[ অনুরাধার গীত ]
ধন্য ধন্য ধন্য রমণী জনম তোর।
সব জন কানু কানু করে ঝুরে
সে কানু তোর ভাবে বিভোর।
[উদ্যান-অন্তরালে বিদ্যাপতি ও শিবসিংহ]
রাজা।
বিদ্যাপতি! বিদ্যাপতি! দেখেছ? ওদের দু-জনের মুখে গোধূলির আলো পড়ে ঠিক বিয়ের কনের মতো সুন্দর দেখাচ্ছে! বিদ্যাপতি! বিদ্যাপতি! আরে? তুমি যে নির্বাক নিস্পন্দ হয়ে গেলে! বিদ্যাপতি!
[বিদ্যাপতির গীত]
অপরূপ পেখলুঁ বামা।
কনকলতা অবলম্বনে উঠল
হরিণীহীন হিমধামা॥
(একী অপরূপ রূপ-ফাঁদ!)
(স্বর্ণলতিকা ধরি উঠিয়াছে যেন ওই কলঙ্কহীন এক চাঁদ)
নলিন নয়ান দুটি অঞ্জনে রঞ্জিত
এ কী ভুরু ভঙ্গি-বিলাস
চকিত চকোর জোড় বিধি যেন বাঁধিল
দিয়া কালো কাজরপাশ!
গুরু গিরিবর পয়োধর পরশিছে
গ্রীবার গজমোতি হারা,
কাম-কম্বু ভরি কনক-কুম্ভ পরি
ঢালে যেন সুরধুনী-ধারা।
পঞ্চম খণ্ড
[বিদ্যাপতির ভবন]
বিদ্যাপতি।
বিজয়া!
বিজয়া।
দাদা! ডাকচ?
বিদ্যাপতি।
হ্যাঁ, অনুরাধা কোথায় রে?
বিজয়া।
কী জানি। সে কি বাড়ি থাকে? সকাল হতে না হতে রানির যানবাহন এসে ওকে নিয়ে যায়। ও মাঝে মাঝে পালিয়ে আসে আমার কাছে, আর অমনি সাথে সাথে আসে রানির চেড়িদল। রানির অনুগ্রহ ওকে গ্রহের মতো গ্রাস করেছে। আবার রানির নাকি হুকুম হয়েছে এখন থেকে রাত্রেও তাঁর কাছে থাকতে হবে। এ কিন্তু রানির অত্যাচার দাদা। হয় তুমি এর প্রতিকার করো, নইলে আমিই রাজার কাছে আবেদন করব।
বিদ্যাপতি।
হুঁ! হ্যাঁরে বিজয়া, সেদিন অনুরাধা বলছিল, ওর বিয়ে হয়ে গেছে। সত্যই কি ওর বিয়ে হয়েছিল?
বিজয়া।
(সক্রোধে) আমি জানি না। আচ্ছা দাদা, তুমি কবি, সাধক। তুমি তো মানুষের অন্তরের অন্তঃস্থল পর্যন্ত দেখতে পাও। অনুরাধার দিকে কখনও চোখ ফিরিয়ে দেখেছ কি?
বিদ্যাপতি।
তা দেখিনি। কিন্তু ভুল তো তুইও করে থাকতে পারিস, বিজয়া। ওর স্বামীই যদি কেউ থাকেনই, সে এ পৃথিবীর মানুষ নয়, ওর স্বামী গিরিধারীলাল শ্রীকৃষ্ণ।
বিজয়া।
হ্যাঁগো হ্যাঁ, ওই নামের ছল করে ও যাকে পূজা করে আমি তাকে জানি। তুমি ইচ্ছা-অন্ধ, তাই দেখতে পাও না।
[অনুরাধার গীত]
সখী লো মন্দ প্রেম পরিণামা।
বিজয়া।
ওই যে হতভাগিনি আসছে।
বিদ্যাপতি।
তুই ওকে একবার আমার কাছে পাঠিয়ে দে তো!
বিজয়া।
দিচ্ছি দাদা!
বিদ্যাপতি।
আমায় এ কী পরীক্ষায় ফেললে, ঠাকুর!
অনুরাধা।
আমায় ডাকছিলে, ঠাকুর!
