‘অর্থাৎ ভারতেও শিল্প এবং পুঁজিবাদের বিস্তার অপরিহার্য?’
‘নিশ্চয়ই, ইংলণ্ডে এখন আর সামন্তবাদী প্ৰভুত্ব নেই।’
‘হ্যাঁ সংস্কার আইন (১৮৩২ খৃঃ) ইংলণ্ডের শাসনভার পুঁজিপতিদের হাতেই তুলে দিয়েছে অথবা বলতে পার, পুঁজিপতিদের শাসনারূঢ় হবার সূচনা ঐ আইন।’
‘তুমি ঠিকই বলেছ। আচ্ছা চাৰ্টিস্টদের সভাসমূহ এবং পত্রিকাসমূহ কি তোমার ওপর কোনো রকম প্রভাব বিস্তার করেছিল এ্যানি?’
‘আচ্ছা এ্যানি, এইসব কথা বলার সময় তাঁকে কি তেমনি জোরালো বক্তা রূপে দেখা। যেত। যেমনটি দেখা গিয়েছিল পার্লামেন্টে বারো লক্ষ জনতার সহিযুক্ত সাধারণ দাবী প্রত্যাখ্যাত হওয়ার সময়?’
‘না প্রিয়, এখনও তিনি ভয় করেন, যদিও এই ১৮৫৬ সালে চাৰ্টিষ্টদের সম্বন্ধে বিশেষ কিছু শোনাই যায় না।‘
‘ভয় কেন পাবেন না, এ্যানি? পুঁজিপতি ব্যবসায়ীরা যেমন সামন্ত-শাসনকে ধ্বংস করে নিজেদের শাসন কায়েম করেছে, তেমনি মজুরেরাও এই পুঁজিপতিদের রাজ্য খতম করে। ছাড়বে এবং মানবতার রাজ্য কায়েম করবে। যেখানে ধনী-দরিদ্র, বড়-ছোট কালো-সাদার ভেদাভেদ ঘুচে যাবে।’
‘স্ত্রী-পুরুষের পার্থক্যও ঘুচাবে মঙ্গী?’
‘হ্যাঁ, স্ত্রীলোকেরাও পুরুষের জুলুমে মারা পড়ছে। আমাদের দেশে সামন্তবাদ এই সেদিন পর্যন্ত ও সতীপ্রথার নামে লক্ষ লক্ষ স্ত্রীলোককে প্রতি বছর আগুনে পুড়িয়ে মেরেছে আর এখনও তারা যে রকম পর্দার আড়ালে বন্দী হয়ে, সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে পুরুষের জুলুম সহ্য করছে—সেটা মানবতার কলঙ্ক।’
‘আমাদের এখানকার স্ত্রীলোকদের তুমি হয়ত স্বাধীন ভেবে থাকবে, কেননা, আমাদের পর্দার আড়ালে বন্দী করে রাখা হয় না।’
‘স্বাধীন বলি না এ্যানি, শুধু এইটুকু বলি যে, তোমরা তোমাদের ভারতীয় বোনদের চেয়ে ঢের ভালো অবস্থায় আছ।’
‘গোলামীর আবার ভালো-মন্দা! পার্লামেন্টে ভোটের অধিকার নেই, বড়-বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চৌকাঠও আমরা পেরুতে পারি না। মুঠোর মধ্যে ধরা যায় এমন আঁট করে কোমর কষে, আর ষাট গজ কাপড় তা থেকে মাটিতে লুটিয়ে এমনি সব ঘাঘরা পরি আমরা-শুধু পুরুষদের খেলার পুতুল হবার জন্যে। সে যাহোক, তাহলে মার্কস এই আশা করেন যে, ভারতে শিল্প এবং পুঁজিবাদের প্রসার হবে, যার ফলে একদিকে জনগণের মধ্যে অধিকতর সাহসের সঞ্চার হবে, অপরদিকে ওখানেও গ্রামের বেকার, কৃষক, এবং কারিগরদের কারখানায় একত্রিত করা যাবে। তারপর তারা আপন শ্রমিক-সমিতি গড়ে লড়তে শিখবে এবং সাম্যবাদের ঝাণ্ডা নিয়ে ইংলণ্ডের মজুরদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মানুষের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করবে, এবং পৃথিবীকে পুঁজিপতিদের গোলামী থেকে মুক্ত করে সেখানে সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার রাজ্য প্রতিষ্ঠিত করবে। কিন্তু এ তো কয়েক শত বছরের ব্যাপার মঙ্গী!’
