২৮০। যদি ঋণগ্রহণকারী অসুবিধার মধ্যে থাকে, তবে যতদিন না [টাকা] পরিশোধ করা তার জন্য সহজ হয়, তাকে সময় দাও। কিন্তু যদি তোমরা [টাকা] মার্জনা করে দাও, দান হিসেবে, তবে তা হবে তোমাদের জন্য সর্বোত্তম, যদি তোমরা তা জানতে।
২৮১। সেই দিনকে ভয় কর, যেদিন তোমাদের [সবাইকে] আল্লাহ্র নিকট ফিরিয়ে আনা হবে। অতঃপর প্রতিটি আত্মাকে যা সে [পৃথিবীতে] উপার্জন করেছে তার [মূল্য] পরিশোধ করা হবে। এবং কারও প্রতি [এতটুকু] অন্যায় করা হবে না।
রুকু – ৩৯
২৮২। হে মুমিনগণ ! যখন তোমরা নির্ধারিত মেয়াদের জন্য ঋণের ব্যাপারে পরস্পরের মধ্যে চুক্তিবদ্ধ হও, তখন তা লিখে রাখবে ৩২৯। কোন লেখক তা যেন বিশ্বস্তভাবে দু’পক্ষে জন্য লিখে দেয়। লেখক যেনো তা লিখতে অস্বীকার না করে। যেহেতু আল্লাহ্ তাকে [লিখতে] শিখিয়েছেন ৩৩০। সুতরাং সে যেনো লেখে। ঋণ গ্রহীতা যেনো লেখার বিষয়বস্তু বলে দেয় এবং তার প্রভু আল্লাহকে ভয় করে এবং তাঁর ঋণের কিছু যেনো না কমায়। কিন্তু ঋণগ্রহীতা যদি মানসিক প্রতিবন্ধী হয়, অথবা দুর্বল হয়, অথবা [লেখার বিষয়বস্তু] বলে দিতে অক্ষম হয়, ৩৩১ [সেক্ষেত্রে] তার অভিভাবক বিশ্বস্তভাবে বিষয়বস্তু বলে দেবে। তোমার আপনজনের মধ্যে থেকে দু’জন পুরুষ সাক্ষী রাখবে ৩৩২। যদিসেখানে দু’জন পুরুষ সাক্ষী না পাও, তবে একজন পুরুষ ও দু’জন স্ত্রীলোক তোমরা সাক্ষী হিসেবে নির্বাচন করবে, যেনো স্ত্রীলোকদের একজন ভুল করলেও তাদের অপরজন তাকে স্মরণ করিয়ে দিতে পারবে। সাক্ষীগণকে যখন [সাক্ষ্য প্রমাণের জন্য] ডাকা হবে তারা তা অস্বীকার করতে পারবে না। ছোট হোক বা বড় হোক ভবিষ্যত মেয়াদসহ [তোমাদের চুক্তি] লিখতে অবজ্ঞা প্রকাশ করো না। এটাই আল্লাহ্র চোখে ন্যায্যতর ও প্রমাণের জন্য অধিক উপযুক্ত এবং তোমাদের মধ্যে সন্দেহ নির্ধারণের জন্য অধিক উপযোগী। কিন্তু তোমরা যদি নিজেদের মধ্যে নগদ আদান-প্রদান কর, তা তোমরা না লিখলেও কোন দোষ নাই। কিন্তু ব্যবসায়িক লেনদেনের ব্যাপারে সর্বদা সাক্ষী রাখবে। এবং লেখক ও সাক্ষী যেনো ক্ষতিগ্রস্থ না হয়। যদি তোমরা [এরূপ ক্ষতি] কর, এটা হবে তোমাদের জন্য পাপ। সুতরাং আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তোমাদের শিক্ষা দিয়ে থাকেন। আল্লাহ্ সকল বিষয়ে সবিশেষে অবহিত ৩৩৩।
৩২৯। এই আয়াতে ব্যবসায়িক লেনদেনের শর্তাবলী আলোচনা করা হয়েছে। আয়াতটিতে লেনদেনের দুটো পর্যায় সম্বন্ধে বলা হয়েছে। এক হতে পারে ধারে মাল খরিদ করা এবং পরবর্তীতে দাম শোধ করা, অন্যটি হতে পারে অগ্রিম অর্থ প্রদান করা এবং পরবর্তীতে নির্দিষ্ট স্থানে মাল সরবরাহ করা। কুরআনের নির্দেশ হচ্ছে এসব ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডে অবশ্যই লিখিত দলিলের আশ্রয় গ্রহণ করতে হবে এবং সাক্ষী রাখা উত্তম।
