আবার ইতি উতি চাও ক্যা ? ইতি উতি চাইবার লাগছ ক্যা? অ্যাঁ?
আমি কমু না, কোনখানে তোমার যমুনা তা আমি কমু না?
আরে ইতি উতি চাও বৃথাই
আমি কমু না কোথায় তোমার যমুনা
কইলকাতা আর ঢাকা রমনার
লেকে পাবে তার নমুনা।
আরে, তোমার যমুনা ল্যাক হইয়া গ্যাছে গিয়া ! বুঝলা?
হালার যমুনা হইয়া গ্যাছে গিয়া
কলেজে ফিরিছে শ্রীদাম সুদাম
শ্রীদাম সুদাম কলেজে যাইত্যয়াছে আর তুমি এখানে বাজাইত্যাছ অ্যাঁ? পোরা কপাইল্যা –
কলেজে ফিরিছে শ্রীদাম-সুদাম
মেরে মাল-কোঁচা খুলিয়া বোতাম,
লাঙল ছাড়িয়া বলরাম
ডাম্বেল মুদ্গর ভাঁজে;
ওহে শ্যাম হে শ্যাম
আরে তুমি নামো
পোড়া কপাইল্যা নামো॥
কালোয়াতি কসরত
গাব্বুসের বাপ : আইগ্যা পেন্নাম ওই পতিতুন্ডী ঠাউর ! আইগ্যা, তুমি আপনি যাইবার লাগছে কই? কহা হাহা! ওদিক পানে যাইও না ঠাউর ! ময়লা আছেন – ময়লা আছেন–মানুষের ময়লা!
পতিতুন্ডী : কে ও? গাববুসের বাপ? হল্লারে বিল্লা। নক্কুরে খাইছিল! রামচন্দ্র! বাবা গাব্বুসের বাপ। বাইচ্যা থাহ বাবা বাইচ্যা থাহ বাবা। তুমি না কইলে এহনি আমি ওই ময়লাতে পারা দিচ্ছিলাম। তা হেরে কি কয়, মুই যাইত্যাচি বৈকুণ্টু তলাপাত্রের বাড়িত। তলাপাত্র বুঝলি? বেডপ্যান, বেডপ্যান। কলা বুঝছ? হেই তলাপাত্রের বাড়িতে কালোয়াতি গান হইব – হেরে হুনবার যাইতেছি।
গাব্বুসের বাপ : কালো হাতির গান? আইগ্যা কী যে কন। মুই তো বাপের জন্মেও কালো হাতির গান তো হুনছি না। সার্কাসে কালো হাতির নাচ দেখছি – গান তো হুনছি না। মো গো গরিব গ কি যাইবার দিব?
পতিতুন্ডী : (হাসিয়া) আরে, কালো হাতির গান নয়; কালোয়াতি গান। আইও মোর লগে, যাইবার দিব না কীসের লাইগ্যা।
গাব্বুসের বাপ : আইগ্যা ওই ওইল। আপনারা যারে আতি কন, আমরাও হিরে আতি কই। চলেন আইগ্যা।
[ওস্তাদের গান হচ্ছে – ওস্তাদজি তখন বাঙলা গান ধরেছেন]
গান
(আরে হাঁ) ভক্ত তব ডাকে মেনকা-নন্দিনী সব কুচু হামার হারাইয়া মা গো তোমার নাম জপি জগদম্বা গো, মহামাইয়্যা আইস্যা সনধ্যা আঁধিয়ারা নাইশো আনন্দিনী॥
(গানের মাঝে গাব্বুসের বাপের হাউ হাউ রবে ক্রন্দন।)
পতিতুন্ডী : এরি ও গাব্বুসের বাপ! কাঁদবার লাগছস কীসের লাইগ্যা। চুপ দাও।
গাব্বুসের বাবা : আইগ্যা, ওস্তাদজির দাড়ি দেইখা আমার পাঠাডারে কথা মনে পইর্যা গেছে গো। কাল থনে আমার পাঠাডারে বিছরাইয়্যা পাইতেছি না। তেনার মুখে ওস্তাদজির মুখের লাহান দাড়ি আছিল। হেও ওইহুন
গুল-বাগিচা
