(সকলের প্রস্থান)
ফাল্গুনী :
ছল করি উহাদেরে লয়ে গেল দূরে
চৈতালি তোমায় সখী। কেন নত চোখে
চেয়ে আছ? কথা কও চাহো মুখপানে।
(বাসন্তিকার গান)
অঞ্জলি লহো মোর সংগীতে
প্রদীপ-শিখাসম কাঁপিছে প্রাণ মম
তোমায়, হে সুন্দর বন্দিতে।
সংগীতে সংগীতে॥
তোমার দেবালয়ে কী সুখে কী জানি
দুলে দুলে ওঠে আমার দেহখানি
আরতি নৃত্যের ভঙ্গিতে।
সংগীতে সংগীতে॥
পুলকে বিকশিল প্রেমের শতদল
গন্ধে রূপে রসে টলিছে টলমল।
তোমার মুখে চাহি আমার বাণী যত
লুটাইয়া পড়ে ঝরা ফুলের মতো
তোমার পদতল রঞ্জিতে।
সংগীতে সংগীতে॥
চতুর্থ দৃশ্য
বাসন্তিকা :
কেন ক্লান্ত আঁখি তব? কেন বার বার
চাহিতেছ মোর মুখে? এই তো তোমার
বাহুর বন্ধনে আমি আছি নাথ বাঁধা।
বিষাদিত ছলছল আঁখি হেরি তব
মনে বড়ো ভয় লাগে, আমি বড়ো ভীরু।
আছ মম বুকে, তবু কাঁদে কেন প্রাণ।
ফাল্গুনী : গান
পিয়া পিয়া মোরে ভোলো, ভোলো ভালোবাসা!
হেরো উষার বুকে কাঁদে প্রভাতি তারা
তব বেণির মালা ম্লান, সুরভিহারা
আজি ফুরাল ফাগুন এল যাবার বেলা,
ভাঙে ভুলের মেলা, ভাঙে ফুলের খেলা।
পিয়া পিয়া মোরে ভোলো, ভোলো ভালোবাসা॥
তব মৃণাল-ভুজে আর বেঁধো না মোরে
ভীরু চাঁদের মতো আজও হাসি অধরে
অনুরাগের কাজল আঁকি আঁখির তীরে
চাহি মুখের পানে বোলো, ‘আসিয়ো ফিরে’।
পিয়া পিয়া মোরে ভোলো, ভোলো ভালোবাসা॥
ফিরে আসিবে আবার নব চাঁদের তিথি,
মালা তোমারই গলে দেবে নব অতিথি,
রবে তারই বুকে মোর প্রথম প্রণয়
আজি ফুরাল ফাগুন, এল যাবার সময়!
পিয়া পিয়া মোরে ভোলো, ভোলো ভালোবাসা॥
বাসন্তিকা :
বসন্তের রাজা মোর! হৃদয়ের নাথ!
একী তব অরুন্তুদ অকরুণ গান?
অকারণ কেন মোরে দেখাও এ ভয়?
তুমি কি জান না নাথ, তুমি চলে গেলে
ফুরাইবে রাজ্যে মোর বসন্ত-উৎসব?
ফাল্গুনী :
আমি চিরচঞ্চল পথিক ঘরছাড়া,
বন্ধুহারা, উদাসীন, বিরাগী প্রেমিক।
সাথি মম পঞ্চশর দক্ষিণ সমীর,
ক্ষণিকের পথভোলা পথিক এরাও।
দুদিনের পিককুল মোর অগ্রদূত।
প্রজাপতি অলি – এরা মোর বৈতালিক।
ক্ষণিকের অতিথি যে আমরা সকলে,
কেন ভুলিতেছ প্রিয়া? নাই সাধ্য নাই,
এর বেশি পৃথিবীতে থাকিবার আর।
বসন্ত হয় অবসান, দিগন্তে বিদায়ের বেণু
ওই শোনো বাজি ওঠে সকরুণ রবে।
আমারে যে যেতে হবে। জনমে জনমে
এমনই আসিব কাছে দু-দিনের লাগি,
না মিটিতে সাধ শেষে চলে যেতে হবে!
বিধির বিধান ইহা, যথা ভলোবাসা!
