[বিদ্যাপতির গীত]
আজু রজনী হাম ভাগে পোহায়লুঁ
মহারাজ! আজ আমি গান শোনাতে এসেছি। আজ আমার গানের বাঁধ, প্রাণের বাঁধ, সুরের বাঁধ ভেঙে গেছে।
রাজা।
এসো এসো বন্ধু, এসো বিদ্যাপতি!
নবম খণ্ড
[রাজ-উদ্যান]
রাজা।
এত আনন্দ তোমার কোনোদিন দেখিনি বিদ্যাপতি। আজ তিন দিন ধরে তুমি ছিলে বাণীহীন মূক। হঠাৎ আজ ভোরে হয়ে উঠলে আনন্দিত-কন্ঠ, সংগীত-মুখর। তোমার এত কবি-প্রেরণা এল কোথা থেকে, বন্ধু!
বিদ্যাপতি।
তা জানি না মহারাজ। আমার প্রাণ শুনাতে চায় গান। নিখিল জগৎকে আজ সে গানে গানে পাগল করে দিতে চায়, ডুবিয়ে দিতে চায়। ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চায়। আজ আর তোমার আদেশের অপেক্ষা রাখব না রাজা, আজ গান গাইব স্বেচ্ছায়।
[বিদ্যাপতির গীত]
আজু রজনী হাম ভাগে পোহায়লুঁ
পেখলুঁ পিয়া-মুখ-চন্দা।
জীবন যৌবন সফল করি মানলুঁ
দশ দিশি ভেল নিরদ্বন্দ্বা
আজু মঝু গেহ গেহ করি মানলুঁ
আজু মঝু দেহ ভেল দেহা।
আজু বিধি মোহে অনুকূল হোয়ল
টুটল সবহুঁ সন্দেহা॥
রাজা।
অপূর্ব! সাধু, কবি, সাধু! তুমি শুধু রানির কণ্ঠহার পেয়েছিলে, আজ তোমায় রাজার কণ্ঠহার দিয়ে ধন্য হলাম। লজ্জিত হোয়ো না কবি, লজ্জিত হোয়ো না বন্ধু, তোমার বুকের তলে লুকানো থাকে রানির দেওয়া কণ্ঠহার, সে কথা আর কেউ না জানলেও আমি জানি। এই রাজ-উদ্যানে এত ভোরে তুমি আমি ছাড়া আর কেউ নেই বন্ধু। আর অন্তরালে যদি কেউ থাকে তিনি তোমার অনাত্মীয়া নন। বিদ্যাপতি, অন্তরিক্ষের দেবী চোখের সম্মুখে এসে আবির্ভূতা না হলে মানুষের কণ্ঠে এমন গান আসে না। দেবীর দয়া, বন্ধু, এ দেবীর দয়া!
বিদ্যাপতি।
মহারাজ! কি আমায় বিদ্রুপ করছেন? তা করুন তবু আমার আজকের আনন্দকে মলিন করতে পারবেন না। এ আনন্দ এই শুভ প্রভাতের মতোই অমলিন।
রাজা।
তা জানি বলেই তোমায় শ্রদ্ধা করে আজও বন্ধু বলেই সম্ভাষণ করি, বিদ্যাপতি! শোনো বন্ধু আজ থেকে আমার রাজ্যে তুমি পরিচিত হবে ‘কবি-কণ্ঠহার’ নামে।
ধনঞ্জয়।
মহারাজ, আজকের এই আনন্দটা কি সত্যিকার?
দশম খণ্ড
বিদ্যাপতি।
তুমি তা বুঝবে না ধনঞ্জয়। যে প্রদীপ তিলে তিলে পুড়ে বুকের সমস্ত স্নেহরসকে জ্বালিয়ে অপরকে দান করে আলো, সেই প্রদীপ ধনঞ্জয়, মাত্র সেই প্রদীপই জানে এই আত্মদানের, আপনাকে নিঃশেষে বিলিয়ে দেওয়ার, কী অপার আনন্দ!
রাজা।
ঠিক বলেছ কবি। আরতির প্রদীপ নিববার আগে যেমন করে শেষবার তার উজ্জ্বলতম শিখা মেলে দেবতার মুখ দেখে নিতে চায়, তেমনি করে আমার অন্তর-দেবতা শ্রীকৃষ্ণের মুখ দেখে নিতে চাইছে আমার শ্রান্ত প্রাণশিখা। তুমি এমন গান শুনাতে পার কবি, যা আমার অন্তিম সময়ে শুনতে ইচ্ছা করবে?
