দ্বাদশ খণ্ড
(বিসকি গ্রাম – বিদ্যাপতির ভবন – দেবীদুর্গা মন্দির)
[বিদ্যাপতির গীত]
হে নিঠুর তোমাতে নাই আশার আলো।
তাই কি তোমার রূপ কৃষ্ণ কালো?
তুমি ত্রিভঙ্গ তাই তোমার সকলই বাঁকা,
চোখে তব কাজলের ছলনা মাখা।
নিষাদের হাতে বাঁশি সেজেছে ভালো॥
বিজয়া।
দাদা! তোমার দুটি পায়ে পড়ি, উঠে একটু কিছু মুখে দাও। আজ সাত দিন ধরে নিরম্বু উপবাস করে মায়ের মন্দিরে হত্যা দিয়ে পড়ে আছ, তুমি যোগী ভক্ত – তুমি সব পার কিন্তু আমি যে আর পারিনে, দাদা!
বিদ্যাপতি।
এই সাত দিন কি তুইও কিছু খাসনি, বিজয়া?
বিজয়া।
না।
বিজয়া।
দাদা। মায়ের প্রসাদ এনেছি, তাই একটু খাও।
বিদ্যাপতি।
বিজয়া! আজ আমার উপবাসের সপ্তমী, কাল অষ্টমী – সেই মহাষ্টমীতে মায়ের পায়ে আত্মবলিদান দিয়ে মায়ের হাতে প্রসাদ গ্রহণ করব। তুই এখন যা।
(বিজয়ার প্রস্থান)
বিদ্যাপতি।
মা যোগমায়া! পাষাণী! আর আমায় কত পরীক্ষা করবি মা! আমার যারা প্রাণের প্রিয়তম তাদের হরণ করে তাদের আর আমার মাঝে চিরবিচ্ছেদের যবনিকা টেনে দিলি। আমায় নিয়ে এ কী খেলা খেলছিস মা?
যোগমায়া।
পুত্র বিদ্যাপতি! ওঠো প্রসাদ গ্রহণ করো। এই সাত দিন ধরে তোমার সাথে আমিও উপবাসী!
বিদ্যাপতি।
না আমি আহার গ্রহণ করব না – যতদিন না জানতে পারি কোন অভিশাপে আমার এই শাস্তি?
যোগমায়া।
শোনো পুত্র। তোমরা সকলেই ছিলে গোলোকধামের অধিবাসী, মহাবিষ্ণুর লীলা সহচর-সহচরী। তোমরা ধরণিতে নিষ্কাম প্রেম প্রচারের করভিক্ষা করেছিলে শ্রীকৃষ্ণের কাছে, তাই পবিত্র প্রেমের ও শ্রীকৃষ্ণের কীর্তনের জন্য ধরাধামে অবতীর্ণ হয়েছ। তোমাদের যাবার সময় হল, বৎস। তোমাদের দেহে মনে ধরণির যে ধূলি লেগেছে তা ধুয়ে দেবেন স্বয়ং দেবী ভাগীরথী। তুমি এখনই যাও গঙ্গার পথে, সেই পথে শ্রীকৃষ্ণ-বিরহ কৃষ্ণ-ফণী রূপে তোমায় দংশন করবে। তার পর হবে তোমাদের চির-মিলন, মৃত্যুকে পুরোহিত করে গঙ্গার পবিত্র বক্ষে।
ত্রয়োদশ খণ্ড
[গঙ্গাবক্ষে ঝড়বৃষ্টি]
বিদ্যাপতি।
কে? কে তুমি চলেছ আমার আগে আগে দীপ জ্বালিয়ে পথ দেখিয়ে?
অনুরাধা।
ঠাকুর, আমি অনুরাধা!
