২৬। আল্লাহ্ মশা কিংবা তার চাইতে হীন কোন বস্তুর উপমা দিতে অবজ্ঞা প্রকাশ করেন না, ৪৫। যারা ঈমান এনেছে তারা জানে যে, এই সত্য তার প্রভুর নিকট থেকে আগত। কিন্তু যারা ঈমানকে প্রত্যাখ্যান করে তারা বলে, ‘এই উপমার দ্বারা আল্লাহ্ কি বোঝাতে চান?’ এর দ্বারা তিনি অনেককে বিপথে চালিত করেন এবং অনেককে সৎপথে পরিচালিত করেন। বস্তুতঃ যারা [সত্য পথ] পরিত্যাগ করেছে তারা ব্যতীত অন্য কাউকে তিনি বিভ্রান্ত করেন না।২৭। যারা অনুমোদন করার পরে আল্লাহ্র সাথে কৃত অঙ্গীকার ভঙ্গ করে এবং আল্লাহ্ যা সংযুক্ত রাখতে আদেশ দিয়েছেন তা ভঙ্গ করে এবং পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করে বেড়ায়, এগুলি [শুধুমাত্র] তাদেরই নিজের ক্ষতির কারণ হয়ে থাকে।
৪৫। আরবী শব্দের প্রতিশব্দ ‘অতিক্ষুদ্র’ কথাটির দ্বারা যা বুঝাতে চাওয়া হয়েছে তার অর্থ হচ্ছে দুর্বলতম প্রাণী। এটা শুধু যে আয়তনে তাই-ই নয়, সর্ব ব্যাপারেই যে প্রাণী অত্যন্ত নগন্য। সূরা ২৯ : ৪১ তে উপমার জন্য মাকড়সাকে ব্যবহার করা হয়েছে। অনুরূপভাবে সূরা ২২ : ৭৩ তে মাছিকে উপমা হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। আবার উপমার জন্য প্রাকৃতিক, অতি-প্রাকৃতিক শক্তিকেও ব্যবহার করা হয়েছে যেমন ২ : ১৯ তে বজ্র এবং বিদ্যুৎকে উপমা হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। আল্লাহ্র কাছে তার প্রতিটি সৃষ্টিই গুরুত্বপূর্ণ ও অর্থবহ। তাই আমাদের কাছে যা অত্যন্ত নগণ্য ও ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র আল্লাহ্ তাকেও উপমা হিসেবে ব্যবহার করতে দ্বিধাবোধ করেন না। আল্লাহ্র সৃষ্টিতে বিশাল সিন্ধু, পর্বত, মহীরুহ, বিশাল প্রাণী ইত্যাদি এ সবে যে সৃষ্টি নৈপুণ্য বা কৌশল বিদ্যমান, ক্ষুদ্র মশা, মাছি বা পিপঁড়া বা মাকড়সাতে সেই পরিমাণ সৃষ্টি কৌশল বিদ্যমান। বিজ্ঞান বলে প্রতিটি ক্ষুদ্র প্রাণী বা বস্তু, তাদের যে ধর্ম ও সৃষ্টি কৌশল তা সবই আল্লাহ্র অসীম জ্ঞান ও প্রজ্ঞারই স্বাক্ষর। এমনকি অনুজীব যাদের অনুবীক্ষণ যন্ত্র ব্যতীত দেখা সম্ভব নয়, তাদেরও অবজ্ঞা করার ক্ষমতা আমাদের নাই। কারণ আমরা জানি এরা আমাদের চর্মচক্ষুর অগোচরে থেকেও মানুষের মত শ্রেষ্ঠ সৃষ্টিকেও ধ্বংস করে দিতে পারে। যেমন-প্লেগ, কলেরা, বসন্ত ইত্যাদির জীবাণু চর্মচক্ষে দেখা সম্ভব নয়। কিন্তু এদের ধ্বংস করার ক্ষমতা আমরা সবাই জানি। সাম্প্রতিককালে এইড্স এর আতঙ্ক সকলেরই জানা। সুতরাং স্রষ্টার সৃষ্টিতে ছোট বড় কিছু নাই এই বোধ শুধুমাত্র দূরদর্শী ও চিন্তাশীলরাই অনুধাবন করতে পারে, যারা সত্যিকারের ভাবে মুমিন। মুমিনদের জন্য এসব দৃষ্টান্ত হেদায়েতের উপকরণ। আর যাদের মন মস্তিষ্ক অবিরাম খোদাদ্রোহিতার ফলে সম্পূর্ণভাবে বুদ্ধি-বিবেচনা ও অনুধাবন শক্তি বিবর্জিত হয়ে পড়েছে, তাদের জন্য উপরিউক্ত উপমা আরও পথভ্রষ্টতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
