[নৃত্য-গান করিতে করিতে মেঘ ও বৃষ্টিধারার প্রস্থান।]
হাজার তারার হার হয়ে গো
দুলি আকাশ-বীণার গলে।
তমাল-ডালে ঝুলন ঝুলাই
নাচাই শিখী কদম-তলে॥
‘বউ কথা কও’ বলে পাখি
করে যখন ডাকাডাকি,
ব্যথার বুকে চরণ রাখি
নামি বধূর নয়ন-জলে॥
ভয়ংকরের কঠিন আঁখি
আঁখির জলে করুণ করি,
নিঙাড়ি নিঙাড়ি চলি
আকাশ-বধূর নীলাম্বরী।
লুটাই নদীর বালুতটে,
সাধ করে যাই বধূর ঘটে,
সিনান-ঘাটের শিলা-পটে
ঝরি চরণ-ছোঁয়ার ছলে॥
দ্বিতীয় দৃশ্য
[যন্ত্রপতির রাজসভা। বিশাল লৌহমঞ্চে বিশালকায় যন্ত্রপতি উপবিষ্ট। পশ্চাতের আঁধার-কৃষ্ণ যবনিকা জুড়িয়া ভীতপ্রদ রক্তাক্ত অট্টালিকার পর অট্টালিকা – জীবজন্তু-তরুলতা-পরিপূর্ণ। বিরাট অমঙ্গলের প্রতীকসম ঊর্ধ্বে প্রসারিত-পক্ষ বিপুল শকুনি – ভীষণ দৃষ্টিতে নিম্নে চাহিয়া আছে। যন্ত্রপতির কঠিন মুখে রক্ত আলো পতিত হইয়া তাহাকে আরও ভীষণ করিয়া তুলিয়াছে। মস্তকে লৌহ-মুকুট। মুকুটমণি – ইলেকট্রিক-টর্চ। সর্বাঙ্গ ঘিরিয়া লৌহ-জালির সাঁজোয়া। দক্ষিণ করে স্থূল লৌহদণ্ড, বামকরধৃত দীর্ঘ শৃঙ্খলে বদ্ধ ক্ষুধিতদৃষ্টি সিংহ, হিংস্রমতি শার্দুল, শাণিত-নখর ভল্লুক ও কুটিল-ফণা ভুজঙ্গী – পদতলে পড়িযা ঘুমাইতেছে। প্রাসাদচূড়ায় কৃষ্ণপতাকায় ‘সাম্য মৈত্রী স্বাধীনতা’ কাটিয়া তাহারই নীচে লেখা হইয়াছে – ‘বিদ্বেষ শোষণ পেষণ!’]
‘যন্ত্র’ – বিপুল স্থূলকায়, কদাকার, অন্ধদৃষ্টি। বড়ো বড়ো নখদন্ত। দক্ষিণ হস্তে জাঁতাকল, বাম হস্তে প্রকাণ্ড সিগার – বেয়াদবের মতো তাহারই পুঞ্জীভূত ধূম মুখ দিয়া অবিরত বাহির করিতেছে। মস্তকে চিমনি-আকৃতির লম্বা টুপি। পৃষ্ঠদেশ ব্যাপিয়া বিরাট চক্র। রক্ত-বস্ত্র, রক্ত-দেহ। তাহার পৃষ্ঠে চক্রের সাথে সাথে সেও অনবরত ঘুরিযা ফিরিতেছে।
ইঁট, কাঠ, পাথর, যেন নেশা খাইয়া ঝিমাইতেছে। কেবল লৌহের উজ্জ্বল কঠিনদৃষ্টি।
ইঁটের পরনে পিরান ও সুর্কি-রং চাহারখানার ঢিলে আরবি পায়জামা। মাথায় লালরঙা চৌকো টুপি, খর্বকায়, অলস-দৃষ্টি সিমেন্ট-রং-রঞ্জিত মুখ। পায়ে চৌকো বুট।
কাঠ। স্থূল কর্কশ বস্ত্র শীর্ণকায় দীর্ঘাকৃতি, খোঁচা খোঁচা দাড়ি, বিশুষ্ক মুখ। শির নাঙ্গা। ম্লান দৃষ্টি, নখ চুল বড়ো বড়ো।
