(গান)
প্রেম-পাশে পড়লে ধরা চঞ্চল চিত-চোর
শাস্তি পাবে নিঠুর কালা এবার জীবন-ভোর॥
মিলন রাসের কারাগারে
প্রণয়-প্রহরী রাখব দ্বারে
চপল চরণে পরাব শিকল নব অনুরাগ-ডোর॥
শিরীষ-কামিনী ফুল হানি জরজর করিব অঙ্গ
বাঁধিব বাহুর বাঁধনে দংশিবে বেণি-ভুজঙ্গ
কলঙ্ক-তিলক আঁকিব ললাটে হে গৌর-কিশোর॥
(হুলুধ্বনি, আনন্দধ্বনি ইত্যাদি–বাহিরে বাদ্য।)
তৃতীয় দৃশ্য
নিমাই পন্ডিতের ভবন
(কাঞ্চনা বিষ্ণুপ্রিয়াকে ফুলসজ্জায় সজ্জিত করিতেছে ও গুনগুন করিয়া গান করিতেছে। গানের শব্দ শোনা যাইতেছে না, তবে তাহার করুণ সুরে সারা গৃহ যেন ভরপুর হইয়া উঠিয়াছে।)
বিষ্ণুপ্রিয়া :
তুমি কেবলই গান করছ আর আমায় ফুলের গয়না পরাচ্ছ, তুমি কে ভাই? কতবার জিজ্ঞাসা করলাম, তোমার নাম তো বললে না। এখন কেউ নেই, এসো এইবেলা আমরা সই পাতিয়ে নিই। লোক এসে পড়লে আর কথা বলতে পারব না।
কাঞ্চনা :
সতিনের সঙ্গে সই পাতালে দুঃখ পাবে ভাই।
বিষ্ণুপ্রিয়া :
সতিন?
কাঞ্চনা :
হ্যাঁ সতিন। শুধু আমি নই ভাই, এই নদিয়া নগরের সকল কিশোরী কামিনী তোমার সতিন। তোমার ভাগ্যের ঈর্ষা করে, রূপের হিংসা করে।
বিষ্ণুপ্রিয়া :
(হাসিয়া) ওঃ। সেই সতিন! তাহলে তোমায় সতিন বলে ডাকব?
কাঞ্চনা :
চুপ! দেয়ালেরও কান আছে। কেউ শুনতে পাবে এখন। আর অমনি সে ছুটে এসে আমাকে দেখিয়ে বলবে, ও নয়, আমিই তোমার সতিন। আচ্ছা ভাই গৌর-প্রিয়া–
বিষ্ণুপ্রিয়া :
(কাঞ্চনার মুখের কথা কাড়িয়া লইয়া) আমার নাম গৌর-প্রিয়া নয়, আমি বিষ্ণুপ্রিয়া।
কাঞ্চনা :
এতদিন বিষ্ণুপ্রিয়া ছিলে, এখন গৌর-প্রিয়া হয়েছ।
(সুরে)
তার কে গড়িল গৌর-অঙ্গ
চাঁদে চন্দন মাখিয়া গো
আমি শান্তি না পাই তারে কোথাও রাখিয়া গো
এই বুঝি হবে চুরি সদা ভয় ভয়
হৃদয়ে পাইয়া তবু কাঁপে এ হদয়
নয়নে পেয়ে যে চাঁদে তবু এ নয়ন কাঁদে
কোথা পাব হেন ঠাঁই যথা আর কেহ নাই
থাকিবে দুজন, গৌর আর গৌর-প্রিয়া গো॥
শচীমাতা :
পাগলি মেয়ে, বসে বসে গান গাচ্ছিস বুঝি? বউমাকে সাজানো হল?
কাঞ্চনা :
হ্যাঁ মা, কখন সাজানো হয়ে গেছে। দেখ দেখি কেমন মানিয়েছে।
শচীমাতা :
আহা মরে যাই! কী সুন্দর সাজাতে পারিস তুই কাঞ্চনা। চিরএয়োতি হয়ে বেঁচে থাকো মা। তোমার স্বামীকে ফিরে পাও। আমি আসি, তোমরা তাহলে ফুলশয্যার ব্যবস্থা করো।
বিষ্ণুপ্রিয়া :
তোমার নাম কাঞ্চনা? কী মিষ্টি নাম। যেমন দেহের কাঞ্চন বর্ণ তেমনই নাম। আর গুণ –
কাঞ্চনা :
কোনো গুণ নাই তার কপালে আগুন।
কয়েকটি তরুণী :
মাগো! পান সাজতে সাজতে হাত আমাদের চুনে খেয়ে ফেললে। কাঞ্চনা বেচারি একা – ওলো দেখে যা, কী সুন্দর সুন্দর ফুলের গয়না দিয়ে কাঞ্চনা বউকে সাজিয়েছে। আহা! যেন দুগ্গো পিত্তিমে।
দুই-তিনজন :
চমৎকার!
