[গান]
জনম অবধি হাম রূপ নেহারলুঁ, নয়ন ন তিরপিত ভেল।
লাখ লাখ যুগ হিয় হিয় রাখলুঁ, তবু হিয় জুড়ন ন গেল!
দেখি সাধ না ফুরায় গো!
হিয়া কেন না জুড়ায় গো
হিয়ার উপরে গিয়া
হিয়া তবু না জুড়ায় গো!
তৃতীয় খণ্ড
[অনুরাধার গীত]
সখী লো –
অব মথুরাপুর মাধব গেল।
গোকুল-মানিক কো হরি লেল॥
(হরি হরিয়া নিল কে)
গোকুলে উছলল করুণাক রোল
নয়নক সলিলে বহয়ে হিলোল।
শূন ভেল মন্দির, শূন ভেল নগরী,
শূন ভেল দশদিশি শূন ভেল সগরী।
কৈছন যাওব যমুনা-তীর
কৈছে নেহারব কুঞ্জ-কুটির।
নয়নক নিন্দ গেও, বয়ানক হাস,
সুখ গেও পিয়া সঙ্গ, দুখ হম পাশ।
পাপ পরান মম আন নাহি জানত
কানু কানু করি ঝুরে।
বিদ্যাপতি কহ নিকরুণ মাধব
রাধারে কাঁদায়ে রহি দূরে॥
রানি :
রাজা! কে যায় পথে অমন করুণ সুরে গান গেয়ে? ওকে এখানে ডাকো না!
বিদ্যাপতি :
মহারানি! আমি ওকে জানি। আমি যেখানে যাই, ও আপনি এসে হয় আমার প্রতিবেশিনী। ওর নাম অনুরাধা। গিরিধারীলাল শ্রীকৃষ্ণ ওর জপমালা।
রানি :
তা হলে তুমিই ওকে ডেকে আনো না, কবি!
বিদ্যাপতি :
আমি যাচ্ছি দেবী, কিন্তু জানি না ও আসবে কি না।
(বিদ্যাপতির প্রস্থান)
রাজা :
রানি! এখন বোধ হয় বুঝতে পেরেছ – বিদ্যাপতি হঠাৎ কেন বিষ্ণু-উপাসক হয়ে উঠল!
রানি :
সত্যিকার ভালো না বাসলে কারুর কণ্ঠ এত মধুময় এত আবেগবিহ্বল হয় না। ও যেন মূর্তিমতী কান্না।
(গান গাহিতে গাহিতে অনুরাধার প্রবেশ)
সজল নয়ন করি পিয়া পথ হেরি হেরি
তিল এক হয় যুগ চারি।
(যেন শত যুগ মনে হয়
তারে এক তিল না হেরিলে শত যুগ মনে হয়)
বিধি বড়ো দারুণ তাহে পুন ঐছন
দরহি করলুঁ মুরারি।
আন অনুরাগে পিয়া আনদেশে গেলা
পিয়া বিনু পাঁজর ঝাঁঝর ভেলা।
নারীর দীরঘশ্বাস পড়ুক তাহার পাশ
মোর পিয়া পাশে উড়ি যাওঁ
সব দুখ কহু তার পাশে।
আনি দেহ মোর পিউ রাখহ আমার জিউ
কো আছ করুণাবান।
বিদ্যাপতি :
বিদ্যাপতি কহে ধৈরজ করো চিত
তুরিতহি মিলব কান॥
রানি :
অনুরাধা, কী মিষ্টি নাম তোমার! তুমি আমার কাছে থাকবে? বিদ্যাপতি! তুমি যদি অনুমতি দাও, অনুরাধাকে আমার কাছে রেখে শ্যাম নাম শুনি।
বিদ্যাপতি :
আমি তো ওর অভিভাবক নই; দেবী! ও আমার ছোটো বোন বিজয়ার বন্ধু।
রানি :
ওর বাবা-মা কোথায় থাকেন?
বিদ্যাপতি :
গতবার দেশে যখন মড়ক লাগে, তখন ওর বাবা-মা দুজনেই মারা যান। যে বিসকি গ্রাম মহারাজ আমায় দান করেছেন, ওর বাবা ছিলেন সেই গ্রামের বিষ্ণু-মন্দিরের পুরোহিত। এখন ওর অভিভাবিকা, বন্ধু – সব বিজয়া।
রানি :
ওর বিয়ে হয়নি?
বিদ্যাপতি :
না। (হাসিয়া) ও বলে বিয়ে করবে না।
অনুরাধা :
বা রে, আমি বুঝি তোমার গলা ধরে বলেছি যে, আমি বিয়ে করব না। না মহারানি, ঠাকুর জানেন না, আমার বিয়ে হয়েছে।
বিদ্যাপতি :
তোমার বিয়ে হয়েছে? কার সাথে?
