফেলি গো মরণ ছন্দে
মথিয়া চলি গো প্রাণ।
মর্ত্যের মাটি মহীয়ান করি
স্বর্গেরে করি ম্লান॥
চিতার বিভূতি মাখিয়া গায়
লজ্জা হানি গো অন্নদায়,
বাঁধিয়াছি বিদ্যুল্লতায়,
দেবরাজ হতমান॥
পাতাল ফুঁড়িয়া করি গো মাতাল
রসাতল-অভিযান॥
তৃতীয় দৃশ্য
[সিংহাসনারূঢ়া মকর-বাহিনী পদ্মা। পরনে জল-তরঙ্গ শাড়ি, হাওয়ায় কেবলই ঝিলমিল করিতেছে। গায়ে কাঁচা রৌদ্র-কিরণের উড়ুনি। কাশ-বন চামর ঢুলাইতেছে। বেলা-ভূমে হাঙ্গর কুম্ভীর প্রহরীর কার্য করিতেছে। দুই তীরে বালুচরের শ্বেত পর্দা ঝুলানো। অগণিত মীন-সেনা সিংহাসনের চারিপাশে পায়চারি করিয়া ফিরিতেছে। জলদেবী গণ বন্দনা-গান গাহিতেছে।]
নমো নমো নমো হিম-গিরি –সূতা
দেবতা-মানস-কন্যা।
স্বর্গ হইতে নামিয়া ধূলায়
মর্ত্য করিলে ধন্যা॥
আছাড়ি পড়িছ ভীষণ রঙ্গে
চূর্ণি পাষাণ ভীম তরঙ্গে,
কাঁপিছে ধরণি ভ্রুকুটি ভঙ্গে,
ভুজঙ্গ-কুটিল বন্যা॥
কূলে কূলে তব কন্যা কমলা
শস্যে-কুসুমে হাসিছে অচলা,
বন্দিছে পদ শ্যাম-অঞ্চলা
ধরণি ঘোরা অরণ্যা॥
[জলদেবীদের নাম –তরঙ্গিণী, সলিলা, অনিলা, তটিনী, নির্ঝরিণী, বালুকা।]
পদ্মা :
তোদের এ গান থামা, তরঙ্গিণী। এ বন্দনা-গান আজ আমার গায়ে বিদ্রুপের মতো বিঁধছে।
তরঙ্গিণী :
জানি মা, তোমার বেদনা কত বিপুল। কিন্তু যন্ত্রপতির এ স্পর্ধার দণ্ড কি আমরা দিতে অসমর্থ, মা?
পদ্মা :
আপাতত তো তাই মনে হচ্ছে তরঙ্গিণী। কত বাধাই না দিলাম। যন্ত্রপতির অগণিত সেনা-সামন্ত আজও আমার বালুচরের তলে তাদের সমাধি রচনা করে পড়ে রয়েছে, তবু তো তাকে আটকে রাখতে পারলাম না। সে আমার বুকের ওপর দিয়ে তার উদ্ধত যাত্রা-পথ রচনা করে গেল। (অদূরে সেতু-বন্ধ দেখা যাইতেছিল, সেই দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া) ওই দেখেছিস তার সেতু-বন্ধ? ও যেন কেবলই আমার মাথায় চড়ে বিদ্রুপ করছে! অসহ্য তরঙ্গিণী, অসহ্য এ অপমান!
সলিল :
কী চতুর ওই যন্ত্রপতিটা, মা! কাপুরুষ – আমাদের ভয়ে আমাদের নাগালের বাইরে ওর পথ রচনা করেছে। পেতাম ওকে তরঙ্গের মুখে, তা হলে ওর ওই আকাশস্পর্শী স্পর্ধার মুখের মতো শাস্তি দিয়ে ছাড়তাম!
বালুকা :
তাহলে এতদিন ওই বালুচর হত ওর সমাধি।
পদ্মা :
যুদ্ধজয় শুধু শক্তি দিয়ে হয় না, সলিলা, শক্তির চেয়ে বুদ্ধিরই বেশি প্রয়োজন বড়ো যুদ্ধে।
অনিলা :
আচ্ছা মা, ওর পথ না হয় আমাদের নাগালের ঊর্ধ্বেই রইল, কিন্তু ও-পথের মূল তো রয়েছে আমাদেরই বুকের উপর প্রোথিত। সে-মূলকে কি আমরা উপড়ে ফেলতে পারিনে?