মিলন ক্ষণিক সেথা, অনন্ত বিরহ।
বাসন্তিকা :
যেতে নাহি দিব আমি। তুমি রাজা, বীর,
আমারে বধিয়া যাও তব রাজ্যে ফিরে।
না, না, তব পায়ে পড়ি, থাকো ক্ষণকাল
পরুষ বচন আর কভু শোনাব না।
(গান)
মিনতি রাখো রাখো, পথিক থাকো থাকো
এখনই যেয়ো না গো না না না।
ক্ষণিক অতিথি বিদায়ের গীতি
এখনই গেয়ো না গো, না না না॥
চৈতি পূর্ণিমা চাঁদের তিথি
পুষ্প-পাগল এ বনবীথি
ধুলায় ছেয়ো না গো–না না না॥
বলি বলি করে হয়নি যা বলা,
যে কথা ভরিয়া ছিল বুকের তলা,
সে কথা না শুনে সুন্দর অতিথি হে
যেতে চেয়ো না গো, না না না॥
ফাল্গুনী :
তবু মোরে যেতে হবে! ছিঁড়িবে হৃদয়;
করিতে হইবে তবু ছিন্ন এই ডোর।
ভালোবেসে কাঁদি আমি কাঁদিয়া কাঁদাই
এ মোর আত্মার ধর্ম! হে প্রিয়া বিদায়!
(গান)
বল্লরি ভুজবন্ধন খোলো!
অভিসার-নিশি অবসান হল॥
পাণ্ডুর চাঁদ হেরো অস্তাচলে
জাগিয়া শ্রান্ত তনু পড়েছে ঢলে
মল্লিকা মালা ম্লান বক্ষতলে,
অভিমান-অবনত আঁখি তোলো॥
উতল সমীর আমি নিমিষের ভুল
কুসুম ঝরাই কভু ফোটাই মুকুল।
আলোকে শুকায় মোর প্রেমের শিশির
দিনের বিরহ আমি, মিলন নিশির॥
হে প্রিয় ভীরু এ স্বপন-বিলাসীর
অকরুণ প্রণয় ভোলো ভোলো॥ (প্রস্থান)
বাসন্তিকা :
কোথা তুমি প্রিয়তম ফাল্গুনী কিশোর?
নিশীথের ক্ষণিকের সুখ-স্বপ্নসম
আসিয়া গেলে কি চলি না মিটিতে সাধ?
দূরে ওই ওড়ে যেন বৈশাখী ঝড়ের
বিজয়-কেতন তার। বাসন্তী উৎসব
শেষ হোক আজি তবে। ঝরা ফুলদল,
বিরহের রৌদ্রদাহে মোর বনভূমি
পুড়ে যাক, উড়ে যাক, হোক ছারখার।
যোগিনীর গৈরিক নিশান নীলাম্বরে
এবার উড়ুক তবে। বিস্মৃতির ধূলি
ছেয়ে দিক রাজ্য মোর শস্য পুষ্পময়॥
(গান)
ভোরে স্বপনে কে তুমি দিয়ে দেখা
লুকালে সহসা।
মোর তপনের রাঙা কিরণ যেন
ঘিরিল তমসা॥
না ফুটিতে মোর কথার কুঁড়ি
চপল বুলবুলি গেলে উড়ি
গেলে ভাসিয়া ভোরের সুর যেন
বিষাদ-অলসা॥
জেগে দেখি হায় ঝরা ফুলে আছে ছেয়ে
তোমার পথতল
ওগো অতিথি, কাঁদিছে বনভূমি
ছড়ায়ে ফুলদল।
মুখর আমার গানের পাখি
নীরব হল হায় বারেক ডাকি
যেন ফাগুনের জোছনা-হসিত রাতে
নামিল বরষা॥
[গানের মাঝে উঠল ধূলি-গৈরিক ঝড়, গানের শেষ দিকে ‘বাসন্তিকা’ ও রঙ্গমঞ্চ আর দেখা গেল না। সেই অন্ধকারেই গানের শেষ হল।]
বিদ্যাপতি (পালা – নাটিকা)
চরিত্র :
দেবী দুর্গা, দেবী গঙ্গা, কবি বিদ্যাপতি, শিবসিংহ (মিথিলার রাজা), লছমী (মিথিলার রানি), অনুরাধা (বিষ্ণু-উপাসিকা), বিজয়া (বিদ্যাপতির কনিষ্ঠা ভগ্নী), ধনঞ্জয় (রাজ-বয়স্য)।
প্রথমখণ্ড
কাল – পঞ্চদশ শতাব্দী
[মিথিলার কমলা নদীর তীরে বিসকি গ্রাম। তাহারই উদ্যানবাটিকায় দেবী দুর্গামন্দির। কবি বিদ্যাপতি দুর্গাস্তব গান করিতেছেন।]