(স্তব)
জয় জগজ্জননী, ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর-বন্দিতা,
জয় মা ত্রিলোকতারিণী।
জয় আদ্যাশক্তি পরমেশ্বরী নন্দনলোক-নন্দিতা
জয় দুর্গতিহারিণী॥
তোমাতে সর্বজীবের বসতি, সর্বাশ্রয় তুমি মা,
ক্ষয় হয় সব বন্ধন পাপতাপ তব পদ চুমি মা।
তুমি শাশ্বতী, সৃষ্টি-স্থিতি, তুমি মা প্রলয়কারিণী॥
তুমি মা শ্রদ্ধা প্রেমভক্তি তুমি কল্যাণ-সিদ্ধি,
ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষ তুমি তন-জন-ঋদ্ধি।
জয় বরাভয়া ত্রিগুণময়ী দশপ্রহরণধারিণী
জয় মা ত্রিলোকতারিণী॥
অনুরাধা :
ঠাকুর! ঠাকুর!
বিদ্যাপতি :
(মন্দির-অভ্যন্তর হইতে) কে?
অনুরাধা :
আমি অনুরাধা, একটু বাইরে বেরিয়ে আসবে?
বিদ্যাপতি :
(মন্দিরদ্বার খুলিয়া বাহিরে আসিয়া – বিরক্তির সুরে) একটু অপেক্ষা করলেই পারতে অনুরাধা। এত বড়ো ভক্তিমতী হয়ে তুমি মায়ের নামগানে বাধা দিলে?
অনুরাধা :
আমায় ক্ষমা করো ঠাকুর। অত্যন্ত প্রয়োজনে আমি তোমার ধ্যানভঙ্গ করেছি। আমার কৃষ্ণগোপালের জন্য আজ কোথাও ফুল পেলাম না। তোমার বাগানে অনেক ফুল, আমার গিরিধারীলালের জন্য কিছু ফুল নেব? আমার গোপালের এখনও পূজা হয়নি।
বিদ্যাপতি :
তুমি তো জান অনুরাধা, এ বাগানে ফুল ফোটে শুধু আমার মায়ের পায়ে অঞ্জলি দেওয়ার জন্য। এ ফুল তো অন্য কোনো দেবদেবীকে দিতে পারিনে! (মন্দিরদ্বার বন্ধ করিয়া দিলেন; মন্দির-অভ্যন্তরে স্তব-পাঠের মৃদু গুঞ্জন শোনা গেল।)
অনুরাধা :
(অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে) ঠাকুর! ঠাকুর! তুমি কি সত্যই এত নিষ্ঠুর? তবে কি আমার ঠাকুরের পূজা হবে না আজ? আমার কৃষ্ণগোপাল! আমার প্রিয়তম! তুমি যদি সত্য হও আর আমার প্রেম যদি সত্য হয়, তা হলে আজ এই বাগানের একটি ফুলও অন্য কারুর পূজায় লাগবে না। এই বাগানের সকল ফুল তোমার চরণে নিবেদন করে গেলাম।
(প্রস্থান)
বিদ্যাপতি :
(গুনগুন স্বরে)
মা! আমার মনে আমার বনে
ফোটে যত কুসমদল
সে ফুল মাগো তোরই তরে
পূজতে তোরই চরণতল॥
বিজয়া :
দাদা। পূজার ফুল এনেছি। দোর খোলো।
বিদ্যাপতি :
(দ্বার খুলিয়া) দে। বিজয়া, মা এখন কেমন আছেন রে?
বিজয়া :
আমার তো ভালো মনে হচ্ছে না দাদা, কেমন যেন করছেন। আচ্ছা দাদা, অনুরাধা কাঁদতে কাঁদতে গেল কেন? তুমি কেন যেন তাকে দু-চোখে দেখতে পার না।
বিদ্যাপতি :
হাঁ, আমি ওকে এক-চোখোমি করে এক চোখেই দেখি। আমি পুজো সেরেই আসছি। (বিজয়া চলিয়া গেল; বিদ্যাপতি মন্দিরদ্বার বন্ধ করিয়া দিলেন; ভিতর হইতে স্তবপাঠের শব্দ শোনা গেল।)
বিদ্যাপতি :
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ –
[অন্তরিক্ষ হইতে প্রত্যাদেশ]
ক্ষান্ত হও বিদ্যাপতি! ও ফুল শ্রীকৃষ্ণ-চরণে নিবেদিত। বিষ্ণু-আরাধিকা যে ফুল শ্রীহরির চরণে নিবেদন করে গেছে, সে ফুল নেবার অধিকার আমার নেই।
বিদ্যাপতি :
মা! মা! এ তোর মায়া, না সত্য?
