বাসন্তিকা :
কী মধুর কণ্ঠ, শোনো, শোনো লো চৈতালি,
শুনিতে দে প্রাণ ভরি, চল অন্তরালে।
দ্বিতীয় দৃশ্য
(গান গাইতে গাইতে ফাল্গুনীর প্রবেশ)
আমার গানের মালা আমি করব কারে দান।
মালার ফুলে জড়িয়ে আছে করুণ অভিমান॥
চোখে মলিন কাজল লেখা
কণ্ঠে কাঁদে কুহুকেকা
কপোলে যার অশ্রু লেখা
একা যাহার প্রাণ।
মালা করব তারে দান॥
কথায় আমার কাঁটার বেদন
মালায় সূচির জ্বালা,
কণ্ঠে দিতে সাহস না পাই
অভিশাপের মালা
এই অভিশাপের মালা।
বিরহে যার প্রেম আরতি
আঁধার লোকের অরুন্ধতী
নাম-না জানা সেই তপতী
তার তরে এই গান।
মালা করব তারে দান॥
চৈতালি :
রহিতে পারি না আর-অন্তরালে,
কন্ঠে মম স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে ওঠে গান।
পত্রাবগুন্ঠনে কুঁড়ি রহিতে কি পারে
ভ্রমর আসিয়া সবে শোনায় গুঞ্জন।
বাসন্তিকা :
চৈতালি! চৈতালি! শোন, শোন মাথা খাস
যাসনে উহার কাছে, ওরে ও চপলা
কী জানি কী কহিবি যে বুঝি মোর নামে,
সত্য-মিথ্যা কত কথা বিদেশির কাছে।
(কুঞ্জান্তরাল হতে গান গাইতে গাইতে চৈতালির প্রবেশ)
বাসন্তিকা :
হৃদয় এমনই সখী, যাহারে সে চায়
তারে সে চিনিতে পারে আঁখির পলকে।
এমনই রহস্যময় পৃথিবীর প্রেম,
যখন সে আসে – আসে সহসা সহজে।
দেখিসনি তুই কি লো, এল সে যেমনই
রাজ্য মোর পূর্ণ হল রাজ-সমারোহে
রাজ্যের ঐশ্বর্য যত ছিল বনভূমে
লুটায়ে পড়িল সব তার পদতলে॥
চৈতালি :
মনের ঐশ্বর্য তব, বনের সে নহে
লুটাইল যাহা সেই পথিকের পায়।
আমি দেখি নাই তার রাজ-সমারোহ,
হয়তো দেখেছ তুমি – এমনই নয়ন!
একের নয়নে যার রূপ সীমাহীন,
অন্যের নয়ন সখী তাহাতে বিরূপ।
বাসন্তিকা :
রাখ সখী, কখা আর ভালো নাহি লাগে।
মনে হয়, চুপ করে বসে শুধু ভাবি।
চৈতালি :
ভাবনার অঙ্কুরেই এত, এ ভাবনা
ক্রমে যবে হবে মহিরুহ সুবিশাল
সহস্র শিকড় দিয়ে বাঁধিবে তোমায়
তখন কী হবে হায়, তাই আমি ভাবি।
ভালো, কথা নাহি কব, তুমিও কোয়ো না।
তার চেয়ে গাহো গান, আমি বসে শুনি।
(বাসন্তিকার গান)
কত জনম যাবে তোমার বিরহে
স্মৃতির জ্বালা পরান দহে॥
শূন্য গেহ মোর শূন্য জীবনে
একা থাকারই ব্যথা কত সহে ওগো॥
দিয়েছি যে জ্বালা জীবন ভরি হায়,
গলি নয়ন-ধারায় ব্যথা বহে॥
তৃতীয় দৃশ্য
পঞ্চশর :
শুনিতেছ, কি মধুর গান আসে ভেসে?
চৈতালি :
তোমাদের রাজার বন্দনা গাহিতেছে
বনলক্ষ্মী। বলিতে কি পার বন্ধু তুমি
কী করিছে রাজা-রানি কুঞ্জে নিরালায়?
