সপ্তম খণ্ড
[বিদ্যাপতির গৃহের পুষ্পোদ্যান]
অনুরাধা।
ঠাকুর আজ দু-দিন থেকে তোমার মুখে হাসি নাই, চোখে দীপ্তি নাই, কণ্ঠে গান নাই। কী হয়েছে তোমার?
বিদ্যাপতি।
কেন তুমি ছলনা করছ, অনুরাধা? তুমি তো সবই জান। আজ দু-দিন ধরে রাজসভায় আমার লঞ্ছনার আর সীমা নেই। এই দু-দিন রাজাকে একটি নূতন পদও শুনাতে পারিনি। আর তাই নিয়ে শত্রুপক্ষ আমায় বিদ্রুপবাণে জর্জরিত করেছে।
অনুরাধা।
হা হরি! এই দু-দিনে একটা গানও লিখতে পারলে না তোমার সুরের ঝরনা হঠাৎ এমন শুকিয়ে গেল কেন?
বিদ্যাপতি।
তুমি তো জান রাধা, আমার কাব্যের প্রেরণা সুরের প্রাণ সবই লছমী দেবী। যেদিন তার উপস্থিতি অনুভব না করি সেদিন আমার দুর্দিন। সেদিন আমার কাব্যলোকে সুরলোকে দেখা দেয় দুর্ভিক্ষ।
অনুরাধা।
আচ্ছা ঠাকুর, তুমি তো রানিকে একটুও দেখতে পাও না, তবু কী করে বুঝতে পার যে রানি রাজসভায় এসেছেন? রানি কি কোনো ইঙ্গিত করেন?
বিদ্যাপতি।
না না অনুরাধা! লছমী তো ইঙ্গিতময়ী রূপে কোনোদিন দেখা দেননি আমায়, তিনি আমার অন্তরে আবির্ভূতা হন সঙ্গীতময়ী রূপে। তাঁর আবির্ভাব অনুভব করি আমি আমার অন্তর দিয়ে। যেদিন রানি রাজসভায় আসেন, সেদিন অকারণ পুলকে আমার সকল দেহ-মন বীণার মতো বেজে ওঠে। শত গানের শতদল ফুটে ওঠে আমার প্রাণে। আমি তখন আবিষ্টের মতো গান করি। সে আমার আত্মার গান – ও গান পরমাত্মারূপী শ্রীকৃষ্ণের গান।
অনুরাধা।
ঠাকুর আমার প্রণাম নাও। তোমার পা ছুঁয়ে আমি ধন্য হলাম। আমি কাল ভোরেই তোমাকে দেখাব তোমার কবিতা-লক্ষ্মীকে।
বিদ্যাপতি।
পারবে? পারবে তুমি, অনুরাধা?
অনুরাধা।
উতলা হোয়ো না ঠাকুর। তোমার মনস্কামনা পূর্ণ হবে। আমি দূতী আমার অসাধ্য কিছু নেই।
বিদ্যাপতি।
অনুরাধা! তুমি হয়তো মনে করছ, আমি কী ঘোর স্বার্থপর পাষণ্ড না?
অনুরাধা।
নিশ্চয়ই। পাষাণ না হলে ঠাকুর হবে কী করে? শুধু নেবে দিতে জানবে না, মাথা খুঁড়ে মরলেও থাকবে অটল, তবে তো হবে দেবতা! তবেই না পাবে পূজা!
বিদ্যাপতি।
অনুরাধা! আমি যদি তোমার প্রেমের এক বিন্দুও পেতাম তা হলে আজ আমি জগতের শ্রেষ্ঠ কবি হতে পারতাম।
অনুরাধা।
না ঠাকুর, তা হলে তুমি হতে আমারই মতো উন্মাদ। সকলের আকাঙ্ক্ষা সমান নয় ঠাকুর, কেউ বা পেয়ে হয় খুশি আর কেউ বা খুশি হয় না-পেয়ে।
বিদ্যাপতি।
তোমার প্রেমই প্রেম অনুরাধা, যা পায়ে শৃঙ্খলের মতো জড়িয়ে থাকে না, যে প্রেম দেয় অনন্তলোকে অনন্ত মুক্তি।
অনুরাধা।
অত শত ঘোর প্যাঁচের কথা বুঝিনে ঠাকুর। আমি ভালোবেসে কাঁদতে চাই, তাই কাঁদি। বুকে পেলে কান্না যাবে ফুরিয়ে, প্রেম যাবে শুকিয়ে, তাই পেতে চাইনে। বুকের ধনকে বিলিয়ে দিই অন্যকে। আমি চললাম ঠাকুর। আমি চললাম। আমি কাল সকালে তোমার কবিতা-লক্ষ্মীকে দেখাব।
অষ্টম খণ্ড
(রাজ-অন্তঃপুর)
[অনুরাধার গীত]
এ ধনি কর অবধান,
তোমা বিনা উনমত কান।
(কানু পাগল হল গো। তোমারে না হেরি কানু পাগল হল গো)
লছমী।
কানু পাগল হল না তুই পাগল হলি রাধা?
