‘ইংলণ্ডে এসে সত্যিই তোমার মনে হয়েছিল যে, অন্ধকার থেকে আলোতে এলে?’
‘সেই অর্থে, যার কথা আমি এখনই বললাম। ভারত ছাড়বার সময় আমার মনে শুধু দুটো উদ্দেশ্য ছিল। এক আমার প্রিয় ইষ্টদেব যিশুখৃষ্টর ভক্তবৃন্দের দেশ দর্শন করব। দ্বিতীয়ত, আমাদের কূলের হারিয়ে রাজলক্ষ্মীকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করব।’
‘কতবার আমি ভেবেছি, তোমার মুখে তোমার কথা শুনিব, কিন্তু বারম্বার কথায় কথায়। ভুলে গিয়েছি। আজ তোমার কথাই বল মঙ্গী।’
‘যে আমার জীবনের গতিকেই বদলে দিয়েছে তার কাছে বলতে আপত্তি কি! এ্যানি প্রিয়তমা, চল শান্ত টেমসের পারে। আমাদের গঙ্গার মতো অত বিরাট, অত সুন্দর নয় টেম্স, তবুও যখনই আমি টেম্সকে দেখি, তখনই গঙ্গার মধুর স্মৃতি আমাকে বিহ্বল করে তোলে। তুমি তো জানো এ্যানি, খৃষ্টানরা ভগবান যিশুখৃষ্ট ছাড়া আর কারও পূজাকে বিধর্ম বলে মনে করে এবং ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখে। কিন্তু টেম্স আমাকে খৃষ্টান থেকে বিধর্ম করে দিয়েছে। আমি আমার মাকে অত্যন্ত ভক্তির সঙ্গে ফুল দিয়ে গঙ্গাকে প্ৰণাম করতে দেখেছি।’
দু’জন টেম্সের ধারে এসে পৌঁছাল। টেম্সের দিকে মুখ ঘুরিয়ে পাথরের চত্বরের ওপর ওরা বসল। সাদা টুপির ভেতর থেকে বেরিয়ে গালের ওপর এসে-পড়া এ্যানির সোনালী কেশগুচ্ছ হাওয়ায় উড়তে লাগল। মঙ্গল তাকে চুমু দিয়ে কথা আরম্ভ করল, ‘এই টেমসের পার থেকে বহুবার আমি গঙ্গাকে আমার মানস-তৰ্পণ নিবেদন করেছি।’
‘তোমার মা গঙ্গাকে পুষ্পার্য দিতেন?’
‘হ্যাঁ, খুব ভক্তিসহকারে, যেমন খৃষ্টানেরা প্ৰভু যিশুকে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করে। তখন আমি প্রথম খৃষ্টান হয়েছি, আমার কাছে এটা ঘূর্ণিত প্রথা বলে মনে হত। কিন্তু এখন আমি গঙ্গাকে অপমান করার পাপের জন্য অনুতপ্ত হচ্ছি।’
‘খৃষ্ট ধর্ম যে আদর্শকে নষ্ট করতে চেয়েছে, আমাদের কবিরা তাকে পুনরুজ্জীবিত করেছে। তুমি জানো, আমরা টেম্সকে পিতা বলে অভিহিত করি?’
‘আর আমরা বলি মা গঙ্গা…’
‘তোমাদের কল্পনা আরও মধুর মঙ্গী! তোমরা কথা বল আমাকে।’
‘বেনারস আর রামনগর গঙ্গার এপার আর ওপার-উভয়ের দূরত্ব সামান্যই। ষোলো বছর পর্যন্ত আমি গঙ্গাকে দেখেছি। বেনারসে একেবারে গঙ্গার ওপরেই আমাদের বাড়ি। তার নিচ থেকে ষাট ধাপ সিঁড়ি গঙ্গার জল পর্যন্ত নেমে গেছে। সম্ভবত যখন আমি প্রথম চোখ মেলি, তখনই মা আমাকে কোলো নিয়ে গঙ্গা দেখিয়েছেন। কেন জানি না, আমার মনে হয়, আমার রক্তে গঙ্গা বয়ে চলেছে। রামনগরে আমার ঠাকুর্দার কেল্লা, কিন্তু সেটা আমি একবার মাত্র দেখেছি।-নৌকা করে গঙ্গায় বেড়াবার সময়। ওর ভিতরে গিয়ে দেখবার ইচ্ছা আমার হত না, মা তো আরও যেতে চাইতেন না। বুঝতেই পারছি এ্যানি-যে একদিন ঐ কেল্লার যুবরাজ্ঞী ছিল আর আজ যে ইংরেজদের ভয়ে নাম বদলে বেনারসের এক। বাড়িতে জীবন কাটাচ্ছে, সে কেমন করে ঐ কেল্লার দিকে তাকাতে সাহস করবে? আমার ঠাকুর্দা চেৎসিংহকে দস্য ওয়ারেন হেষ্টিংস নাজেহাল করেছে–ইংলেণ্ডে হেষ্টিংস আপন কৃতকর্মের ফলও পেয়েছে কিছুটা, কিন্তু আমার ঠাকুর্দার প্রতি কিছুমাত্র ন্যায়-বিচার হয়নি, লুষ্ঠিত রাজ্য ফিরিয়ে দেওয়া বড় সহজ ন্যায়ের কাজ ছিল না, এ্যানি।’
‘তোমার মা কি এখনও বেঁচে আছেন?’