পাথর। মুখ চোখ বস্ত্র ধূমল বর্ণ। স্থূল কদাকার, কতকটা কচ্ছপের মতো। যেন শুধু পেট আর মাথা। শিরে জবড়জং কৃষ্ণ-উষ্ণীষ। হাত পা ভারী ভারী। মুখ চ্যাপটা, চোখ ছোটো।
লোহা। আলকাতরা-রং – দীর্ঘাকৃতি, বলিষ্ঠ-দেহ, কঠোর-দৃষ্টি, বদ্ধ-মুষ্ঠি তিক্ত-কণ্ঠ। আঁট-সাট জামা।
[যন্ত্র, ইঁট, কাঠ, পাথর, লোহা বদ্ধাঞ্জলি হইয়া বন্দনাগীত গাহিতেছে।]
গান
নমো হে নমো যন্ত্রপতি নমো নমো অশান্ত।
তন্ত্রে তব ত্রস্ত ধরা, সৃষ্টি পথভ্রান্ত॥
বিশ্ব হল বস্তুময়
মন্ত্রে তব হে,
নন্দন-আনন্দে তুমি
গ্রাসিলে মহাধ্বান্ত॥
শংকর হে, সে কোন্ সতী-শোকে হয়ে নৃশংস
বসেছ ধ্যানে, হয়েছ জড়, সাধিতেছ এ ধ্বংস।
রুক্ষ তব দৃষ্টি-দাহে
শুষ্ক সব হে,
ভীষণ তব চক্রাঘাতে
নির্জিত যুগান্ত॥
যন্ত্র :
আর তো আমাদের পথ এগোয় না রাজা, সামনেই খরস্রোতা পদ্মা – স্বর্গের নিষেধ-বাণীর মতো।
যন্ত্রপতি :
ওকে ওর গতি লঘু করতে বলো!
যন্ত্র :
জানি রাজা, বহু স্রোতস্বতী তোমার আদেশ পালন করেছে, কিন্তু পদ্মা তাদের সম্রাজ্ঞী!
যন্ত্রপতি :
তুমি ভুলে যাচ্ছ সেনাপতি যে, আমিও সম্রাট। ওকে বলো – এ আমার আদেশ!
যন্ত্র :
যে-মন্দাকিনী ইন্দ্ররাজের ঐরাবতকে তৃণকণার ন্যায় ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল – এ তারই জ্যেষ্ঠা কন্যা। তার তরঙ্গ-সেনার হুহুংকারে প্রলয়-নর্তনে ধরণি প্রকম্পিত!
যন্ত্রপতি :
ধরণি প্রকম্পিত হতে পারে – আমি নয়। ওকে খবরটা পৌঁছে দাও – ওর বুকের উপর দিয়ে প্রস্তুত হবে আমার পথ!
যন্ত্র :
সে খবর সে শুনেছে, রাজা। তার তরঙ্গ-সেনা পর্যন্ত এ খবর শুনে ফেনা ছুঁড়ে বিদ্রুপ করে!
ইঁট :
মনে হয়, যেন গায়ে থুথু দিয়ে অপমান করলে!
যন্ত্র :
আরে বাপু, তুমি থামো! – রাজা, এ অভিযানে তোমায় অধিনায়কত্ব করতে হবে।
যন্ত্রপতি :
তুমি কি ওর হাঙ্গর-কুমির দেখে ভয় পেয়ে গেলে সেনাপতি?
যন্ত্র :
না রাজা, আমার ভয় শক্ত-কিছু নিয়ে নয়, ভয় আমার ওই তরল তরঙ্গসেনাকে। ও যদি কামড়াত, তাহলে আমার ভয়ের কিছু ছিল না, কিন্তু ও তো কামড়ায় না – শুধু সমস্তক্ষণ ঠেলে! ধরতে গেলে আঙুলের ফাঁক দিয়ে যায় গলে!
পাথর :
আজ্ঞে, বেটা একে মনসা, তাতে আবার ধুনোর গন্ধ ওই পবন ব্যাটা। ও যখন এসে যোগ দেয়, তখন আমার এই কাবুলি বপুখানিকেও তুর্কি নাচন নাচিয়ে ছাড়ে!
ইঁট :
আজ্ঞে, আর আমাকে তো সুরকি-গুঁড়ো করে দেয়!