‘মার্কস এ কথাও বলেন, যদিও ইংরেজরা বিজ্ঞানের দান কলকারখানা থেকে ভারতবর্ষকে বঞ্চিত করে রেখেছে, তবুও বিজ্ঞানের অপরাপর দান যুদ্ধের অস্ত্ৰসমূহ দিয়ে ভারতীয় সৈন্যগণকে সুসজ্জিত করেছে। এই ভারতীয় সৈন্যেরা ভারতের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার করতে বড় রকমের সহায়ক হবে।’
‘কিন্তু একি খুব শীঘ্র হতে পারে?’
‘খুব দূরের ব্যাপার নয় এ্যানি, সময় এসেই গেছে। কাগজে পড়নি, ৭ই ফেব্রুয়ারি (১৮৫৬ খৃষ্টাব্দ) অযোধ্যাকে ইংরেজ রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়া হয়েছে?’।
‘হ্যাঁ, এবং নেওয়া হয়েছে বেইমানী করে।’
‘বেইমানী বা ইমানদারী নিয়ে তর্ক করার কিছু নেই। ইংরেজ ব্যবসায়ীরা সব কিছুই নিজেদের স্বার্থের জন্য করছে। কিন্তু অজ্ঞাতে তারা অনেক কিছু ভালোও করে ফেলেছে। তার গ্রামীণ প্রজাতন্ত্রকে ভেঙে আমাদের সামনে দেশের বিস্তৃত রূপ তুলে ধরেছে। তারা নিজেদের রেল, তার, জাহাজ দিয়ে আমাদের কুপমণ্ডুকতাকে ভেঙে বিশাল জগতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক স্থাপিত করেছে, অযোধ্যা অধিকার করায় কিছু পরিবর্তন আসবে, আর আমি তারই প্রতীক্ষায় আছি এ্যানি।
‘মার্কসের শিষ্যের কাছ থেকে আর কি আশা করা যেতে পারে?’
২.
গঙ্গার প্রশান্ত তট আবার অশান্ত হয়ে উঠতে চাইল। বিঠরের বিশাল প্রাসাদে পেশোয়ার উত্তরাধিকারী নানাসাহেব (ছোট) শুধু সিংহাসন থেকেই নয়, পেন্সন থেকেও বঞ্চিত হয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে অধিকতর সক্রিয় হয়ে উঠল। তার অনুচরেরা তারই মতো পদচ্যুত অপরাপর সামন্তদের কাছে রাত-দিন ছুটাছুটি করতে লাগল। এই সময় ইংরেজেরা আরও একটি বড় ভুল করে বসল। আর সে ভুল শুধু ভুলই নয়, নিত্য-নতুন পরিস্থিতির মধ্যে এ হল রীতিমতো প্ৰাণ নিয়ে টানাটানি। ইংরেজেরা আগের ছররা বন্দুকের জায়গায় আরও বেশি জোরদার কাতুর্জের বন্দুক তাদের সৈন্যবাহিনীর মধ্যে বণ্টন করল। এই কাতুর্জ বন্দুকে ভরবার সময় দাঁতে কাটতে হত। অদূরদশী ইংরেজের শত্রু এই ব্যাপার থেকেই সুযোগ সংগ্রহ করে নিল। চারদিকে রব তুলে দিল যে, বন্দুকের কাতুর্জের ভিতর গরু এবং শুয়োরের চর্বি আছে, ইংরেজেরা জেনেশুনেই এই কাতুর্জ সিপাইদের দাঁতে কাটতে দিয়েছে, যাতে ভারতবর্ষ থেকে হিন্দু-মুসলমানের ধর্ম উঠে যায়, আর সকলেই খৃষ্টান হয়ে যায়।
কাশীরাজ চেৎসিংহের পৌত্র মঙ্গল সিংহের নাম সৈন্যদের মধ্যে বিদ্যুতের মতো কাজ করছে, এ কথা মঙ্গল সিংহ জানত, কিন্তু সে কখনও এই রহস্যকে উন্মুক্ত হতে দেয়নি। নানাসাহেব এবং অপর বিদ্রোহী নেতারা তার সম্পর্কে এইটুকুই জানত, সে ইংরেজ শাসনের পরম শত্ৰু, বিলেত গিয়ে সে ইংরেজদের বিদ্যা যথেষ্ট অধ্যয়ন করেছে। রাজনীতি সম্বন্ধে তার প্রগাঢ় জ্ঞান। বিলাতে থাকার ফলে তার ধর্ম নষ্ট হয়ে গেছে, যদিও খৃষ্টান ধর্মকেও সে মানে না।