‘বেনারস থেকে প্রায়ই আমাদের পাদ্রীর চিঠি আসে, আমি তাঁর মারফৎ মাকে চিঠি লিখি। পাঁচ মাস আগেও তিনি জীবিত ছিলেন এ্যানি।’
‘ঐ আন্দোলনের সময় আমি ততটা সচেতন ছিলাম না, ওগুলোর স্মৃতি সামান্যই মনে আছে আমার। আমার কাকা রাসেল মন্ত্রীসভায় চাৰ্টিস্টদের ঘোরতর শত্রু ছিলেন। তাঁর মুখে বহুবার আমি ঐ বিপদজ্জনক আন্দোলনের কথা শুনেছি।’
‘প্রথমে তুমি খৃষ্টান ছিলে না তাহলে?’
‘না, আমার মা এখনও হিন্দু। আমি প্রথম প্রথম তাঁকেও খৃষ্টান করতে চাইতাম, কিন্তু এখন…’
‘এখন তুমিও তোমার মা’র সঙ্গে একত্রে মা গঙ্গাকে ফুল দিয়ে প্রণাম করবে?’
‘আর পাদ্রীরা বলবে, এ খৃষ্ট ধর্ম ছেড়ে দিয়েছে।’
‘তুমি খৃষ্টান হলে কি করে?’
‘অন্তরের প্রেরণা কিছুই ছিল না, বেনারসের ইংরেজ পান্ধী এবং পাদ্রিনীরা খৃষ্টান ধর্ম প্রচার করে বেড়ায়। কিন্তু বেনারস হল হিন্দুদের রোম। এ জন্য সেখানে তেমন সুবিধে করতে পারত না। একবার এক পাস্ত্রী ডাক্তার আমার মা’র অসুখের সময় চিকিৎসা করেন। তারপর তাঁর স্ত্রী আমাদের বাড়িতে যাতায়াত আরম্ভ করলেন। আমার মা’র সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠল। আমি তখন খুব ছোট ছিলাম এবং তিনি আমাকে প্রায়ই কোলে। তুলে নিতেন………’
‘ছেলেবেলায় তুমি বোধহয় খুব সুন্দর ছিলে-তাই না মঙ্গী?’
‘তারপর সেই পাদ্রী মাকে বোঝালেন যে, ছেলেকে ইংরেজি পাড়াও। পাঁচ-ছ বছর। বয়স থেকেই পাস্ত্রী আমাকে ইংরেজি পড়াতে শুরু করলেন। মা নিজের পরিবারের অতীত বৈভবের কথা ভাবতেন এবং আশা করতেন, হয়ত ইংরেজি পড়ে ছেলে কুললক্ষ্মীকে ফিরিয়ে আনবার জন্য কিছু করতে পারবে। আমার বাবা আমার তিন বছর বয়সেই মারা গিয়েছিলেন। এ জন্য আমার মাকেই সব কিছু করতে হত। আমাদের সব সম্পত্তি ও রাজ্য চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বেদখল হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু মা’র কাছে তাঁর শাশুড়ীর দেওয়া। প্রচুর মণিমুক্তা ছিল। আর আমার মামাও মাকে সাহায্য করতেন। আট বছর বয়স থেকে আমি বেশি করে সেই পাদ্ৰী দম্পতির বাড়িতে থাকতে লাগলাম। হিন্দুধর্ম সম্বন্ধে জানবার সুযোগ আমার খুব কমই মিলত আর যদি কিছু মিলত তো সেই পাদ্রিনীর মুখ থেকে। তিনি বলতেন, এ তোমার ভাগ্য যে তোমার মা বেঁচে গিয়েছেন। না হলে তোমার বাবা মরে যাওয়ার পর লোকে তোমার মাকে জীবন্ত দগ্ধ করে সতী বানাতে চাইত।’ আমার মাকে জীবন্ত দগ্ধ করার সঙ্গে হিন্দুধর্মকে এক মনে করার পর–তুমিই বুঝতে পার এ্যানি, আমার হৃদয়ে ঐ ধর্মের প্রতি অপরিসীম। ঘৃণা ছাড়া আর কোনো ভাবের উদ্রেক হতে পারে? এই সময় সতীদাহ প্ৰথা বন্ধ হতে দু’বছর (১৮২৯) বাকী ছিল। আমার মঙ্গলের কথা ভেবে পাদ্রিনীর কথা মা মেনে নিলেন এবং পড়ার জন্য কলকাতায় পাঠিয়ে দিলেন। কলকাতায় যখন পড়ছিলাম, তখন মা’র মনে সন্দেহ হল যে, আমাকে খৃষ্টান বানাবার জন্যেই পাদ্ৰিনী এই সব করছে। মা প্ৰথমে কিছু বুঝতে না পারায় ভালোই হয়েছিল, নইলে নিজের চোখ খুলবার সুযোগ পেতাম না।’