পুরুষ :
শ্রীগৌরাঙ্গ (নিমাই), শ্রী নিত্যানন্দ, শ্রীঅদ্বৈত, শ্রীবাস, মুকুন্দ, গদাধর, ঈশান, সনাতন মিশ্র, চন্দ্রশেখর আচার্য, যাদব, বুদ্ধিমন্ত।
স্ত্রী :
শ্রীবিষ্ণুপ্রিয়া, শচীমতা, সর্বজয়া, মালিনী, সীতাদেবী, কাঞ্চনা, অমিতা, নদীয়া নাগরীগণ, কুল-ললনাগণ।
প্রথম দৃশ্য
(শ্রীগৌরাঙ্গ-বিষ্ণুপ্রিয়ার বিবাহ-বাসর। সবেমাত্র কন্যা সম্প্রদান হইয়া গিয়াছে। বিপুল জনগণের (কন্যাপক্ষ ও বরপক্ষের) মুহুর্মুহু আনন্দ-ধ্বনির সহিত অজস্র যন্ত্রের মধুর সংগীত ও বাদ্যধ্বনি শুনা যাইতেছে। হুলু ও শঙ্খধ্বনির যেন বিরাম নাই।)
জনৈকা কন্যাপক্ষীয় দাসী :
বর কনেকে এখন বাসর-ঘরে নিয়ে এসো না গো! কন্যা সম্প্রদান তো কখন হয়ে গেছে। ওদের ছাদনাতলায় ধরে রেখে যেন সব ঠাকুর দেখছেন।
বরপক্ষীয় জনৈক লোক :
হ্যাঁ গো ঠাকরুন! আমরা ঠাকুরই দেখছি, এই যুগল-মিলন তো তোমরা মেয়ের দল সারারাত ধরে প্রাণ ভরে দেখবে আর আমরা বেচারা পুরুষের দল বাইরে বসে কড়িকাঠ গুনব।
অন্য আর একজন :
বেঁচে থাক দাদা। জোর বলেছিস। যুগল-মিলনের এই গোলোক- ধামে ঠাকুর এক-চোখোমি করতে পারবে না। আর করলেও আমরা তা মানব কেন। আধাআধি বখরা করো – রাজি আছি। অর্ধেক রাত আমরা দেখব – অর্ধেক রাত তোমাদের ছেড়ে দেব।
অন্য আর একজন বরপক্ষীয় লোক :
হেরে গেছে! হেরে গেছে। আমাদের বর বড়ো – বর বড়ো!
কন্যাপক্ষীয় দুইজন :
কক্খনো না, কনে বড়ো। এই আমরা তুলে ধরলাম কনেকে।
বরপক্ষীয় দুইজন :
পিঁড়ি যতই উঁচু কর না দাদা, আমাদের বরের নাগাল পাচ্ছ না-পুরো পাঁচ হাত লম্বা বর।
যাদব :
কাকিমা মানা করছেন, তোমরা দিদিকে এত উঁচুতে তুলো না, দিদি পড়ে যাবে।
কন্যাপক্ষীয় দাসী :
ওগো, মা ঠাকরুনরা বলছেন, তোমাদের বরই বড়ো। এখন ওদের বাসর-ঘরে আনতে ছেড়ে দাও।
বরপক্ষীয় লোক :
হেরে গেছে! কনে হেরে গেছে! দুয়ো! দুয়ো!
যাদব :
(মুখ ভ্যাঙচাইয়া) হেঁরেঁ গেঁছেঁ। হেঁরেঁ গেঁছেঁ। কখ্খনো না, দিদি বড়ো, জামাইবাবু ছোটো!
বরপক্ষীয় লোক :
তোমরা যতই চ্যাঁচাও, আমরা যুগল-মিলনের গান না গেয়ে ছাড়ছিনে। কনেকে বরের বাম-পাশে দাঁড় করাও, আমরা দেখি, যুগল-মিলনের গান গাই তারপর, – না কি বল বুদ্ধিমন্ত!