এই সাথে এটাও লক্ষণীয় যে আয়াত ২৬ ও ২৭ এক সাথে পড়া উচিত। পথভ্রষ্টদের সম্বন্ধে বলা হয়েছে আয়াত ২ : ২৭-তে। এরা সেই সব পাপী যারা আল্লাহ্র সাথে তাদের কৃত অঙ্গীকার ভঙ্গ করে। যারা মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করে, পৃথিবীতে হিংসা , বিদ্বেষের আগুন জ্বালায়, সমাজের শান্তির পরিবর্তে হানাহানির সৃষ্টি করে।
২:২৭ এই আয়াতে যে অঙ্গীকারের কথা বলা হয়েছে এটা এখানে কোন বিশেষ সম্প্রদায়ের (ইহুদী) জন্য বলা হলেও এর আবেদন সর্বকালের, সর্বস্থানের জন্য প্রযোজ্য। এখানে ইহুদীদের আচার আচরণ সম্বন্ধে বলা হয়েছে। আল্লাহ্ হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এর মুনাজাতের জবাবে বলেছেন যে আল্লাহ্র নির্দেশিত বাণী যুগে যুগে হযরত ইব্রাহীমের (আঃ) বংশধরদের মাধ্যমেই প্রচারের জন্য পাঠাবেন। বিনিময়ে তারা আল্লাহ্ নির্দেশিত পথে চলবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় ইহুদীরা তাদের সেই অঙ্গীকার থেকে দূরে সরে গিয়েছে। শুধু তাই-ই নয় তারা আল্লাহ্র প্রেরিত রসুলদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, তাদের হত্যা ইত্যাদি কাজে নিয়োজিত, ফলে তাদের আত্মার ধ্বংস নিজেরাই ডেকে এনেছে। ইহুদীদের উপমার সাহায্যে আল্লাহ্ সমগ্র মানব সমাজকে এই শিক্ষা দিয়েছেন যে পৃথিবীর প্রতিটি জীবন আল্লাহ্র কাছে অঙ্গীকারবদ্ধ। আল্লাহ্ তাদের ভালবাসেন, দয়া করেন। বিনিময়ে তারা আল্লাহ্র প্রদর্শিত পথে চলবে। এই পথ চলা হবে স্ব-ইচ্ছায়। স্রষ্টার কাছে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পনের মাধ্যমে। যারা তা না করে, যারা ইচ্ছাকৃতভাবে আল্লাহ্র প্রদর্শিত পথকে উপক্ষো করে, তাদের বিবেক (Spiritual Insight) হয় তমসাচ্ছন্ন। বিবেক তমসাচ্ছন্ন হলে মানুষের মধ্যে ভাল-মন্দের, ন্যায়-অন্যায় এর মধ্যে পার্থক্য করার ক্ষমতা বিলুপ্ত হয়ে যায়। এর ফলে আল্লাহ্র রহমত তাদের অন্তরকে স্পর্শ করে না। পরিণতিতে অন্তরের অন্ধকার দূরীভূত হয় না, বিবেক জাগ্রত হয় না। বিবেকহীন আত্মা পশুর সমান। যার অন্তর প্রদর্শিত পথের আলো গ্রহণে অপারগ, তার মত হতভাগা আর কে আছে? তার জন্য পৃথিবী হাহাকারময় ও অশান্তিময়। তাদের পরকাল দোযখের আগুনের লেলিহান শিখায় আবৃত। আল্লাহ্র পরিকল্পনা বা উদ্দেশ্য এতে ব্যাহত হয় না একবিন্দুও। তাই ক্ষুদ্র বস্তুর উপমা এসব অন্তর বোঝার ক্ষমতা রাখে না। কারণ তাদের আত্মা অন্ধকারে আচ্ছন্ন। শুধুমাত্র তারাই বুঝতে পারবে, যাদের আত্মায় আল্লাহ্র হেদায়েতের আলো প্রবেশ লাভ করেছে। বরং এইসব উপমাতে তাদের ঈমানের দৃঢ়তা আরও বৃদ্ধি পায়। আল্লাহ্র রহমত তাদের অন্তরকে বিধৌত করে, ফলে তাদের অন্তর্দৃষ্টি, জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও অনুধাবন ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।