বিদ্যাপতি।
অনুরাধা! অনুরাধা! নিয়ে চলো, নিয়ে চলো আমায়! এই ঝড়বৃষ্টি? কৃষ্ণরাতের মধ্য দিয়ে সেইখানে, যেখানে আছে অনন্ত প্রেম, অনন্ত ক্রন্দন, অনন্ত অতৃপ্তি।
অনুরাধা।
এসো কবি! এসো সাধক! এই অশান্ত কৃষ্ণ-নিশীথিনীর পরপারেই পাবে অশান্ত কিশোর চির-বিরহী শ্রীকৃষ্ণকে।
বিদ্যাপতি।
অনুরাধা! দাঁড়াও দাঁড়াও! কে যেন আমার পা জড়িয়ে ধরেছে! উঃ! রাধা! রাধা! আমায় কৃষ্ণসর্পে দংশন করেছে, জ্বলে গেল, বিষে আমার সকল দেহ জ্বলে গেল, জ্বলে গেল।
অনুরাধা।
ঠাকুর! ঠাকুর! দেখেছ ওই কৃষ্ণসর্পের মাথায় কী অপূর্ব মণি জ্বলছে। ও কৃষ্ণসর্প নয় ঠাকুর, তোমায় দংশন করেছে কৃষ্ণ-বিরহ! ওই বিরহ-ফণী যাকে দংশন করে তার মুক্তির আর বিলম্ব থাকে না।
বিদ্যাপতি।
অনুরাধা! অনুরাধা! কোথায় গেল অনুরাধা! চলে গেছে। আমি যাব! আবার গঙ্গার পথেই যাব। যতক্ষণ শেষ নিশ্বাস থাকে আমার ততক্ষণ ছুটব পতিতপাবনীকে স্মরণ করে! মাগো! পতিতপাবনী ভাগীরথী! আমি তোর কোলের আশায় এত পথ ছুটে এলাম, তবু তোর কোলে আমার এই পাপ-তাপিত বিষ-জর্জরিত দেহ রাখতে পারলাম না, মা। অঙ্গ আমার অবশ হয়ে এল, আর চলতে পারি না, মা! মাকে ডেকে মৃত্যু উপেক্ষা করে সন্তান এল এতদূর পথ, আর তুই এইটুকু পথ আসতে পারবি না মা ভক্ত ছেলের ডাকে? মা! মাগো!
গঙ্গা।
বিদ্যাপতি!
বিদ্যাপতি।
এ কী – মকরবাহিনী কলুষনাশিনী মাগো – তবে কি সন্তানের অন্তিম প্রার্থনা শুনেছিস মা! আঃ! আমার প্রাণ-মন-দেহ জুড়িয়ে গেল মা, তোর মাতৃকরস্পর্শে।
গঙ্গা।
বিদ্যাপতি, আমি এসেছি তোমাদের নিয়ে যেতে, তোমাদের আপন গেহে, নন্দনলোকে। ওই তোমার লছমী অনুরাধার সাথে আসছে – বৎস, তোমাদের লীলা শেষ, কার্য শেষ। শ্রীকৃষ্ণের লীলা-সাথী – তোমরা যুগে যুগে আস, ফিরে চলো বৎস তাঁর প্রেমময় কোলে।
[অনুরাধার গীত]
সজনী আজু শমন দিন হয়।
চতুর্দশ খণ্ড
[অনুরাধার গীত]
সজনী আজু শমন দিন হয়।
নব নব জলধর চৌদিকে ঝাঁজিল
প্রাণ দেহে নাহি রয়॥
বরষিছে পুনঃপুনঃ অগ্নিদাহন যেন
জানিনু জীবন লয়।
[বিদ্যাপতির গীত]
বিদ্যাপতি কহে শুন শুন লছমী
মরণে মিলন মধুময়॥
লছমী।
কে? বিদ্যাপতি?
বিদ্যাপতি।
লছমী? তুমি?
অনুরাধা।
হ্যাঁ, ঠাকুর! আমি নিয়ে এসেছি তোমার জীবন-মরণের সাথি লছমীকে। পবিত্র সুরধনী-ধারায় স্নাত হয়ে তোমরা উভয়ে হলে নির্মল, তাই তো মা পতিতপাবনীর কোলে হল তোমাদের চিরমিলন।
[গীত]
শেষ হল মোর কাজ, হে কিশোর! আমারে লহো এবার।
লছমী।
অনুরাধা! সখী! কোথায় চলছিস তুই? তুই কি আমাদের ছেড়ে এমনি দূরে দূরেই ভেসে যাবি।
অনুরাধা।
লছমী! সখী! আমি যেন জন্মে জন্মে কালস্রোতে ভেসে এমনই যুগল মিলন দেখে মরতে পারি।
[গীত]
তোমার যাহাতে সুখ তাহে আমার সুখ
সুন্দর মাধব হমার!
কোটি জনম যেন তুহার সুখের লাগি
ডারি দেই এ জীবন ছার॥
বিলাতি ঘোড়ার বাচ্চা
স্বামী : অ গিন্নী! বলি ও গ্যাদারের মা! আরে হুনছনি? চিঁহি চিঁহি, চিঁহি চিঁহি, চিঁহি।
স্ত্রী : গ্যাদাইয়্যা রে। ছুইট্যা আয়রে, ছুইট্যা আয়। আরে ঘরে ঘোড়া ঢুকছে! হেই, হেই।
স্বামী : আরে, আরে – ঘোড়া না, ঘোড়া না। আরে আমি, আমি। তা দেখ, হে হে! আজক্যা বাড়িতে আসনের সময় দুইটা টাকা দিয়া একটা লটারির টিকিট কিনছি।
স্ত্রী : কী কও? লেখার চিঠি? লেখার চিঠি কিইন্যা দুইটা টাকা জলে দিছ?