কাঠ :
আমার খাতির ততোধিক! কান ধরে নাকানি-চুবানি খাওয়াতে খাওয়াতে যখন দেয় রাম-ছুট, তখন দু-পাশের লোক বলে – মড়া ভেসে যাচ্ছে।
লোহা :
(সগর্বে) আমি বরং গলায় কলসি বেঁধে ডুবে মরি, তবু ওদের মতো ভেসেও যাই না, ভেঙেও পড়ি না!
পাথর :
হাঁ, তাই থাপ্পড় কষিয়ে তোমার মুখটা দেয় নয়ের মতো করে বেঁকিয়ে – তার পর বেশ করে বালি চাপা দিয়ে – দেয় জ্যান্ত কবর!
যন্ত্র :
চুপ করো সব! – তোমাদের সমবেত শক্তি দিয়ে ওকে প্রতিরোধ করতে হবে – একলা যে যাবে তাকেই অকূলে ভাসতে হবে!
কাঠ :
ভাসতে হয় তো সকলেই হবে সেনাপতি, তবে এবার সকলে একসাথে ভাসব – এই যা সান্ত্বনা! বাবা, পদ্মার যে চেহারা দেখে এসেছি তা মনে করলে এখনও কাঠ হয়ে যেতে হয়! স্রোত তো নয় – যেন লাখে লাখে পাহাড়ে অজগর ফোঁসাচ্ছে – মোচড় খাচ্ছে। তার পর কুমিরগুলো যেন খেজুর-গুঁড়ির ঢেঁকি। (অন্য দিকে চাহিয়া) হাঙরগুলোর মুখ কিন্তু আমাদের সেনাপতিরই মতো!
যন্ত্র :
দেখো, তুমি বড়ো হালকা। তোমাদের দুর্বলতায় রাজা ক্রুদ্ধ হচ্ছেন।
যন্ত্রপতি :
সেনাপতি, আমি এখন চললাম। তোমরা প্রস্তুত হও – পদ্মাকে শাসন করতেই হবে। [প্রস্থান]
পাথর :
আচ্ছা সেনাপতি, রাজার অত আক্রোশ কেন ওই জলধারার ওপর? ওকে কি না বাঁধলেই নয়? আমরা ওকে কি ডিঙিয়ে যেতে পারিনে? তা হলে খাসা হত কিন্তু! ধরি মাছ, না ছুঁই পানি। তখন একবার দেখে নিতাম – ওর তরঙ্গ-সেনা কত লাফাতে পারে? আমরা হাত ধরাধরি করে দাঁড়ালে বোধ হয় ওকে আলগোছে ডিঙিয়ে যেতে পারি।
যন্ত্র :
সে চিন্তার ভারটা আমার উপরেই ছেড়ে দাও। তোমাদের যা বলি তাই করো এখন। – আমাদের যন্ত্রপতি স্বর্গ জয় করতে চান, তাঁর যন্ত্ররথের পথের বাধা ওই বিপুল স্রোতধারা – ও যেন স্বর্গের গড়খাই – ওর তরঙ্গ যেন স্বর্গের সীমান্তরক্ষী সৈন্য। ওকে জয় করতে পারলেই স্বর্গজয় সহজ হয়ে উঠবে।
ইঁট :
স্বর্গের সরস্বতীকে তো আগেই বন্দী করেছি সেনাপতি, তাঁর বীণার তারকে বেতার-যন্ত্রের কাজে লাগিয়েছি – তাঁর পদ্মবনকে করেছি কাঠ-গুদাম! স্বর্গে আর আছে কী?
যন্ত্র :
(পাথরের প্রতি) দেখো, তোমায় ভারিক্কি বলেই জানতাম – তোমাকেও দেখছি হালকা কাঠের ছোঁয়াচ লাগল! – (কাঠের প্রতি) দেখো, তোমার হালকা হওয়ায় কিন্তু একটা সুবিধাও আছে। তোমায় তরঙ্গ সহজে ডুবাতে পারে না। ভেসে এক জায়গায় কূলে ঠেকবেই!
পাথর :
আজ্ঞে, ডুবলে কিন্তু ভরাডুবি!
যন্ত্র :
আঃ, থামো তুমি! (কাঠের প্রতি) দেখো, তোমায় নৌকা হয়ে দেখে আসতে হবে – কোথায় পদ্মার তরঙ্গ-সেনা উদাসীন, কোথায় ওর গতিবেগ লঘু।
লোহা :
আচ্ছা, সেনাপতি, পদ্মাকে কি বন্দিনী করবে?
