[দূরে কাঞ্চনার গান]
সিনান করিতে গিয়েছিনু সই সেদিন গঙ্গাতটে।
উদয় হলেন গৌরচন্দ্র অমনি হৃদয় পটে॥
নির্মল মোর মনের আকাশে
উঠিয়া সে চাঁদ মৃদু হাসে,
তারে লুকাইতে নারি, সখী ভয়ে মরি, বুঝি কলঙ্ক রটে॥
নিমাই :
(এক লাইন গানের পর) আমি পালালুম কিন্তু। তোমার মুখরা সখীকে আমার বড়ো ভয়। ও কোন দিন আমাকে ধরিয়ে দেবে দেখছি।
[প্রস্থান]
পঞ্চম দৃশ্য
কাঞ্চনা :
পণ্ডিতমশাই ভয়ে পালিয়ে গেলেন বুঝি?
বিষ্ণুপ্রিয়া :
কার ভয়ে কাঞ্চনা?
কাঞ্চনা :
ধরা পড়ার ভয়ে।
বিষ্ণুপ্রিয়া :
দূর পোড়ামুখী! আচ্ছা ভাই কাঞ্চনা, তুই যখন তখন ওকে কঠিন কথা শুনাস, তোর ভয় করে না?
কাঞ্চনা :
একটুকুও না। ওই দুরন্ত পণ্ডিত মশাইটি চিরকাল আমার কাছে জব্দ। ছেলেবেলায় ওর ভয়ে আর সব মেয়ে অস্থির থাকত, কিন্তু আমায় দেখলেই উনি একেবারে কেচোঁটি হয়ে যেতেন। আমি বলতাম, তোমাদের সকলের সঙ্গে আড়ি, আর আমার সঙ্গে ভাব কেন? উনি বলতেন – ভক্তিকে ভগবান বড়ো ভয় করেন।
বিষ্ণুপ্রিয়া :
আচ্ছা, ভয় না হয় নাই করলি, পর-পুরুষ বলে লজ্জাও হয় না?
কাঞ্চনা :
ওঁর সঙ্গে আমার এই ভাব তো লুকানো ছাপানো নয় ভাই গৌর-প্রিয়া, সারা নদিয়ার লোক জানে ওঁর-আমার এই প্রীতি। আমি এই পাড়ারই মেয়ে। ছেলেবেলা থেকে ওঁকে দেখেছি, আজন্ম ওঁর সঙ্গে খেলেছি – আর আমাদের সে খেলায় লজ্জার কিছু ছিল না। তা ছাড়া ওঁকে আমার কখনও পর-পুরুষ বলে মনে হয় না, যখনই দেখেছি মনে হয়েছে উনি আমার পরম পুরুষ।
বিষ্ণুপ্রিয়া :
কাঞ্চনা, তোর মতো প্রেম যদি পেতাম –
কাঞ্চনা :
তাহলে ওঁর টোল এতদিন উঠিয়ে দিতে, আর রাতদিন উনি তোমারই পাঠশালায় প্রেমের পাঠ নিতেন, এই তো?
বিষ্ণুপ্রিয়া :
যাঃ! তোর সঙ্গে কথায় সরস্বতীও হার মেনে যায়–
কাঞ্চনা :
আর তোমার গুণে যে লক্ষ্মী স্বর্গে পালালেন।
বিষ্ণুপ্রিয়া :
তুই আমাকে সতিনের কথা মনে করিয়ে দিস কেন বল তো? আচ্ছা ভাই, দিদি খুব সুন্দরী ছিলেন, না? আর তোর সঙ্গে ওঁর বুঝি আমার চেয়েও বেশি ভাব ছিল?