গুল-বাগিচায় নৌ-বাহারের মরসুম। যৌবনের এই গুল-বাগিচার বুলবুলি, গোলাপ, চম্পা, চামেলি, ভ্রমর, প্রজাপতি, নহর, লতাকুঞ্জ, শারাব, সাকি – চির-তাজা। এখানে চির-বসন্ত বিরাজিত। সাকির হাতে শিরাজির পেয়ালা, কবির বুকে দিলরুবা, রবাব, বেণু, আর গজল-গানের দীওয়ান। এই গুলিস্তানের কবি চির-তরুণ, চির-কিশোর। কবির অঙ্গে হেলান দিয়ে লীলায়িত-দেহা কবির মানসী প্রিয়া। ফিরোজা রং-এর ওড়না, গোধূলি-রঙের পেশোয়াজ-পরা সুর্মামাখা ডাগর চোখে তার বিকশিত প্রেমের নিলাজ আকুতি। এই শীর্ণা তন্বী কবি-প্রিয়ার হাতে মৌন বীণা, অধরে অভিমান, পায়ের কাছে পড়ে গোলাপকুঁড়ির গুচ্ছ। চঞ্চল কবিকে তার বিশ্বাস নেই, কোনো প্রেমের বন্ধনে যেন এই চঞ্চলকে বাঁধা যায় না। এই আনন্দ-বিলাসী প্রজাপতিটাকে সে তার কিংখাবের বক্ষ-আস্তরণে দিবানিশি লুকিয়ে রাখতে চায়, – প্রতি মুহূর্তেই হারাই-হারাই ভয়ে তার প্রেম চকিত, বেদনা-বিহ্বল। আকাশে চাঁদ – পৃথিবীর বুলবুলিস্তানে কবি – কাউকেই ধরা যায় না।
কবি ভাবেন – যৌবন আর ফুল সকালে ফুটে সন্ধ্যায় যায় ঝরে। ফুলের মালাকে মিলন-রাতের শেষে স্রোতে ফেলে দিতে হয়। – এই তার নিয়তি।
প্রতি মুহূর্তের আনন্দকে স্বীকার করে নিতে হয় তার উদ্ভবের শুভ মুহূর্তে। এ লগ্ন বয়ে গেলে, আর তা ফিরে আসে না। তাই সে হাতের ফুলকে যখন অভিনন্দিত করে, তখন না-ফোটা গোলাপের জন্য সে কাঁদে। যে ফুল ঝরে গেল, সেই মৃত ফুলের শবকে ধরে সে অতীতের শ্মশানে কাঁদে না।
কবি তাঁর উন্মনা মানসীর আঁখি-প্রসাদ পাওয়ার জন্য গেয়ে ওঠেন –
(গান)
আধো-আধো বোল, লাজে-বাধো-বাধো বোল
বলো কানে কানে।
যে-কথাটি আধো-রাতে মনে লাগায় দোল –
বলো কানে কানে॥
যে-কথার কলি প্রিয়া আজও ফুটিল না,
শরমে মরম-পাতে দোলে আনমনা,
যে-কথাটি ঢেকে রাখে বুকের আঁচল –
যে-কথা লুকায়ে থাকে লাজ-নত চোখে,
না বলিতে যে-কথাটি জানাজানি লোকে,
যে-কথাটি ধরে রাখে অধরের কোল –
বলো কানে কানে॥
যে-কথা বলিতে চাও বেশ-ভূষার ছলে,
বলে দেয় যে-কথা তব আঁখি পলে পলে,
যে-কথা বলিতে গিয়া গালে পড়ে টোল –
বলো কানে কানে॥
কবির কাব্যলক্ষ্মী আনমনে কপোলে ঝুমকো-চাঁপার পরশ বুলাতে বুলাতে গোলাপ-লতার বুলবুলির পানে চেয়ে থাকে। বাহিরে-পাওয়ার ব্যর্থতা তার মনে তোলে অশান্তির ঝড়। তাই সে তার সুন্দরের বিগ্রহ অন্দর-দেউলে প্রতিষ্ঠিত করে আনন্দ পেতে চায়। বাহিরের সুন্দর ঘুরে বেড়ায় বাহির-ভুবনে; অন্তরের সুন্দরের চরণ নেই–নিশ্চয় চারণকে বাঁধবার এই বোধ হয় সহজতম উপায়। তাই সে তার সুন্দরের অনুনয়ের বিনিময়ে ওঠে –
(গান)
মন দিয়ে যে দেখি তোমায়
তাই দেখিনে নয়ন দিয়ে
পরান আছে বিভোর হয়ে
তোমার নামের ধেয়ান নিয়ে॥