[অনুরাধার গীত]
শুন শুন গুণবতী রাধে,
মাধবে বাঁধিয়া তুই কী সাধিবি সাধে?
(তুই কোন সাধ সাধিবি? মাধবে বাঁধিয়া তুই কোন্ সাধ সাধিবি?)
লছমী।
সতিনকে কাঁদব! বুঝলি?
[অনুরাধার গীত]
এতহুঁ নিবেদন করি তোরে সুন্দরী
জানি ইহা করহ বিধান।
হৃদয়-পুতলি তুহুঁ সে শূন্য কলেবর,
তুহুঁ বিদ্যাপতি-প্রাণ॥
লছমী।
আ-মল! বিদ্যাপতি, বিদ্যাপতি বলে ছুঁড়ি যে নিজেই পাগল হলি! বিদ্যাপতির বিদ্যাটুকু বাদ দিয়ে তার ঘর জুড়ে বসলেই তো পারিস।
অনুরাধা।
তা হলে তোমার কী দশা হবে সখী?
লছমী।
এক কৃষ্ণকে নিয়ে ষোলো হাজার গোপিনী যদি সুখী হতে পারে, আমরা দু-জন আর সুখী হতে পারব না কেন?
অনুরাধা।
সেই প্রেমময়ী গোপিনীদের চরণে কোটি কোটি প্রণাম করি ভাই, আমরা তাঁদের পায়ের ধূলি হবারও যোগ্য নই।
লছমী।
সে কথা থাক। অনুরাধা, আর একটা কথা জানতে বড়ো সাধ হয়। তিনি কি একবারও তোকে আমার কথা জিজ্ঞাসা করেন না?
অনুরাধা।
আধবারও না।
লছমী।
না ভাই লক্ষ্মীটি, লুকোসনে। মহারাজার আদেশে আমি আজ দু-দিন রাজসভায় যেতে পাইনি। তাঁকে একবারও দেখতে পাইনি, তাঁর গান শুনিনি। মনে হচ্ছে, যেন কত জন্ম তাঁকে দেখিনি।
অনুরাধা।
আচ্ছা ভাই, তুই যদি আজ ভোরে ঠিক এইখানে এই মাধবীকুঞ্জে তাঁকে দেখতে পাস, তা হলে কী করিস?
লছমী।
আমি গিয়ে তাঁর বামে দাঁড়াই, আর তুই মিলনের পালা গান গাস।
রাজা।
রানি!
অনুরাধা।
আসি আসি, সখী, মহারাজ আসছেন।
রাজা।
যেয়ো না যেয়ো না, অনুরাধা।
লছমী।
রাজা, তোমায় এত ক্লান্ত দেখাচ্ছে কেন? তোমার চোখে মুখে যেন রক্ত নেই।
রাজা।
ঠিক মৃতের মতো না, রানি? না, ওটা তোমার চোখের ভুল। রানি আমার একটা কথা রাখবে?
লছমী।
বলো?
রাজা।
আমাকে কাল ভোরেই চলে যেতে হবে, চলে যেতে হবে দূরে বহু দূরে আমার রাজ্যের সীমান্ত পেরিয়ে। রানি আমি যখন থাকব না, তখন যেন আমার প্রিয় সখা বিদ্যাপতির কোনো অযত্ন না হয়।
লছমী।
আমি বুঝতে পারছি রাজা, তুমি অসুস্থ। তুমি একটু চুপ করে শোও, তোমার সেবা করার কর্তব্য থেকে আমায় বঞ্চিত কোরো না।
রাজা।
কর্তব্য! সেবা! বেশ তাই করো রানি! তাই করো! লোকে যা চায়, ভগবান তাকে তার সব কিছু দেন না। এই বঞ্চিত করেই তিনি টেনে নেন সেই হতভাগ্যকে তাঁর শান্তিময় কোলে। রানি যাকে ভালোবাসার কেউ নেই সে যদি ভগবানেরও চরণে আশ্রয় না পায়, তার মতো দুর্ভাগা বুঝি আর কেউ নেই।