দ্বিতীয় খণ্ড
[মিথিলার রাজা শিবসিংহের উদ্যানবাটিকা]
বিদ্যাপতি।
মিথিলার রাজা শিবসিংহের জয় হোক।
শিবসিংহ।
স্বাগত বিদ্যাপতি। বন্ধু! তোমার মাতৃশোক ভুলবার যথেষ্ট অবসর না দিয়ে স্বার্থপরের মতো রাজধানীতে ডেকে এনেছি। আমার অপরাধ নিয়ো না সখা।
বিদ্যাপতি।
মহারাজ! আমি আপনার দাসানুদাস। শুধু আমি কেন, আমরা পুরুষানুক্রমে মিথিলার রাজ-অনুগ্রহ ও আশ্রয়ের স্নিগ্ধ শীতল ছায়ায় লালিত পালিত। আপনার আদেশ আমার সকল দুঃখের ঊর্ধ্বে, মহারাজ!
রাজা।
তুমি জান সখা, রাজসভার বাইরে তুমি ওভাবে কথা বললে আমি কত বেদনা পাই! আমরা সহপাঠী বন্ধু, তোমরা তো রাজ অনুগৃহীত নও, বন্ধু, মিথিলার রাজারাই তোমাদের কাছে ঋণী, অনুগৃহীত। তোমরা পুরুষানুক্রমে প্রধানমন্ত্রী হয়ে মিথিলার রাজা ও রাজ্যকে নিয়ন্ত্রিত করেছ।
রানি লছমী।
তুমি তো শুধু রাজমন্ত্রীই নও, বিদ্যাপতি। তুমি রাজকবি। মিথিলা তথা ভারতের শ্রেষ্ঠ কবি।
বিদ্যাপতি।
মহারানি এখানে আছেন তা তো বল নাই, সখা?
রাজা।
রানি লছমী দেবীর অনুরোধেই তোমায় এত তাড়া দিয়ে এনেছি, বন্ধু! তোমার কণ্ঠের গান না শুনলে ওঁর সে দিনটাই নাকি হয় বৃথা। এত শ্রদ্ধা তোমার ওপর, তবু মাঝের ওই পর্দাটুকু আর উঠল না। এ নিরর্থক লজ্জার আবরণ আমাকেই লজ্জা দেয় বেশি। আর কথা নয় কবি, এবার আলাপন হোক শুধু গানে গানে।
বিদ্যাপতি।
মহারানির আদেশ শিরোধার্য। কোন গান গাইব দেবী?
রানী।
আমার সেই প্রিয় গান ‘জনম জনম হাম রূপ নেহারলুঁ’ ও গানটা আমার কাছে কখনও পুরানো হল না!
[বিদ্যাপতির গীত]
জনম অবধি হাম রূপ নেহারলুঁ নয়ন ন তিরপিত ভেল।
লাখ লাখ যুগ হিয় হিয় রাখলুঁ, তবু হিয় জুড়ন ন গেল!
দেখি সাধ না ফুরায় গো,
রূপ যত দেখি তত কাঁদি সাধ না ফুরায় গো
হিয়া কেন না জুড়ায় গো, হিয়ার উপরে গিয়া
হিয়া তবু না জুড়ায় গো।
তৃতীয় খণ্ড
[অনুরাধার গীত]
সখী লো!
অব মথুরাপুর মাধব গেল।
গোকুল মানিক কো হরি লেল,
হরি হরিয়া নিল কে?
লছমী।
রাজা! কে যায় পথে অমন করুণ সুরে গান গেয়ে? ওকে এখানে ডাক না!
বিদ্যাপতি।
মহারানি। আমি ওকে জানি। আমি যেখানে যাই, ও আপনি এসে হয় আমার প্রতিবেশিনী। ওর নাম অনুরাধা, গিরিধারীলাল শ্রীকৃষ্ণ ওর জপমালা।
লছমী।
তাহলে তুমি ওকে ডেকে আনো না, কবি।
বিদ্যাপতি।
আমি যাচ্ছি দেবী কিন্তু জানি না ও আসে কি না?