বুদ্ধিমন্ত :
নিশ্চয়! তাহলে মুকুন্দ তুমিই গানটা গাও আর আমরা ধুয়া ধরি।
(মুকুন্দের গান)
একী অপরূপ যুগলমিলন হেরিনু নদিয়া-ধামে
বিষ্ণুপ্রিয়া লক্ষ্মী যেন রে গোলোক-পতির বামে॥
একী অতুলন যুগল-মুরতি
যেন শিব-সতী হর-পার্বতী
জনক-দুহিতা সীতা দেবী যেন বেড়িয়া রয়েছে রামে॥
গৌরের বামে গৌর-মোহিনী
(যেন) রতি ও মদন চন্দ্র-রোহিণী
(তোরা) দেখে যারে আজ মিলন-রাসে
যুগল রাধা শ্যামে॥
(হুলুধ্বনি, শঙ্খধ্বনি, উভয়পক্ষীয় লোকের আনন্দ-চিৎকার, মধুর বাদ্যধ্বনি ইত্যাদি)
দ্বিতীয় দৃশ্য
বাসর ঘর
(বাসর-ঘরে নদিয়া নাগরীগণ ও কুলমহিলাগণের হুলুধ্বনি, শঙ্খধ্বনি, কলগুঞ্জন, বলয়-কিঙ্কিণির সুমধুর ঝংকার।)
জনৈক মহিলা :
মাগো মা অনেক বিয়েও দেখেছি, বরযাত্রীও দেখেছি, কিন্তু এমন আদেখ্লে বরযাত্রী আর দেখিনি। ওরাই তো আদ্ধেক রাত্তির করে দিলে, তার ওপর বর-কনের খাওয়া-দাওয়া নিয়ে গেল ঘণ্টাখানেক।
অন্য একজন মহিলা :
যা বলেছ দিদি, সব রস ওরাই নিংড়ে নিল ওদের কেঠো হাত দিয়ে। আমাদের দিল ছিবড়ে চিবুতে।
পূর্ব মহিলা :
নে লো নে,বাকি যেটুকু রাত আছে তাও হট্টগোল করে কাটিয়ে দিসনে। নাও, জামাইয়ের বামে একবার কনেকে নিয়ে বসাও দেখি। আহা, কি মানিয়েছে-ওলো তোরা দেখ, একবার নয়ন ভরে দেখ। সোনার গৌরের পাশে সোনার পিত্তিমে। বিয়ের এত আলো যেন এদের রূপের কাছে মিটমিট করছে।
অন্য একজন পুরস্ত্রী :
কী গো বর মশাই ? আজ যে বড়ো জিভ উলটে নিম্নমুখো হয়ে বসে আছ। তোমার চঞ্চলতায় নাকি সারা নবদ্বীপ কম্পমান, তোমার দাপটে নাকি গঙ্গার স্রোতে কাদা উঠে, আর আজ আমাদের সখীকে দেখে একেবারে গুটিসুটি মেরে বসে আছ। ভয় হচ্ছে নাকি?
নিমাই :
আজ বাসর-ঘরে আপনারই কর্ণধারিণী। আমার দেহ-তরির মাত্র দুটি কর্ণ, আর তা দেখে আপনাদের শত কর্ণধারিণীর দুশো হাত উসখুস করছে; তাই ভয় হচ্ছে – তরি আমার ভরা-ডুবি না হয়।
জনৈক মহিলা :
ওলো, চঞ্চলের মুখ খুলেছে। সাবধান! ভালো করে সব কর্ণ ধরিস, পাশে রয়েছে বিষ্ণুপ্রিয়া জোয়ারের টানের মতো। তাই বুঝি ওঁর ভরসা যে, আমাদের হাত থেকে কর্ণ ছাড়িয়ে চলে যাবেন।
জনৈক কিশোরী :
এই চঞ্চল আমাদের কম জ্বালিয়েছে, ভাই। গঙ্গায় এঁর জ্বালায় সোয়াস্তিতে নাইবার উপায় ছিল না। দল বেঁধে সাঁতরে গঙ্গাজলকে যেন দধি-কাদা করত। কখন যে কলশি নিয়ে মাঝগঙ্গায় ভাসিয়ে দিত, মেয়েদের কাপড় নিয়ে পুরুষদের ঘাটে, পুরুষদের কাপড় নিয়ে মেয়েদের ঘাটে রেখে আসত, আমরা টেরও পেতাম না। তারপর কুমীর হয়ে ডুব-সাঁতার দিয়ে পায়ে ধরে টান। আমরা কিছু ভুলিনি, আজ কড়ায়-গণ্ডায় তার শোধ নেব। বুঝলে চঞ্চল পণ্ডিত?