দখিন হাওয়া :
আমি যদি চলে যাই এই স্থান ত্যজি
যা করিবে নিরালাতে তোমার দু-জন
তেমনই একটা কিছু। বেশি কিছু নহে।
চৈতালি :
বড়ো লঘু চিত্ত তুমি দক্ষিণের হাওয়া,
ডেকে আনি পুষ্পলতা সখীরে আমার
সমুচিত শাস্তি দেবে, হবে তব সাথি।
শুনিতে হবে না আর তব হা-হুতাশ।
দখিন হাওয়া :
কাজ নাই, তার চেয়ে তুমি গাহো গান,
যে গান শুনিয়া কুঞ্জ-মাঝে রাজা-রানি–
বুঝিতে পারিবে মোরা বেশি দূরে নাই,
উৎসাহ দেবার তরে নিকটেই আছি।
বুঝিতেছি সব কিছু, দেখি না যদিও
উপভোগ করিতেছি মনশ্চক্ষু দিয়ে।
চৈতালি :
তা হলে আমিও গাই উৎসাহের গান।
জ্বালাইলে কবে রানি! হায়, পরিচয়
না হতেই মনে মনে মান অভিমান
পরিচয় ঘন হলে আরও কত হবে!
প্রেমিকা তো নহি, তাই কিছু নাহি বুঝি।
বাসন্তিকা :
আঁখি-বিনিময়ে আঁখি চিনি লয় যারে
পলকে যে জিনি লয় সকল হৃদয়
সে বহু জনমের সাথি, বন্ধু, সখা।
চৈতালি! রহস্য এর তুই বুঝিবি না।
জন্মে জন্মে নব নব রূপে তার সাথে
বিরহ-মিলন, হয় নব জানাজানি।
ব্যথা দিয়ে চলে যায় জন্মান্তর পারে,
একজন চলে যায় – সাথি তার খোঁজে
আসে নব রূপ ধরি তারই পিছু পিছু।
আত্মার আত্মীয় যার সাথি প্রিয়তম
শুধু সেই জানে সখী রহস্য ইহার।
হৃদয় বরিয়া লয় হৃদি-দেবতারে।
(দূরে কোকিলের অবিরল কুহুধ্বনি)
চৈতালি :
ওই বুঝি এল তব হৃদিরাজদূত
মুহুর্মুহু কুহুস্বরে কাঁপায়ে কান্তার।
মর্মরিয়া লতাপাতা দখিনা পবন
সহসা আসিল ওই, উতলা কানন।
সহচর অনুচর দূত এল যবে
রাজাও আসিছে পিছে মনে লাগে মোর।
উষসীর আগমনে বুঝি লো যেমন
তপনের উদয়ের আর নাহি দেরি।
বাসন্তিকা :
চৈতালি! কী হবে তবে? সত্যই সে যদি
এসে পড়ে, হেরে মোরে বিরহ-বিধুরা
কী হবে, এ মুখ সখী কেমনে লুকাই,
তুই বলে দে লো সখী, কী করিব আমি!
প্রণয় মধুর – যত রহে সে গোপন,
প্রকাশের লজ্জা তার অতি নিদারুণ।
লজ্জায় মরিয়া যাব, সে যদি লো বোঝে
ইঙ্গিতেও মোর পোড়া মরমের ব্যথা!
(পঞ্চশর ও চৈতালির গান)
পঞ্চশর :
বন-দেবী এসো গহন বনছায়ে।
চৈতালি :
এসো বসন্তের রাজা নূপুর-মুখর পায়ে॥
পঞ্চশর :
তুমি কুসুম-ফাঁদ
চৈতালি :
তুমি মাধবী চাঁদ
উভয়ে :
আমরা আবেশ ফাল্গুনের
ভাসিয়া চলি স্বপন-নায়ে॥
পঞ্চশর :
কল্পলোকের তুমি রূপরানি লো প্রিয়া
অপাঙ্গে ফোটাও জুঁই চম্পা টগর মোতিয়া।
চৈতালি :
নিঠুর পরশ তব (হায়) যাচিয়া জাগে বনভূমি,
ফুলদল পড়ে ঝরি তব চারুপদ চুমি।
উভয়ে :
(মোরা) সুন্দরের পথ সাজাই
ঝরা কুসুম-দল বিছায়ে॥
দখিন হাওয়া :
তোমরা পরোক্ষে বুঝি এই ছল করি
কয়ে নিলে তোমাদেরও অন্তরের কথা।
চৈতালি :
তুমি বড়ো লঘু, বন্ধু! চলো আলাপন
করি গিয়ে দূরে মোরা কুঞ্জের বাহিরে।