[অনুরাধার গীত]
নয়নক নিন্দ গেও বয়ানক হাস,
সুখ গেও পিয়া সঙ্গ দুখ হম পাশ,
পাপ পরান মম আন নাহি জানত
কানু কানু করি ঝুরে।
লছমী।
অনুরাধা! কী মিষ্টি নাম তোমার! তুমি আমার কাছে থাকবে? বিদ্যাপতি! তুমি যদি অনুমতি দাও তা হলে অনুরাধাকে আমার কাছে রেখে শ্যাম-নাম শুনি!
বিদ্যাপতি।
আমি তো ওর অভিভাবক নই, দেবী। ও আমার ছোটো বোন বিজয়ার বন্ধু।
লছমী।
ওর বাপ মা কোথায় থাকেন?
বিদ্যাপতি।
গতবার দেশে যখন মড়ক লাগে তখন ওর বাপ মা দু-জনেই মারা যান।
লছমী।
ওর বিয়ে হয়নি?
বিদ্যাপতি।
না!(হাসিয়া) ও বলে ও বিয়ে করবে না।
অনুরাধা।
বা রে, আমি বুঝি তোমার গলা ধরে বলতে গেছিলুম যে আমি বিয়ে করব না। না মহারানি, ঠাকুর জানেন না। আমার বিয়ে হয়েছে।
বিদ্যাপতি।
তোমার বিয়ে হয়েছে? কার সাথে?
অনুরাধা।
সে তুমি জান না, বিজয়া জানে।
লছমী।
আমিও হয়তো জানি! তুমি থাকবে ভাই আমার কাছে, আমার সখী হয়ে আমার বোন হয়ে? আর বদলে আমি তোমার বরকে ধরে এনে দেব।
অনুরাধা।
তা কি প্রাণ ধরে দিতে পারবে রানি? যে ঠাকুর আমার সে যে তোমারও।
বিদ্যাপতি।
মহারাজ! ওঁদের নিভৃত আলাপনের কমল বনে আমাদের উপস্থিতি মত্ত মাতঙ্গের মতোই ভীতিজনক। আমরা একটু অন্তরালে গেলেই বোধ হয় সুশোভন হত।
রাজা।
চলো বিদ্যাপতি, তোমার ইঙ্গিতই সমীচীন।
লছমী।
আর একটি গান গাও না ভাই।
[অনুরাধার গীত]
সজল নয়ন করি পিয়া পথ হেরি হেরি
তিল এক হয় যুগ চারি
(যেন শত যুগ মনে হয়
তারে এক তিলে না হেরিলে শত যুগ মনে হয়)
বিধি বড়ো দারুণ তাহে পুন ঐছন
দরহি করলুঁ মুরারি।
রাজা।
কবি! এইখানে – এই খানে এসো। এই ঝোপের অন্তরাল থেকে ওঁদের দুই দেবীকে দিব্যচক্ষে দর্শন করা যাবে।
বিদ্যাপতি।
মহারাজ! যে নিজে থাকতে চায় গোপন তাকে জোর করে প্রকাশ করার বর্বরতা আমার নেই।
রাজা।
আঃ! কবি হয়ে তুমি কি করে এমন বেরসিক হলে বলো তো? ওই দেবীর দল যখন চিকের আড়াল থেকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমাদের দেখতে থাকেন, তাতে কোনো অপরাধ হয় না, আর আমরা একটু আড়াল আবডাল থেকে উঁকিঝুঁকি মেরে দেখলেই মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে?
চতুর্থ খণ্ড
লছমী।
অনুরাধা! তোমার কবিকে দিয়ো আমার এই কণ্ঠহার।
অনুরাধা।
বেশ! তা হলে আজ আমি আসি, রানি!
লছমী।
রানি নয়, রানি নয়, অনুরাধা, লছমী। তুমি আমায় লছমী বলে ডেকো। রানির কারাগারে আমার ডাক-নামের হয়েছিল মৃত্যু, তোমার বরে সে নাম আবার বেঁচে উঠুক।
অনুরাধা।
লছমী! লছমী! তুমি সত্যই লছমী। রূপে লছমী, গুণে লছমী, গোলোকের অধীশ্বরী লক্ষ্মী।
লছমী।
আর তুমি? তুমি বুঝি ব্রজের দূতী?
অনুরাধা।
হ্যাঁগো তোমার দূতিয়ালিই করব, এই চাকরিই আমি নিলাম, সখী! তোমার কণ্ঠহার যথাস্থানে দেব তুমি নিশ্চিন্ত থেকো।