‘ভারতবর্ষে শিশুদের লেখাপড়া শেখানোর কথা কেউ কি ভাবে না?’
‘তেরশ বছর আগে যে বিদ্যা পড়লে লাভ ছিল এখনো সেই বিদ্যাই শেখানো হয়।’
‘তারপর ইংলণ্ডে আসবার জন্যে মার’ অনুমতি কি করে পেলে?’
‘অনুমতি! পাদ্রীর সাহায্যে আমি মাকে না বলেই চলে এলাম। কেম্বিজে পড়বার ব্যবস্থা করে দিলেন তিনি। এখান থেকে যখন আমি মাকে কুশল-সংবাদ পাঠালাম, তখন তিনি আশীৰ্বাদ জানালেন। তাঁর বয়স তখন পঞ্চান্ন। প্রত্যেক চিঠিতেই আমাকে দেশে চলে যেতে লিখতেন। তিনি।’
‘তুমি কি জবাব দিতে?’
‘জবাব আর কি দেব? তিনি ভাবতেন, আমি রাজধানীতে আছি, ইংলেণ্ডের রাণীর সঙ্গে আমার দেখাসাক্ষাৎ হচ্ছে এবং এক সময় আমি চেৎসিংহের সিংহাসনের অধিপতি হয়ে দেশে ফিরব।’
‘ঐ গঙ্গা-পূজারিণী বেচারী কি করে জানবেন যে, রাণী ভিক্টেরিয়ার সঙ্গে তোমার। দেখা না হয়ে হয়েছে সমগ্র দুনিয়ার যত মুকুট-শোভিত-শিরের ভয়ঙ্কর শক্র কার্ল মার্কস আর ফ্রিডরিশ এঙ্গেলসের সঙ্গে!’
‘যে সময় সমগ্ৰ ভারতবর্ষ পুঁজিবাদী দুনিয়া এবং তার শক্তি সম্বন্ধেই অজ্ঞ, তখন মার্কসের সাম্যবাদকে কি করে বুঝবেন তিনি!’
‘মার্কসের সঙ্গে ভারত সম্বন্ধে কখনও কিছু কথা হয়েছে তোমোর?’
‘বহুবার। আমার অবাক লেগেছে যে, এখানে বসে বসে ভারতের জীবন-প্রবাহ সম্বন্ধে কি অসাধারণ জ্ঞান তাঁর! কিন্তু এ কোনো ভানুমতীর খেলা নয়, গত তিনশ’ বছরের বিভিন্ন ইংরেজ ভারত সম্বন্ধে যতটা জ্ঞানার্জন করে লিপিবদ্ধ করে গিয়েছে, সবই এই লণ্ডনে মজুত রয়েছে। আবর্জনার মতো পড়ে থাকা এই পুস্তকাবলী গভীর মনোযোগের সঙ্গে পড়েছেন। মার্কস। আর যখনই কোনো ভারতীয়ের এখানে দেখা পেতেন, তাকে জিজ্ঞাসা করে তাঁর অধীত জ্ঞান যাচাই করে দেখতেন।’
‘ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে মার্কসের কি অভিমত?’
‘ভারতের যোদ্ধাদের খুবই প্রশংসা করেন—আমাদের বুদ্ধিরও প্রশংসা করেন। কিন্তু আমাদের প্রাচীনপন্থীদের, ভারতের সব চেয়ে বড় শত্রু বলে তিনি মনে করেন। আমাদের গ্রামগুলোকে স্বয়ংসম্পূর্ণ ছোট-ছোট প্রজাতন্ত্র বলে মনে করেন।’
‘প্রজাতন্ত্র?’