অনুরাধা :
সে তুমি জান না, বিজয়া জানে।
রানি :
আমিও হয়তো জানি। তুমি থাকবে ভাই আমার কাছে? আমার সখী হয়, আমার বোন হয়ে? আর তার বদলে আমি তোমার বরকে ধরে এনে দেব।
অনুরাধা :
তা কি প্রাণ ধরে দিতে পারবে রানি। যে ঠাকুর আমার, সে যে তোমারও।
বিদ্যাপতি :
মহারাজ! ওদের নিভৃত আলাপনের কমল-বনে আমাদের উপস্থিতি মত্ত মাতঙ্গের মতোই ভীতিজনক। আমরা একটু অন্তরালে গেলেই বোধ হয় সুশোভন হত।
রাজা :
চলো বিদ্যাপতি, তোমার ইঙ্গিতই সমীচীন।
(পশ্চাতে রানির ও অনুরাধার হাসির শব্দ)
কবি! এইখানে এসো! এই ঝোপের আড়াল থেকে ওদের দুই দেবীকে দিব্যচক্ষে দর্শন করা যাবে।
বিদ্যাপতি :
মহারাজ, যে নিজে থাকতে চায় গোপন, তাকে জোর করে প্রকাশের বর্বরতা আমার নেই।
রাজা :
আঃ! কবি হয়ে তুমি কী করে এমন বদরসিক হলে বলো তো? ওই দেবীর দল যখন চিকের আড়াল থেকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমাদের দেখতে থাকেন তাতে কোনো অপরাধ হয় না, আর আমরা একটু আড়াল-আবডাল থেকে উঁকি-ঝুঁকি মেরে দেখলেই মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে? আরে এসো এসো।
চতুর্থ খণ্ড
রানি :
(একটু দূরে) অনুরাধা, তোমার কবিকে দিয়ো আমার এই কণ্ঠহার!
অনুরাধা :
রানি!
রানি :
রানি নয় অনুরাধা, লছমী। তুমি আমায় লছমী বলে ডেকো। রানির কারাগারে আমার ডাক-নামের হয়েছিল মৃত্যু। তোমার বরে সে নাম আমার বেঁচে উঠুক।
অনুরাধা :
লছমী! তুমি সত্যই লছমী। রূপে লছমী, গুণে লছমী, গোলোকের অধীশ্বরী – লক্ষ্মী।
লছমী :
আর তুমি বুঝি ব্রজের দূতী?
অনুরাধা :
বেশ, তোমার দূতিয়ালিই করব। এই চাকরিই আমি মেনে নিলাম। তোমার কণ্ঠহার আমি যথাস্থানে পৌঁছে দেব, নিশ্চিন্ত থেকো।
(অনুরাধার গান)
ধন্য ধন্য ধন্য রমণী ধন্য জনম তোর।
সব জন কানু কানু করে ঝুরে
সে কানু তোর ভাবে বিভোর।
[উদ্যান-অন্তরালে বিদ্যাপতি ও রাজা শিবসিংহ]
রাজা :
বিদ্যাপতি! বিদ্যাপতি! দেখেছ? ওদের দুইজনের মুখে গোধূলির আলো পড়ে ঠিক বিয়ের কনের মতো সুন্দর দেখাচ্ছে। বিদ্যাপতি, বিদ্যাপতি, আরে তুমি যে নির্বাক নিষ্পন্দ হয়ে গেলে!
বিদ্যাপতি :
অপরূপ পেখলুঁ বামা।
কনকলতা অবলম্বনে উঠল
হরিণীহীন হিমধামা॥
[এ কী অপরূপ রূপ-ফাঁদ!
স্বর্ণলতিকা ধরি উঠিয়াছে যেন ওই কলঙ্কহীন এ চাঁদ]
নলিন নয়ান দুটি অঞ্জনে রঞ্জিত
এ কী ভুরু-ভঙ্গিবিলাস,
চকিত চকোর জোড় বিধি যেন বাঁধিল
দিয়া কালো কাজরপাশ।
গুরু গিরিবর পয়োধর পরশিছে
গ্রীবার গজমোতি হারা,
কাম কম্বু ভরি কনক কুম্ভ পরি
ঢালে যেন সুরধুনী-ধারা।
পুণ্য প্রয়াগ-জলে যে করে যজ্ঞ শত
পায় এরে সেই বহুভাগী।
বিদ্যাপতি কহে, গোকুল-নায়ক
গোপীজন-অনুরাগী॥