নিমাই :
আমায় পণ্ডিত বলে গালাগালি করছেন কেন? তার চেয়ে কঠিন করাঘাত ঢের মিষ্টি। যে চুরি করতে ভয় পায় না, শাস্তি নিতেও তার ভয় নেই।
অমিতা :
তুই এমন এলিয়ে পড়েছিস কেন লা বিষ্ণুপ্রিয়া? ক্লান্ত যদি হয়ে থাকিস বরের গায়ে হেলান দিয়ে বস না!
বিষ্ণুপ্রিয়া :
(চুপিচুপি) ভাই অমিতা! আমার কিছু ভালো লাগছে না। বাসর-ঘরে আসবার সময় কেমন যেন অজ্ঞানের মতো এলিয়ে পড়েছিলাম।
অমিতা :
তা তো পড়বিই। এত সুন্দর বর পেলে সবাই মুর্ছে যায়।
বিষ্ণুপ্রিয়া :
যাঃ! শুনবে যে! না ভাই শোন–সেই সময় হোঁচট খেয়ে আমার আঙুল দিয়ে রক্ত পড়তে থাকে।
অমিতা :
মাগো! কীহবে! এ কী অলুক্ষণে কথা গো!
দু-একজন মহিলা :
কী রে, কী হল অমিতা! কী বলছিস তোরা।
বিষ্ণুপ্রিয়া :
চুপ! চুপ! বলিসনে কাউকে।
অমিতা :
কিচ্ছু না। এমনি। তোমরা চোরের শাস্তি দিচ্ছ দাও না। হ্যাঁ তারপর? কী করলি তুই?
বিষ্ণুপ্রিয়া :
আমি বোধ হয় উহ্ করে উঠেছিলাম। অমনি উনি ওঁর ডান পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে আমার পায়ে আঙুল চেপে ধরলেন। অমনি রক্ত পড়া বন্ধ হয়ে গেল। বেদনাও আর রইল না। তবু কেন যেন আমার বুক কাঁপছে ভাই ভয়ে।
বিধুমুখী :
কী হয়েছে মা! তোমার মুখ চোখ অমন ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে কেন?
বিষ্ণুপ্রিয়া :
কিচ্ছু না, কাকিমা। সত্যি,কিছু হয়নি।
অমিতা :
সারাদিন উপোস করেছে, তারপর খেয়েই এই হট্টগোল। তুমি যাও কাকিমা, আমরা আছি। বেশি ক্লান্ত হলে ওকে আমরা শুইয়ে দেব।
একজন মহিলা :
ইস্! শুইয়ে দিলেই হল আর কী। আমরা বুঝি যুগল-মিলন দেখব না। ছাদনাতলায় শুভদৃষ্টির সময় যেমন হেসে দুজন চোখ চাওয়া-চাওয়ি করেছিলে, তেমনি করে আর একবার চাও, নইলে ছাড়ছিনে।
নিমাই :
তা যত ইচ্ছে চিমটি কাটুন, ও অপকর্ম এত লোকের সামনে করতে পারব না।
উক্ত মহিলা :
কী! অমন সুন্দর মুখের দিকে চাওয়া বুঝি অপকর্ম। লুকিয়ে লুকিয়ে এর মধ্যে তো একশোবার দেখে নিলে, আমাদের চোখ তোমাদের চোখের মতো ডাগর না হলেও দেখতে পাই।
নিমাই :
তাহলে আবার ধরা পড়ে গেছি। চোরের আবার শাস্তি চলুক।
জনৈক তরুণী :
এবার শাস্তি হাত দিয়ে নয়, কথা দিয়ে।
অন্য একজন তরুণী :
শুধু কথার বাণ নয় লো, তাতে সুরের বিষ মিশিয়ে।
নিমাই :
প্রমীলার দেশে যখন এসে পড়েছি তখন আর উপায় তো নেই। আঁখি বাণ সহ্য করেও যদি বেঁচে থাকতে পারি, বাক্যবাণও বোধ হয় সইবে।
জনৈক তরুণী :
তাহলে বীর প্রস্তুত হও।