একজন :
কাঞ্চনা আর জন্মে বৈকুণ্ঠের মালিনী ছিলি ভাই!
অন্য একজন :
কাঞ্চনা দিদি! মা মাসিমা কেউ নেই, এইবেলা এই ফুলসাজের একটা গান গেয়ে শোনা না ভাই! নতুন বউ জানুক যে তুই শুধু মালিনী নস – গানে – কী বলব ভাই? নাচেতে উর্বশী – গানে – গানে –
অন্য একজন মেয়ে :
সরস্বতী। নে ভাই, এইবেলা টুক করে গেয়ে নে, নইলে ভিড় জমলে তুইও গাইবিনে, আমরাও শুনতে পাব না।
(কাঞ্চনার গান)
মুকুল-বয়সি কিশোরী সেজেছে ফুল্ল ফুল-মুকুলে।
শিরে কৃষ্ণচূড়ার মুকুট, গলে মালতীর মালা দুলে॥
যুথী ফুলের সিঁথি-মোর, দোলন-চাঁপার দুল
কটিতটে চন্দ্রহার হলুদ-গাঁদার ফুল
অশোক-কুঁড়ির রাঙা নূপুর রাঙা চরণ-মূলে॥
কদম-ফুলের রত্ন-বাজু বকুল ফুলের চুড়ি
হাতে শোভে কেয়ূর কাঁকর কুন্দ বেলের কুঁড়ি।
আসবে কবে বনমালী ঘুমে ফুল-বালা পড়ে ঢুলে॥
চতুর্থ দৃশ্য
শচীমাতা :
নিমাই! এ ঘর ও ঘর করে কী খুঁজছিস বাবা?
নিমাই :
(আমতা আমতা করিয়া) কী যেন খুঁজছিলাম মা, খুঁজতে খুঁজতে ভুলে গেছি।
শচীমাতা :
(হাসিয়া) তুই থির হয়ে বস দেখি। আমি বউমাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। (যাইতে যাইতে) বউমা! নিমাইকে পান দিয়ে এসো তো মা।
বিষ্ণুপ্রিয়া :
ছি ছি ছি ছি! মা কী মনে করছেন বলো তো। পড়াতে পড়াতে পাঁচ বার তো পান চাইতে বাড়িতে এলে।
নিমাই :
এবার কিন্তু পান চাইতে আসিনি । পড়াতে বসে কীসের যেন সূত্র ভুলে গেলাম–তাই একটা বই খুঁজতে এলাম॥
বিষ্ণুপ্রিয়া :
তুমি ভারী দুষ্টু! তুমি কখ্খনো বই খুঁজতে আসনি। আমি জানি তুমি কী খুঁজতে এসেছ।
নিমাই :
বউ খুঁজতে, – লক্ষ্মী?
বিষ্ণুপ্রিয়া :
আচ্ছা, তুমি আমায় আমার সতিনের নাম ধরে ডাক কেন বলো তো? লক্ষ্মী তো তোমার প্রথম স্ত্রীর নাম ছিল। তুমি দিদি কে খুব ভালোবাসতে, না?
নিমাই :
খুব ভালোবাসলে সে কি ছেড়ে যেতে পারত? তাই এবার বিয়ে করে তোমাকে নিয়ে আবার খুব ভালোবাসার সাধনা আরম্ভ করেছি।
বিষ্ণুপ্রিয়া :
যাও! সত্যি বলো না, কেন আমায় যখন তখন ওই বলে ডাক ?
নিমাই :
যিনি লক্ষ্মী তিনিই বিষ্ণুপ্রিয়া, যে বিষ্ণুপ্রিয়া সে-ই লক্ষ্মী। আচ্ছা, এবার থেকে তোমায় প্রিয়া বলে ডাকব, তাহলে খুশি হবে তো?