কাঞ্চনা :
হ্যাঁ, সুন্দরী খুবই ছিলেন, তবে তোমার মতো না। ওঁর রূপে চাঁদের জ্যোতির চেয়ে সূর্যের তেজ বেশি ছিল। আর ভাব আমার এতটুকু ছিল না ওঁর সঙ্গে। যখন তখন ওঁর সঙ্গে ঝগড়া করতাম আর বলতাম – ঠাকরুন তুমি বৈকুণ্ঠের অধীশ্বরী। আমাদের ব্রজেশ্বরীর আসবার সময় হল, এবার তুমি সরে পড়ো না। এ রসের ব্রজে ব্রজেশ্বরী আর গোপিনিদের লীলা তুমি সইতে পারবে না। ঠাকরুন ভালো মানুষ, এই সব শুনে এবং বুঝে স্বর্গে চলে গেলেন।
বিষ্ণুপ্রিয়া :
কাঞ্চনা, কেন তুই ওঁর কথা এলেই ওঁকে ভগবান ভেবে কথা বলিস বল তো? তোর কথা শুনে আমার বড়ো ভয় হয়, সই। উনি যদি সত্যি সত্যিই ভগবান হয়ে যান তাহলে আমার কী অবস্থা হবে? আমি কোথায় দাঁড়াব? এক একবার আমারও মনে হয় উনি ছল করে মানুষ সেজে এসেছেন। ওঁর চোখ মুখ রূপ গুণ সব যেন বলে দেয়, আমি কারুরই নই – আমি একা।
কাঞ্চনা :
সত্যিই উনি পরম একাকী। আমাদের নিয়ে যে ওঁর এই লীলা এ ওঁর অসীম দয়া। তোমার কেন ভয় হয় গৌর-প্রিয়া জানি না, আমার কিন্তু ভয় হয় না। না, না, ভয় হয় বলেই তুমি ব্রজেশ্বরী, গৌরবক্ষ-বিলাসিনী। তুমি যে প্রেমময়ী তাই মধুর রূপ ছাড়া তাঁর অন্য রূপের কল্পনাও করতে পার না। আমরা সাধারণ মানুষ, – তাই দেবতাকে প্রিয়রূপে ভাবতে পারি না।
নিমাই :
যাক। আমি আর পণ্ডশ্রম করে মরি কেন, কাল থেকে টোলের ছাত্রদের বলে দেব, এই ঘরেই তারা ভাগবতের পাঠ নেবে।
কাঞ্চনা :
(চিৎকার করিয়া) মা দেখে যাও, আবার আমাদের জ্বালাতন করছে। তোমার ছেলেকে সামলাও, নইলে ভালো হবে না বলে দিচ্ছি।
শচীমাতা :
নিমাই! আবার কেন ওদের সঙ্গে লাগতে গেলে বাবা? ওরা দুটিতে আপনার মনে আলাপ করছে –
নিমাই :
আলাপ নয় মা প্রলাপ, একবার শুনে যাও না এসে।
শচীমাতা :
তা ওরা যা ইচ্ছা বকুক, তোর তাতে কাজ কী বাপু? আমি তখন থেকে কলা আর দুধ নিয়ে বসে আছি – আয় খেয়ে নে।
কাঞ্চনা :
মা, দুধকলা খাইয়ে ওঁকে পুষছ – বুঝবে যখন দংশন করে চলে যাবে।
[ বলিতে বলিতে প্রস্থান।]
ষষ্ঠ দৃশ্য
শচীমাতা :
বউমা! একী মা লক্ষ্মী। বিছানায় শুয়ে শুয়ে কাঁদছ? ছি মা! কাঁদতে নেই, নিমাই-এর আমার অমঙ্গল হবে। এইমাত্র খবর পেলুম, নিমাই কাল গয়া থেকে ফিরে আসবে। পাগলি মেয়ে, বললাম দুদিন মায়ের কাছে গিয়ে থেকে এসো, তবু খানিকটা মন ভালো থাকবে। তা আমায় ছেড়ে যেতে চাইল না।
বিষ্ণুপ্রিয়া :
মা, উনি যে যাবার সময় তোমার কাছে থেকে তোমার সেবা করতে বলে গেছেন। আর, তোমাকে মা পেয়ে আর কেউ যে আমার মা ছিল, তা ভুলেই গেছি।
শচীমাতা :
ও-কথা বলিসনে মা। আমার বেয়ান শুনতে পেলে আমায় ডাইনি বলবে। – এই কাঞ্চনা আসছে – তোমরা দুটি সখীতে বসে গল্প করো – হ্যাঁ মা, আর ওকেও বলো যে আমার নিমাই কাল ফিরে আসবে – আমি যাই – মালিনী সইকে, সর্বজয়াকে জানিয়ে আসি খবরটা।
[কাঞ্চনার গান]
প্রথম যৌবনে এই প্রথম বিরহ গো।
(তাই) সহিতে না পেরে রাই, কাঁদে অহরহ গো।
(ফুল) শয্যারে মনে হয় কন্টক শয্যা
কাঁদিতে পারে না, যত ব্যথা তত লজ্জা,
প্রবাসী বঁধুরে ঘরে আসিতে কহো গো॥
বিষ্ণুপ্রিয়া :
কাঞ্চনা সই, তোর গান এখন রাখ। শোন, মা বলে গেলেন, উনি কাল আসবেন।
কাঞ্চনা :
(সুরে) কাল কাল করে গেল কতকাল
কালের নাহিকো শেষ –
কাল নাই যথা বন্ধুরে লয়ে
যাব আমি সেই দেশ।
বিষ্ণুপ্রিয়া :
সত্যি বলছি, মা এইমাত্র ছোটো মাসিকে খবর দিতে গেলেন। মা-র সে কী খুশি ভাই, যত হাসেন তত কাঁদেন।
কাঞ্চনা :
আমার কিন্তু না-আসা পর্যন্ত বিশ্বাস হয় না, ভাই। যদি আসেন তাহলে বুঝব এবার নবদ্বীপে এসে ঠাকুর ভদ্রলোক হয়েছেন। ভদ্রলোকের যে কথা রেখে চলতে হয় এ জ্ঞান তো ওঁর ব্রজে ছিল না, আর ও-জ্ঞান হবেই বা কোত্থেকে! গয়লা ছোঁড়াদের সঙ্গে গোরু চরিয়ে কে কবে ভদ্রলোক হয়েছে?