বিদ্যাপতি।
হাঁ রাধা! রানি কি তোমার রাত্রেও তাঁর কাছে থাকতে আদেশ করেছেন?
অনুরাধা।
হ্যাঁ, রানি বলেন দূতীর দূতিয়ালির প্রয়োজন রাত্রেই হয় বেশি। তবে এ তাঁর আদেশ নয়, আবদার।
বিদ্যাপতি।
দূতী! কীসের দূতিয়ালি রাধা?
অনুরাধা।
ঠাকুর! তুমি আমায় কী মনে কর? পাগল, নির্বোধ বা ওরকম একটা কিছু, না? তুমি যে এত যত্ন করে রোজ তোমার নব-রচিত গানগুলি শেখাও, তুমি কি মনে কর আমি তার মানে বুঝিনে? আর আমি কি শুধু রানিরই দূতিয়ালি করি? আমি কি লেখার গানেরও দূতিয়ালি করিনে?
বিদ্যাপতি।
আমি তোমার কাছে আর আত্মগোপন করব না, রাধা। সত্যই তোমার সুরের সেতু বেয়ে হয় আমাদের মিলন! তবে তুমি তো জান আমার এ প্রেম নিষ্কলুষ, নিষ্কাম। তোমায় একটা কথা জিজ্ঞাসা করব?
অনুরাধা।
বলো।
বিদ্যাপতি।
তুমি কি সত্যিই আামায় ভালোবাস?
অনুরাধা।
না।
বিদ্যাপতি।
তুমি আমায় বাঁচালে, অনুরাধা!
অনুরাধা।
তোমায় আমি ভালোবাসিনে। কিন্তু আমি ভালোবাসি তাকে যাকে তুমি ভালোবাস। ঠাকুর! ঠাকুর! আমাকে এই বর দাও যেন জন্মে জন্মে তোমার ভালোবাসার জনকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতে পারি; তুমি যাকে ভালোবেসে সুখ পাও, তারই দাসী হতে পারি। আর দিনান্তে একবার শুধু ওই চরণ বন্দনা করতে পারি।
ষষ্ঠ খণ্ড
[রাজগৃহ]
রাজা।
আমার মুখের দিকে অমন হাঁ করে চেয়ে কী দেখছ, ধনঞ্জয়?
ধনঞ্জয়।
ভয় নেই মহারাজ! ভয় নেই! আপনিও মেঘ নন, আর আমিও চাতক পক্ষী নই। মহারাজ যদি অভয় দেন, তা হলেই একটা কথা জিজ্ঞাসা করি।
রাজা।
বলো কী বলতে চাও।
ধনঞ্জয়।
আমি বলছিলাম, মহারাজ, বৃন্দাবনের আয়ান ঘোষের সঙ্গে কি আপনার কোনো কুটুম্বিতা ছিল?
রাজা।
তার মানে?
ধনঞ্জয়।
তার মানে আর কিছু নয় মহারাজ, চেহারা তো দেখিনি, তবে তার বুদ্ধির সঙ্গে আপনার বুদ্ধির অদ্ভুত সাদৃশ্য আছে।
রাজা।
ধনঞ্জয়!
ধনঞ্জয়।
দোহাই মহারাজ! আমার মাথা কাটা যাক তাতে দুঃখ নেই, কিন্তু আপনার অ-রসিক বলে বদমান রটলে লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাবে।
রাজা।
বটে! আচ্ছা বলো কী বলছিলে!
ধনঞ্জয়।
আমি বলছিলাম মহারাজ, আপনার ওই প্রধানমন্ত্রী বিদ্যাপতির কথা। তিনি ছিলেন দুর্গা-উপাসক, ঘোর শাক্ত, হলেন পরম বৈষ্ণব। কৃষ্ণভক্ত। ছিলেন রাজমন্ত্রী, কঠোর রাজনীতিক, হলেন কবি কান্ত-কোমল প্রেমিক।
রাজা।
তাতে তোমার কী ক্ষতি বৃদ্ধি হল ধনঞ্জয়?
ধনঞ্জয়।
কিছু না মহারাজ! ক্ষতি বৃদ্ধি যা হবার তা হচ্ছে রাজার আর তার রাজ্যের। এ ক্ষতিও হচ্ছিল এতদিন গোপনে, তাকেও আবার দিনের আলোয় টেনে আনলে বিন্দে দূতী।
রাজা।
বিন্দে দূতী? সে আবার কে?