ধনঞ্জয়।
মহারাজ এইবার কিন্তু অরসিকের মতো কথা আরম্ভ হল এবং কাজেই আমাকে সরে পড়তে হল। (প্রস্থান)
রাজা।
ধনঞ্জয়! ধনঞ্জয়! চলে গেছে? আঃ বাঁচলাম! বিদ্যাপতি, আমায় একটু ধরো, এখানে উঠে এলাম কী করে জানি না; আর বোধ হয় এখানে থেকে উঠে যেতেও পারব না।
বিদ্যাপতি।
তুমি অমন করছ কেন সখা? তোমার কি কোনো অসুখ করেছে?
রাজা।
সখা। প্রেমের বৃন্দাবনে আমরা– আমি তুমি লছমী অনুরাধা, জন্ম জন্ম ধরে লীলা-সহচর-সহচরী। সেই প্রেমলোকের গান যেদিন তুমি শুনালে সেদিন আমার মনে পড়ে গেল আমার বিস্তৃত জন্মের কথা, মনে পড়ে গেল প্রেমলোকনাথ শ্রীকৃষ্ণকে। তোমার গানের মন্ত্রে আমি উপাসনা করতে লাগলাম রাধা-শ্যামের যুগল মূর্তি। আমি আমার উপাস্য দেবতাকে পেয়েছি, তাই তাঁর বিরহ আর সহ্য করতে পাচ্ছি না, বন্ধু। আমি যে আমার কানুর বাঁশরি শুনতে পেয়েছি।
বিদ্যাপতি।
রাজা?
রাজা।
তুমি ঠকে গেলে, বন্ধু। তুমি গড়লে তরণি আর আমি তাই চুরি করে গেলাম বৈতরণি পেরিয়ে। বিদ্যাপতি, তুমি কাঁদছ? কেঁদো না সখা! তুমিও আসবে দু-দিন পরে আমাদের চিরলীলা-নিকেতনে, বৈকুণ্ঠধামে। জানো বিদ্যাপতি, কাল সারারাত আমি ঘুমোইনি আমার প্রিয়তম শ্রীকৃষ্ণকে ডেকেছি আর কেঁদেছি। আজ ভোরে সেই অশান্তের আহ্বান ভেসে এল কানে। সে আমায় ডাকছে, ওরে আয় আয়; আমার প্রিয়, আমার বুকে চলে আয়। রানি বলছিলেন রাজবৈদ্যকে খবর দিতে, এমন সময় এলে তুমি ভবরোগের বৈদ্য।
একাদশ খণ্ড
রাজা।
তুমি এখন গাও সখা আমার মাধবের নাম গান।
[বিদ্যাপতির গীত]
মাধব! বহুত মিনতি করি তোয়।
দেই তুলসী তিল দেহ সমর্পলুঁ
দয়া জনু ছোড়বি মোয়।
গনইতে দোষ গুণ- লেশ না পাওবি
যব তুঁহুঁ করবি বিচার,
তুঁহু জগন্নাথ জগতে কহায়সি
জগ-বাহির নহি মুই ছার!
ভণয়ে বিদ্যাপতি অতিশয় কাতর
তরইতে ইহ ভবসিন্ধু
তুয়া পদ-পল্লব করি অবলম্বন
তিল এক দেহ দীনবন্ধু॥
রাজা।
আহা! আবার বলো, সখা, আবার বলো!
মাধব! তরইতে ইহ ভবসিন্ধু
তুয়া পদ-পল্লব করি অবলম্বন
তিল এক দেহ দীনবন্ধু! দীনবন্ধু –
আঃ আমার মাথা কার কোলে?
রানি।
রাজা! আমি দাসী, লছমী।
রাজা।
লছমী! ওঃ! কে কাঁদে আমার পায়ে পড়ে?
অনুরাধা।
রাজা! আমি – আমি অনুরাধা। সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ বিষ্ণু উপাসক পরম প্রেমিক তুমি, আমায় পায়ের ধুলো দিয়ে যাও। আমি এ চরণ-ধূলির প্রসাদ মুক্ত হয়ে যাই!
রাজা।
অনুরাধা! অনুরাধা – অনুরাধা কী মধুর নাম। এই তো আমার বৃন্দাবন। বিদ্যাপতি নারায়ণ, লছমী, অনুরাধা, শ্রীকৃষ্ণ নাম গান এরই মাঝে যেন জন্মে জন্মে আমি শ্রীকৃষ্ণ-মাধব – (মৃত্যু)
বিদ্যাপতি।
অনুরাধা!
লছমী।
রাজা! রাজা!