স্বামী : না রে আমার পোড়া কপাল! আরে লেখার চিঠি না, লটারির টিকিট! বিলাতের ময়দানে ঘোড়দৌড় হইব। এই টিকিটের যেই ঘোড়া, হেয় যদি ফাস্ট হয় তবে আমি পঞ্চাশ হাজার টাকা পামু।
স্ত্রী : পঞ্চাশ হাজার টাকা?
স্বামী : হ্যাঁ।
স্ত্রী : কয় দশে পঞ্চাশ হাজার টাকা হয় গো? আর ঘোড়া ফাস্ট হইব? অ! বিলাতের ঘোড়া বুঝি ইস্কুলে পড়ে?
স্বামী : আ আমার পোড়া কপাল। আরে ঘোড়ায় ইস্কুলে পড়ব ক্যান? দৌড় দিয়া যদি আমার ঘোড়া হগগলের আগে যায় তবেই হেই ঘোড়া ফাস্ট হইব।
স্ত্রী : ও সে জানি বুঝলাম; তা তোমার ঘোড়া ফাস্ট হইব কেমন কইরা, তুমি রইলা এই দ্যাশে, ঘোড়া রইল বিলাতে – অরে খেদাইয়া লইয়া যাইব কেডা?
স্বামী : আ আমার পোড়া কপাল। আরে হেই দেশে সাহেব ঘোড়ার সব সাহেব সহিস আছে, হেরাই ঘোড়া খেদাইয়া লইয়া যাইব। দেখো, আজকে অফিসে বইসা বইসা একটা ঘোড়া-পূজার গান লিখছি। শোনবা, শোনবা নাকি? তা শোনো। দেখো, এই প্রথমে গাই ঘোড়া-পূজার মন্ত্র, দেখো :
ওঁ নমস্তে শ্রী বিলাতি অশ্ব সায়েব হর্স নমোনমঃ চতুষ্পদ একপুচ্ছ শৃঙ্গহীন জীব আদর্শ সায়েব হর্স নমোনমঃ॥ অ্যাই, আরে পঙ্খিরাজের বাচ্চা আমার ঘোড়া ছুইট্যা যাও। ক্যাতরাইয়া দুই চক্ষুরে ঘোড়া ছ্যাতরাইয়া তাজ পাও॥ স্বর্গপানে ল্যাজ উঠাইয়া, (ছোট) চিঁহি চুঁহু চিঁহি চুঁহু ডাইক্যা আমরা দুজন রাত্র জাগুম ছোলা ভিজাইয়া রাইখ্যা (রে) ফাস্ট যদি না হও ঘোড়া, (তোমার) ঘোড়ানীর মাথা খাও (হালা) পট পটাইয়া খাও॥
স্ত্রী : দেখো, ঘোড়ার টাকা পাইলে আমি একশো ভরি সোনা দিয়া গহনা গড়ামু।
স্বামী : কী কও? না, না তা হইব না, তা হইব না। আগে আমি জমি কিনুম, জায়গা কিনুম, বাড়ি করুম, ঘর করুম, তারপর সব।
স্ত্রী : কিছুতেই না, আমি যদি একবাপের বিটি হই, তবে আমার গয়না আগে হইব। তারপর অন্য কিছু।
স্বামী : কিছুতেই না, কিছুতেই না। আমি যদি এক বাপের ব্যাটা হই তবে এক লাঠি দিয়া তোমার মাথা ভাইঙ্গা…..
স্ত্রী : অ! আর একটা বউ ঘরে আনবা, না? এই তোমার লেখার চিঠি রইল আমার আঁচলে বান্ধা – ওরে উনানে দিয়া পুড়াইয়া ছাইভস্ম কইর্যা দুই পা দিয়া মাড়াইয়া……
স্বামী : দেখো, দেখো, দেখো – ভালো হইব না, ভালো হইব না। টিকিট দাও, টিকিট দাও, শিগগির টিকিট দাও।
স্ত্রী : মা গো! বাবা গো! গেছি গো! ওগো কে কোথায় আছ গো! দৌড় দিয়া আহ গো! ওগো মাইর্যা ফেলাইল গো। ওরে, গ্যাদাইরা রে, ছুইট্যা আয় রে, ছুইট্যা আয়। ওরে তোর বাপেরে বিলাতি ঘোড়ার ভূতে পাইছে রে, বিলাতি ঘোড়ার ভূতে পাইছে।
স্বামী : কেডা রে? কেডা রে? বাইরে কান্দে কেডা পোলারে।
একটি বাচ্চা ছেলে : আমি। আমি বিলাতি ঘোড়ার বাচ্চা – গ্যাদাইরা।
স্বামী : ও? ঘোড়ার বাচ্চা!
বিষ্ণুপ্রিয়া
চরিত্র