ধনঞ্জয়।
আজ্ঞে ওই হল! আপনারা যাকে বলেন অনুরাধা, আমাদের মতো দুর্জন, তাকেই বলে বিন্দে দূতী!
রাজা।
অর্থাৎ সহজ ভাষায় তোমার কথার অর্থ এই যে, কবি বিদ্যাপতি হচ্ছেন নন্দলাল, আমি হচ্ছি আয়ান ঘোষ আর শ্রীমতী হচ্ছেন – !
ধনঞ্জয়।
দোহাই মহারাজ! মাথা আর ঘাড়ের সন্ধিস্থলে বিচ্ছেদের ভয় যতক্ষণ আছে ততক্ষণ ও পাপ কথা কোন সাহসে উচ্চারণ করি মহারাজ!
রাজা।
ধনঞ্জয়! আয়ান ঘোষের গোপবুদ্ধি আর তোমাদের রাজার ক্ষাত্রবুদ্ধিতে যথেষ্ট প্রভেদ আছে! তোমরা কী বোঝ জানি না, আমি কিন্তু সব শুনি, সব দেখি, সবই বুঝি।
ধনঞ্জয়।
মহারাজ পরম উদার। আপনার ধনবল জনবলও অপরিমাণ; তবু মহারাজ, জটিলা কুটিলার মুখ বন্ধ করতে তা কী যথেষ্ট?
রাজা।
দেখো ধনঞ্জয়, চোর যতক্ষণ ঘরের আশে পাশে ঘোরে ততক্ষণ জাগ্রত বলবান গৃহস্থ তাকে ভয় করে না। হ্যাঁ তবে তাকে লক্ষ রাখতে হয় যে ঘরে সিঁধ না কাটে! যাক তুমি কি আর কিছু লক্ষ করেছ?
ধনঞ্জয়।
আজ্ঞে তা মিথ্যে বলতে পারব না। মহারানি প্রত্যহ রাজসভায় এসে চিকের আড়াল টেনে বসেন হয়তো রাজকার্য দেখতেই এবং সে চিক গলিয়ে একটা চামচিকেরও যাবার উপায় নেই। তবু বিদ্যাপতির ওই পর্দামুখী আসনটা অনেকেরই চক্ষুশূল স্বরূপ হয়ে উঠেছে।
রাজা।
ধনঞ্জয়, আমি লক্ষ রেখেছি বলেই ওদের মাঝের পর্দাটুকু আজও অপসারিত হয় নি। তোমরা নিশ্চিন্ত থেকো আর তোমাদের সকলকে জানিয়ে দিয়ো যে, ওদের চেয়ে আমার দৃষ্টির পরিসর অনেক বেশি। ওরা দেখে শুধু রাজসভা আর রাজ-অন্তঃপুর, আর আমাকে দেখতে হয় সমগ্র রাজ্য।
ধনঞ্জয়।
আচ্ছা মহারাজ! তারই পরীক্ষা হোক।
রাজা।
কী পরীক্ষা করতে বলো তুমি?
ধনঞ্জয়।
আমি বলি কি কোনোরকমে দিন কতকের জন্য রানিকে আটকে রাখুন। তিনি যেন রাজসভায় না আসেন। তারপর রানির অবর্তমানে বিদ্যাপতিকে কিছু নতুন পদ রচনা করে গাইতে বলুন। মহারাজ আপনার অনুগ্রহে প্রধানমন্ত্রী হয়ে উঠেছেন প্রধান গায়ক আর রাজসভা হয়ে দাঁড়িয়েছে বাবাজির আখড়া। মহারাজ, দাসের অপরাধ নেবেন না।
রাজা।
তোমার ইঙ্গিত বুঝেছি। আচ্ছা ধনঞ্জয়, তাই হবে।
ধনঞ্জয়।
যাবার বেলায় একটা কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে যাই, মহারাজ! একদা শ্যাম বনে গিয়ে শ্যামা রূপ ধারণ করে আয়ান ঘোষের চোখে ধুলো দিয়েছিলেন।
রাজা।
আমার চোখের পর্দা আছে ধনঞ্জয়, এ চোখে কেউ ধুলো দিতে পারবে না।