যন্ত্র :
না। তা করতেও পারব না, আর পারলেও করতাম না। আমরা পদ্মাকে চাই না – চাই স্বর্গলক্ষ্মীকে। এই স্রোতের জল সেই স্বর্গের প্রাণধারা। এই প্রাণ-ধারার গতিবেগ সংযত করা ছাড়া একেবারে বন্ধ করলে যার জন্যে এই অভিযান, হয়তো সেই স্বর্গলক্ষ্মীকে হারাব – এবং পাব দক্ষযজ্ঞের সতীকে! আমাদের রাজমন্ত্রী কৌটিল্য তা হতে দেবেন না।
কাঠ :
কই সেনাপতি, মন্ত্রী কৌটিল্যকে তো দেখতে পেলুম না কখনও।
যন্ত্র :
সবচেয়ে মূল্যবান যে, তাকে রাখতে হয় সবচেয়ে গোপনে। মন্ত্রী কৌটিল্যই হল আমাদের রাজ্য-রক্ষার রক্ষাকবচ। আমরা সকলে, মায় রাজা পর্যন্ত, ওই কৌটিল্যেরই অস্তিত্বের প্রত্যক্ষ নিদর্শন।
পাথর :
ঠিক বলেছে সেনাপতি, দুর্বুদ্ধি যিনি, তিনি থাকেন দেখার অতীত হযে। ষড়যন্ত্রকে দেখতে যাওয়া দুরাশা!
ইঁট :
আমারও তাই মনে হয়, সেনাপতি, জগৎটাকে সৃষ্টি যেই করুক – ওর মালিক যেই হোক – ওকে চালায় কিন্তু শয়তান!
যন্ত্র :
ওহে, তোমাদের কথাবার্তায় রাজদ্রোহের গন্ধ পাচ্ছি। রাজার এবং ভগবানের দোষ-ত্রুটি নিয়ে আলোচনা করলে তার শাস্তি কী, জান?
কাঠ :
জেল কিংবা নরক। – এ বলে আমায় দেখ, ও বলে আমায় দেখ!
যন্ত্র :
এই! চুপ! চুপ! ওই রাজা আসছেন, শুনলে আর রক্ষে থাকবে না।
যন্ত্রপতি :
সেনাপতি! আজই যাত্রা করো পদ্মাতীরে তোমার সৈন্য-সামন্ত নিয়ে। সৈন্য পরিচালনের ভার আমিই গ্রহণ করব। (ইঁট, কাঠ, পাথর, লোহার প্রতি)!প্রিয় সৈনিকগণ! তোমাদেরই আত্মদানে আমার এই বিশাল সাম্রাজ্য। এর যা কিছু গৌরব, যা কিছু প্রতিষ্ঠা – সব তোমাদেরই। আমাদের এ যুদ্ধ স্বর্গ-মর্ত্যের চিরন্তন যুদ্ধ। এ যুদ্ধ জড় ও জীবের, বস্তু ও প্রাণের, মৃত্যু ও মৃত্যুঞ্জয়ের! অমৃতে আমাদের অধিকার নেই, তাই আমরা অমৃতকে তিক্ত করে তুলতে চাই! যে-বেদনা আজ মহাজড়, সেই বেদনার বিক্ষোভে দেবতার আনন্দকে পঙ্কিল করে তুলতে চাই। প্রকৃতিকে আমরা বশীভূত করেছি – এইবার স্বর্গরাজ্য জয়ের পালা। আমাদের পথের প্রধান প্রতিবন্ধক ওই মুক্ত স্রোতস্বতী – আনন্দলোকের গোপন প্রাণ-ধারা। ওকে বাঁধব না – ওর বুকের উপর দিয়ে চলে যাব আমাদের চলার চিহ্ন এঁকে। –স্বর্গের আনন্দলক্ষ্মী করবে এই জড় জগতের পরিচর্যা – এই দম্ভের দীপ্ত তিলক তোমরা পরাও এই মর্ত্যলোকের লাঞ্ছিত ললাটে। অহংকারের এই উদ্ধত পতাকা স্বর্গের বুকে প্রতিষ্ঠা করো, বীর!
সকলে :
জয় যন্ত্রপতি কী জয়! জয় যন্ত্রপতি কী জয়!!
যন্ত্র :
সৈন্যগণ, গাও আমাদের সেই যাত্রাপথের কুচকাওয়াজের গান!