দেবীদুর্গা :
শোনো পুত্র! তুমি হয়তো জান না যে, আমি পরমা বৈষ্ণবী। জগৎকে বিষ্ণুভক্তি দান করি আমিই।
বিদ্যাপতি :
তোর ইঙ্গিত বুঝেছি মহামায়া। তবে তোরই ইচ্ছা পূর্ণ হোক ইচ্ছাময়ী। আমি আজ থেকে বিষ্ণুরই আরাধনা করব।
[গান]
আমার শ্যামা মায়ের কোলে চড়ে জপব আমি শ্যামের নাম
মা হল মোর মন্ত্রগুরু, ঠাকুর হলেন রাধাশ্যাম॥
বিজয়া :
(কাঁদিতে কাঁদিতে) দাদা! দাদা! শিগগির এসো। মা আমাদের ছেড়ে স্বর্গে চলে গেলেন।
বিদ্যাপতি :
বিজয়া! বিজয়া! মা নেই, মা চলে গেলেন? (দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া শান্ত স্বরে) হ্যাঁ, – মা তো আমার নেই। আমি এই মুহূর্তে মাতৃহারা হলাম। আমার ভুবনের মা আমার ভবনের মা, দু-জনেই একসঙ্গে ছেড়ে গেলেন।
দ্বিতীয় খণ্ড
[মিথিলার রাজ-অন্তঃপুরের উদ্যানবাটিকা]
বিদ্যাপতি :
মিথিলার রাজা শিবসিংহের জয় হোক!
রাজা শিবসিংহ :
স্বাগত বিদ্যাপতি! বন্ধু! তোমার মাতৃশোক ভুলবার যথেষ্ট অবসর না দিয়ে স্বার্থপরের মতো রাজধানীতে ডেকে এনেছি। আমার অপরাধ নিয়ো না সখা।
বিদ্যাপতি :
মহারাজ! আমি আপনার দাসানুদাস। শুধু আমি কেন, আমরা পুরুষানুক্রমে মিথিলার রাজ-অনুগ্রহে ও আশ্রয়ের স্নিগ্ধ শীতল ছায়ায় লালিত-পালিত। আপনার আদেশ আমার সকল দুঃখের ঊর্ধ্বে।
রাজা :
তুমি জান সখা, রাজসভার বাইরে তুমি ওভাবে কথা বললে আমি কত বেদনা পাই। আমরা সহপাঠী বন্ধু, আমাদের সে বন্ধুত্বকে আড়াল করে দাঁড়িয়েছে এই তুচ্ছ রাজ-সিংহাসন। আর তোমরা তো রাজ-অনুগৃহীত নও বন্ধু, মিথিলার রাজারাই তোমাদের কাছে ঋণী, অনুগৃহীত। তোমরা পুরুষানুক্রমে প্রধানমন্ত্রী হয়ে মিথিলার রাজা ও রাজ্যকে নিয়ন্ত্রিত করেছ।
বিদ্যাপতি :
আমায় ক্ষমা করো সখা। এই রাজসভার বাইরে যখন তোমায় দেখি, তখন ইচ্ছা করে তোমায় আগের মতো করেই বক্ষে জড়িয়ে ধরি। তবু কীসের যেন সংকোচ এসে বাধা দেয়।
রাজা :
বিদ্যাপতি! রাজা ও মন্ত্রীর সম্পর্ক ছাড়াও আমরা আজ বেদনার তীর্থে হয়ে গেছি এক পরমাত্মীয়। তুমি হারিয়েছ তোমার মাকে; আমিও হারিয়েছি আমার দেবতুল্য পিতা দেবসিংহকে।
রানি লছমী :
তুমি তো শুধু রাজমন্ত্রীই নও বিদ্যাপতি। তুমি রাজকবিও। মিথিলা তথা ভারতের শ্রেষ্ঠ কবি!
বিদ্যাপতি :
মহারানি এখানে আছেন, তা তো বল নাই সখা।
রাজা :
রানি লছমী দেবীর অনুরোধেই তোমায় এত তাড়া দিয়ে এনেছি বন্ধু। তোমার কণ্ঠের গান না শুনলে নাকি ওঁর সে-দিনটাই ব্যর্থ। এত শ্রদ্ধা তোমার ওপর, তবু মাঝে ওই পর্দাটুকু উঠল না। ওই নিরর্থক লজ্জার আরবরণ আমাকেই লজ্জা দেয় বেশি।
বিদ্যাপতি :
দেবীরা চিরকাল যবনিকার অন্তরালেই থাকতে ভালোবাসেন, বন্ধু! ওঁরা হলেন অন্তর-লোকের অসূর্যম্পশ্যা, বাইরের আলোর রূঢ়তা ওঁদের জন্য নয়।
রাজা :
তবু যাকে দেখা যায় না, অথচ কথা শুনতে পাওয়া যায় তাকে যে লোক চিরকালই ভয় পেয়ে থাকে বিদ্যাপতি!
রানি লছমী :
তার মানে আমি পেতনি, এই তো! বেশ, আমি তাই। কবি! আর কথা নয়, এবার আলাপন হোক শুধু গানে গানে।
বিদ্যাপতি :
মহারানির আদেশ শিরোধার্য। কোন গান গাইব, দেবী?
রানি :
আমার সেই প্রিয় গান – ‘জনম জনম হাম রূপ নেহারলুঁ, ও গানটা আমার কাছে কখনও পুরানো হল না।
বিদ্যাপতি :