পদ্মা :
আমার শক্তিহীন তরঙ্গ-সেনাকে সে কথা জিজ্ঞেস করো অনিলা। সে চেষ্টা আমাদের ব্যর্থ হয়েছে। প্রথমবার – কেন, বহুবারই আমরা তাদের ও পথমূলকে উচ্ছেদ করেছি, কিন্তু আর পারা গেল না। ওর বিপুল ভারকে ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়ার শক্তি আর আমার তরঙ্গসেনার রইল না!
নির্ঝরিনী :
আচ্ছা, মা আমরা তো পারলাম না। কিন্তু আমাদের এ-অপমান – এই পরাজয় দেখে স্বর্গের দেবতারা কী করে নিশ্চিন্ত হয়ে বসে রইলেন, তাই ভাবছি। তুমি আকাশের দেবতাদের আহ্বান করো না একবার!
পদ্মা :
আমি দেবরাজ ইন্দ্রের সাহায্যও চেয়েছি, নির্ঝরিণী। দেবরাজ তাঁর মেঘ-রথে চড়ে দেখেও গেছেন সব। তিনিও যে যন্ত্রপতির এই অতি বিপুল স্থূলকায় দেখে বিস্মিত – হয়তো বা ভীতও হয়েছেন। আমার মরাল দূতী এই সেদিন ফিরে এসেছে। তিনি বলেছেন, এর জন্য তাঁকে বড়ো রকম প্রস্তুত হতে হবে। পরাজয়ের লজ্জাকে তাঁর অতিমাত্রায় ভয়!
তটিনী :
কিন্তু মা, অসুরের হাতে দেবরাজের পরাজয় তো বহুবারই হয়ে গেছে।
পদ্মা :
বারে বারে পরাজিত হয়েই তো তাঁর এত ভয়, তটিনী! তাঁর পরাজয়ের পথ অনুসরণ করে যদি অসুরের দল আবার স্বর্গ আক্রমণ করে!
[হঠাৎ ঊর্ধ্বে মেঘের দামামা-ধ্বনি শোনা গেল। পদ্মাদেবী উৎকর্ণ হইয়া উঠিলেন।]
পবন :
(হাঁপাইতে হাঁপাইতে আসিয়া) দেবী! স্বর্গে দামামা বেজে উঠেছে। আমার অগ্রজ দেবরাজ সেনাপতি ঝঞ্ঝা তাঁর সৈন্যসামন্ত নিয়ে এসে পড়লেন বলে! আদেশ দিন দেবী, আমি আমাদের সৈন্যসামন্তদের প্রস্তুত হতে বলি।
পদ্মা :
(উত্তেজনায় দণ্ডায়মান হইয়া) তুমি প্রস্তুত হও সেনাপতি! এখনই তরঙ্গ-সেনাদলকে কূলে কূলে দামামা-ধ্বনি করতে বলো। সকলে যেন তাদের অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত থাকে। আমি দেবরাজ সেনাপতিকে অভ্যর্থনা করে আনি। জয় মা ভবানী! (পদ্মা শ্বেতমরালীর ডানায় চড়িয়া ঊর্ধ্বে উড়িয়া গেলেন। তরঙ্গ-সেনা, হাঙ্গর, কুমির, মীনদল, জলদেবীগণ অতি ব্যস্ততা-সহকারে বাহির হইয়া গেল। পশ্চিম গগন অন্ধকার করিয়া কৃষ্ণমেঘ দেখা দিল। দেখিতে দেখিতে মেঘ সারা আকাশ ছাইয়া ফেলিল। ঊর্ধ্বে ভীষণ শনশন শব্দে ঝঞ্ঝা আসিয়া উপস্থিত হইল। পদ্মার জল সম্ভ্রমে বিস্ময়ে স্তব্ধ হইয়া যেন দেবরাজ সেনাপতিকে অভিবন্দনা জ্ঞাপন করিল।)
[ঝঞ্ঝার উচ্ছৃঙ্খল ঝামর-কেশ ত্রস্ত স্কন্ধ হইতে স্খলিত হইয়া ধরায় লুটাইয়া পড়িতেছে। হস্তে ধূলি-গৈরিক পতাকা। কর-খর্পরে ধূমায়িত অগ্নি। বক্ষদেশে বিদ্যুতের যজ্ঞোপবীত। চরণে খর-ধ্বনি নূপুর। নয়নে বজ্রাগ্নি-জ্বালা। বাহুতে ছিন্ন শৃঙ্খল। দিগন্ত-ছাওয়া কুটিল ভ্রু-ভঙ্গি। নিযুত বাসুকি কোটি ফণা বিস্তার করিয়া ছত্র ধরিয়াছে। তাহাদের নিশ্বাসের শব্দে স্বর্গ-মর্ত্য শিহরিয়া উঠিতেছে। – যেন দ্বিতীয় প্রলয়ের শংকর।]