বিষ্ণুপ্রিয়া :
তোমার পায়ে পড়ি, ওতে আমার আরও লজ্জা করবে, তার চেয়ে তুমি বরং লক্ষ্মীই বোলো।
নিমাই :
আরে, আমি কি পাড়ার লোক ডেকে সভা করে, তোমায় প্রিয়া বলে ডাকব? এই আড়ালে আড়ালে –দুজনে যখন এমনি একা থাকব, তখন। আমি অনেক দিন থেকে ভাবছি তোমায় একটা কথা জিজ্ঞাসা করব প্রিয়া, তুমি সত্য করে বলবে?
বিষ্ণুপ্রিয়া :
ও কী কথা বলছ তুমি। তুমি যে স্বামী, নারায়ণ, তোমার কাছে মিথ্যা বললে যে আমার মরলেও স্থান হবে না।
নিমাই :
আমি দোজবরে বলে কি তোমার মনে কোনোরূপ দুঃখ আছে?
বিষ্ণুপ্রিয়া :
(অশ্রু ছল ছল কণ্ঠে) তোমার পায়ে পড়ি, তুমি অমন কথা বোলো না, ও-কথা শুনলেও পাপ হয়। আমি তোমার এই পা ছুঁয়ে বলছি–তোমার মুখে শোনবার আগে ও-কথা আমার স্বপ্নেও মনে হয়নি। তুমি কেন এ কথা বললে বলো! ও-কথা মনে আসবার আগে যেন আমার মরণ হয় – মরণ হয় –
নিমাই :
ওকী! এই সামান্য কথায় এমন করে কাঁদতে আছে? তুমি এত কষ্ট পাবে জানলে আমি কখনই এ-কথা বলতাম না। আমি এমনি রহস্য করে বললাম মাত্র, আর অমনি মানিনীর মানে আঘাত লাগল। আচ্ছা,আর একটি কথার উত্তর দাও দেখি। বিয়ের আগে তুমি আমায় ভালোবেসেছিলে?
বিষ্ণুপ্রিয়া :
যাও! কে তোমাকে এ কথা বললে? তুমি সকলের অন্তর্যামী কিনা।
নিমাই :
নিশ্চয়ই। আমি যখন স্বামী অর্থাৎ কিনা নারায়ণ, কাজেই অন্তর্যামীও। নইলে তোমার অন্তরের কথা কী করে জানলাম?
বিষ্ণুপ্রিয়া :
তুমি কিছু জান না। জানলে বিয়ের আগে অমন করে কাঁদতে না।
নিমাই :
ও! তোমার সঙ্গে বিয়ের আগে একবার সম্বন্ধ ভাঙে ভাঙে হয়েছিল, সেই কথা বলছ বুঝি? তাতে কিন্তু আমার কোনো দোষ ছিল না। আমাকে না জানিয়েই মা কাশী মিশ্রকে পাঠিয়ে ছিলেন সম্বন্ধ ঠিক করতে। তাই তোমাদের গণক ঠাকুরকে বলেছিলাম, আমি বিয়ের কিছু জানিনে। কিন্তু তারপর আমি তো আবার লুকিয়ে লোক পাঠিয়েছিলাম বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করতে।
বিষ্ণুপ্রিয়া :
সে তোমার দয়া। সবাই বলে, তুমি করুণাময়। নইলে আমার কী দশা হত তাই ভাবি।
নিমাই :
তাহলে তোমারও দশা পাবার অবস্থা হয়েছিল বলো। তাই তো বলি, রোজ রোজ গঙ্গার ঘাটে আমার মাকে তোমার এত ঘটা করে প্রণাম করার মানে কী। আর দিনে দশবার করে গঙ্গার ঘাটে আসারই বা হেতু কী?
বিষ্ণুপ্রিয়া :
তুমি পণ্ডিত মানুষ, ন্যায়শাস্ত্রবিদ, তাই ধোঁয়া দেখলেই সেখানে আগুনের সন্দেহ কর। আমার বয়ে গেছিল তোমাকে দেখতে যাবার জন্য। আমি যেতুম মাকে দেখতে।
নিমাই :
কিন্তু মা তো থাকতেন তোমার ঘাটেই, তুমি হাঁ করে আমি যে ঘাটে সাঁতার কাটতাম সেদিকে চেয়ে থাকতে কেন?