বিষ্ণুপ্রিয়া :
না ভাই লক্ষ্মীটি, ঠাট্টা রাখ। এখন কী করব বল দেখি? আমার বুকের ভিতর যেন কেমন করছে, শরীর কাঁপছে।
কাঞ্চনা :
করবে আর কী। এসো, দুই সখীতে গলা ধরে ধেই ধেই করে নাচি। এতদিন যে বিরহ আমাদের কাঁদিয়েছে, সেই বিরহের বুকে বসে তার দাড়ি উপড়াই।
বিষ্ণুপ্রিয়া :
তোর কথা আমার কিছু ভালো লাগছে না, কাঞ্চনা। কাল যদি ভোর না হতেই এসে পড়েন, তখন ফুল পাব কোথা। এখনও সন্ধ্যা লাগেনি, তুই পাড়ায় গিয়ে কার বাড়িতে কী ফুল পাওয়া যায়, দেখ না লক্ষ্মীটি।
কাঞ্চনা :
আচ্ছা, আমি চললাম। আমি কিন্তু বেছে বেছে সেই ফুল আনব, যে ফুলে কাঁটা আছে। (প্রস্থান)
শচীমাতা :
এই ঘরে বেয়ান, এই ঘরে তোমার মেয়ে। সর্বজয়া, মালিনী সই, তোমরাও এসো বউমার ঘরে – বউমা, বউমা, দেখো আমার দুই বেয়ানকে, তোমার মাকে, খুড়িমাকে ধরে এনেছি।
বিষ্ণুপ্রিয়া :
একী! মা! খুড়িমা!
মহামায়া :
আহা! মা আমার এই কদিনে কী রকম শুকিয়ে গেছে, দেখেছিস বিধু।
বিষ্ণুপ্রিয়া :
আমার কোলে বসে থাকতে লজ্জা করচে মা, নীচে নেমে বসি।
মহামায়া :
ওরে তোর কোলে ভগবান যদি সন্তান দেন, তখন বুঝবি সন্তানকে কোলে নিয়ে মায়ের কত সুখ।
বিষ্ণুপ্রিয়া :
আমি বুঝি এখনও খুকি আছি? ওই দেখো ছোটো মাসিমা, রাঙা মাসিমা আসছেন এ-ঘরে।
শচীমাতা :
ওতে লজ্জার কী আছে বউমা? নিমাই যেদিন বিয়ে করে প্রথম তোমায় নিয়ে এল ঘরে, আমিই যে সেদিন লজ্জার মাথা খেয়ে অত লোকের মাঝে তোমায় কোলে নিয়ে নেচেছিলাম। বউমা, এই যে, তোমার মাসিমারা এসেছেন, প্রণাম করে ওঁদের পান এনে দাও।
সর্বজয়া, মালিনী :
(একজনের পরে অন্যজনে) থাক থাক মা, বেঁচে থাকো চির-এয়োতি হয়ে।
যাদব :
দিদি! দিদি! কাল জামাইবাবু আসছেন। আমাকে যাবার সময় বলে গেছিলেন, তোমার জন্য লাল শাড়ি আনবেন।
বিষ্ণুপ্রিয়া :
(চুপে চুপে) আঃ! যাদব, চুপ কর।
নিমাই :
মা! মা! আমি এসেছি – আর তোমার জন্য গয়া থেকে এনেছি কৃষ্ণপ্রেম।