‘সমগ্ৰ দেশ নয়, দেশের একটা জেলা, এমন কি এক সঙ্গে দুটো গ্রামও নয়, শুধু একটি একক গ্রাম। কিন্তু সব জায়গাতে নয়, যেখানে লর্ড কর্নওয়ালিস ইংরেজি ছাচে জমিদারী প্রথা কায়েম করেছে, সেখানকার প্রজাতন্ত্র প্রথমেই শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু প্রাচীন ভারতীয় গ্রামীণ প্রজাতন্ত্রকে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা পরিচালনা করে থাকে। পুলিশ আইন, সেচ, শিক্ষা, ধর্ম ইত্যাদি সমস্ত বিভাগই সে পরিচালনা করে, এবং অত্যন্ত বিবেচনা, বুদ্ধিমত্তা, ন্যায় এবং নিৰ্ভয়তার সঙ্গে। গ্রামের এক অঙ্গুলি পরিমাণ জমি বা দুর্বলতম মানুষের ইজ্জত রক্ষার জন্যেও আপন পঞ্চায়েতের হুকুমে গ্রামের শিশু-বৃদ্ধ সর্বদা প্রাণ দেবার জন্য প্রস্তুত থাকে। যখন দিল্লীর আশপাশে অল্প দূর পর্যন্তই মুসলমান শাসকদের রাজত্ব ছিল, এবং তারা নিজেদের মুসাফির বলে মনে করত, সেই সময়ে প্রথম প্রথম তারা পঞ্চায়েতের ক্ষতি করতে চাইত। পরে তারা পঞ্চায়েতের স্বায়ত্ব শাসনকে মেনে নিল। কিন্তু ইংরেজ শাসকবৃন্দ, বিশেষ করে ইংলণ্ডের জমিদার লর্ড কর্নওয়ালিসই গ্রামীণ প্রজাতন্ত্রকে বরবাদ করবার আওয়াজ তুলল, এবং বহুলাংশে সফলও হল। কিন্তু এতেও সম্ভবত ভাঙত না এই পঞ্চায়েত ব্যবস্থা। গ্রামের প্রজাতন্ত্র এবং তার অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার ওপর সব চেয়ে বড় আঘাত এল ম্যানচেষ্টার ও ল্যাঙ্কাশায়ারের কাপড়, শেফিল্ডের লোহার জিনিস এবং এখান থেকে রপ্তানী-করা আরও বহু জিনিসপত্রের কাছ থেকে। ১৯২২ খৃষ্টাব্দের জুলাই মাসের ১০ তারিখে কলকাতায় প্রথম বাষ্পীয় পোত জলে নামল। সঙ্গে সঙ্গেই গ্রামের প্রজাতন্ত্রের অর্থনৈতিক অবশিষ্ট স্বাধীনতাটুকু নিশ্চিত হয়ে গেল। ভারতবর্ষের সূক্ষ্ম মলমল উৎপাদনের স্থান ঢাকা, দুই-তৃতীয়াংশ জনবিরল হয়ে পড়ল। গ্রামের তাঁতীদের অবস্থা হয়ে উঠল অবৰ্ণনীয়। যে ভারতীয় গ্রাম নিজেদের কামার, কুমার, জেলা, তাঁতী নিয়ে নিজেকে স্বাধীন মনে করত, তার এই সমস্ত কারিগর, তখন হাত গুটিয়ে ঘরে বসে অনাহারে মরতে লাগল। আর তাদের জন্যে ল্যাঙ্কাশায়ার, ম্যানচেষ্টার, বার্মিংহাম, শেফিল্ডের মাল পাঠানো হতে লাগল। শুধু কাপড়ের কথাই ধর। ১৮৮৪ খৃষ্ঠাব্দে ভারত থেকে ব্রিটেনে ১৮,৬৬,৬০৮ থান কাপড় এসেছে এবং ১৮৩৫ খৃষ্টাব্দে ৩,৭৬,০৮৬ থান। আর এখন আমাদের ওখানে ৮,১৮,২০,৯৫,১৭,৭৭,২৭৭ গজ বিলাতী কাপড় রপ্তানি হয়েছে। ঢাকাই মলমল বস্ত্র উৎপাদনকারী ভারতবর্ষ নিজেদের তুলা বিলাতে পাঠিয়ে প্রয়োজনীয় কাপড় তৈরি করাচ্ছে! একেবারে হালের হিসাব অনুযায়ী ১৮৪৬-এ ১০,৭৫,৩০৯ পাউণ্ড তুলা ভারত থেকে এখানে এসেছে।’
‘কিন্তু মার্কস বলেন, বিদেশীদের এই অত্যাচারে আমাদের হৃদয় কেঁদে ওঠে, কিন্তু আমাদের বুদ্ধিমত্তা তৃপ্ত হয় প্রাচীনপন্থার এই পতনে।’
‘দুটোর মধ্যে তা হলে দু’ধরনের পরিণতি ঘটছে?’
’হ্যাঁ এ্যানি! সন্তান প্রসবের সময় মা কি ভয়ানক যন্ত্রণা ভোগ করেন, কিন্তু একই সঙ্গে। তিনি সন্তান প্রাপ্তির আনন্দও অনুভব করেন। ধ্বংস বিনা সৃষ্টি অসম্ভব। ছোট-ছেট ঐ সব প্রজাতন্ত্রকে ধ্বংস না করে বিরাট শক্তিশালী এক প্রজাতন্ত্রের ভিত্তি স্থাপন করা যায় না। যতদিন-পর্যন্ত ভারতীয়দের আসক্তি কেবলমাত্র নিজ-নিজ গ্রামীণ প্রজাতন্ত্রের প্রতি সীমাবদ্ধ থাকবে, ততদিন সমগ্ৰ ভারতবর্ষের জন্য তারা আত্মত্যাগ করতে পারবে না। ইংরেজরা। নিজেদের ব্যবসার সুবিধার জন্যেই রেলওয়ে, টেলিগ্রাফ এই সমস্ত যন্ত্রকে শুধু ভারতে আমদানি করেছ, কিন্তু মার্কসের সিদ্ধান্তই সঠিক যে, রেলগাড়ি তৈরি এবং মেরামতের জন্য যদি ইংরেজ পুঁজিপতি ভারতীয় কয়লা এবং লোহাকে কাজে লাগাতে না পারে, তবে বেশি। দিন তারা সস্তায় এই সব জিনিস চালাতে পারবে না। আর ভারতীয়েরাও বিজ্ঞানের এই চমৎকারিতা চোখের সামনে দেখে কতদিন ঘুমিয়ে থাকবে?’