৩৩০। দলিল লেখকদের সম্পর্কে এখানে বলা হয়েছে, যিনি লিখবেন, তাকে অবশ্যই ন্যায়বান হতে হবে, যেনো কোনও পক্ষের হয়ে অন্যপক্ষের জন্য অন্যায় দলিল রচনা না করেন। এ কথা সর্বদা মনে রাখতে বলা হয়েছে যে আল্লাহ্ সর্বজ্ঞ, সব জানেন ও দেখেন। এ কথা যারা দলিল লিখবেন তারা অবশ্যই মনে রাখবেন যে লেখাপড়া করতে পারা, খুব বড় নেয়ামতপ্রাপ্ত হওয়ার সামিল। আল্লাহ্র এই নেয়ামতকে মানুষের মঙ্গলের জন্য ব্যয় করা উচিত। যাকে আল্লাহ্ পড়ার ক্ষমতা দিয়েছেন, লেখার ক্ষমতা দিয়েছেন, তাকে আল্লাহ্ অশেষ নেয়ামত দান করেছেন। কারণ লেখাপড়া করতে পারাই হচ্ছে জ্ঞানের রাজ্যে প্রবেশের চাবিকাঠি। বিশেষতঃ আমাদের মত দেশে যেখানে অশিক্ষিতের হার অত্যন্ত বেশী, সেখানে শিক্ষিত লোকের দায়িত্ব ও কর্তব্য অত্যন্ত বেশী এবং সে সম্বন্ধে আল্লাহ্র হুকুম এখানে বর্ণিত হয়েছে।
৩৩১। “ঋণ গ্রহীতা যদি নির্বোধ অথবা দুর্বল হয়, অথবা লিখার বিষয়বস্তু বলে দিতে না পারে” – সেক্ষেত্রে সেই ব্যক্তি চুক্তির বিষয়বস্তু বর্ণনা করতে অক্ষম। এ ক্ষেত্রে অভিভাবকদের সে দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে অভিভাবক অবশ্যই ন্যায়ের সাথে এবং বিশ্বস্ততার সাথে তার দায়িত্ব পালন করবেন।
৩৩২। সাক্ষী নির্বাচনের ব্যাপারে পুরুষ বা নারী যেই হোক না কেন তাকে নিজস্ব চেনা পরিচিত মন্ডল থেকে নির্বাচন করাই শ্রেয়ঃ। কারণ লেনদেনের পুরো প্রক্রিয়ার সাথে সে পরিচিত থাকায়, তার পক্ষে ঘটনাটি অনুধাবন করা সহজসাধ্য হবে। শুধু তা-ই নয়, ভবিষ্যতে প্রয়োজন হলে, সাক্ষ্যদাতাকে সহজেই হাজির করানো সম্ভব হবে।
৩৩৩। উপরের আয়াতটিতে ব্যবসা-বাণিজ্যে যাতে শৃঙ্খলা রক্ষা হয় এবং অন্যায় সংঘটিত না হয় সে ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন করতে বলা হয়েছে। আয়াতটিতে নৈতিক মূল্যবোধের উপরে যেরূপ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে, সমগুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে নিজেদের মধ্যে দরদস্তুরের উপরে, লেনদেনের ব্যাপারে, সাক্ষীর ব্যাপারে, উপযুক্ত লিখিত দলিলের ব্যাপারে। শুধু তাই-ই নয় নৈতিকতার প্রশ্নে সকলেই সমান দায়ী। এমন কি যে দলিল লেখক তাকেও এখানে নৈতিকতার প্রশ্নে আল্লাহ্র কাছে দায়ী করা হয়েছে। ন্যায়পরায়ণতা বা সততাকে পৃথিবীর লাভ ও ক্ষতির মাপকাঠিতে, নিজের সুযোগ সুবিধার্থে যেনো প্রয়োগ করা না হয়। ন্যায়, সত্য ও সততা হবে সব কিছুর উর্ধ্বে, এই হচ্ছে ধার্মিক লোকের বিবেক। এ কথা সকলকেই স্মরণ রাখতে হবে যে প্রাত্যাহিক জীবন ও ধর্মীয় জীবন কোন আলাদা ব্যবস্থা বা দফতর নয়। ইসলামের চোখে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ন্যায় ও সত্য হবে প্রধান চালিকা শক্তি। এমন কি প্রাত্যাহিক জীবনে, ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে, লেনদেনের ক্ষেত্রে এ কথা সর্বদা মনে রাখতে হবে যে আমাদের সব নেওয়া-দেওয়া, ব্যবসা-বাণিজ্য, আমরা করছি আল্লাহ্র চোখের সম্মুখে। সামান্যতম অন্যায়ও তার চক্ষুকে ফাঁকি দেওয়া যায় না। এই জীবনবোধই হচ্ছে ইসলামিক জীবনবোধ। জীবনের সর্বক্ষেত্রে আল্লাহ্র উপস্থিতি অনুভব করা ও তার হুকুম মত জীবন অতিবাহিত করা, এই হচ্ছে ইসলামের মূল দর্শন।