‘দেওয়ানজীর জন্যে লাউ পাড়ছি, দেখতে পাচ্ছি না?’ —মাথা না তুলেই উত্তর দিল চৌকিদার।
কর্কশস্বরে রেখা বলল, ‘হাত-পা আস্ত রাখতে চাও তো ভালোয় ভালোয় নেমে এস। —বলি শুনতে পাচ্ছ কথাটা?’।
‘মালিকের চাপরাশী জানো তো?’
‘খুব জানি! ভালো মানুষের মতো লাউগুলো ওখানে রেখে নেমে এস।’
চৌকিদার নিঃশব্দে নেমে এল। সব শুনে দেওয়ানজী তখনকার মতো রাগ চেপে রাখল। মাঘ মাসে মালিকের আগমনের অপেক্ষায় থাকল সে।
মালিক আসবার পর সেই চৌকিদার একদিন সন্ধ্যাবেলা রেখা ভগতের বাড়ি এসে বলল, ‘কাল সকাল থেকে দু’সের করে দুধ মালিকের বাড়িতে পৌঁছে দিতে হবে।’
‘আমার কাছে গরু মহিষ কিছুই নেই, দুধ কোথা থেকে দেব?’
‘যেখান থেকে হোক, মালিকের হুকুম।’
দেওয়ান অবশ্যই জানত, রেখার গরু-মহিষ কিছুই নেই। কিন্তু রেখাকে তার টিটু করতে হবে এখন। সন্ধ্যাবেলাতেই সে রেখার ঔদ্ধত্যের কথা মালিকের কাছে জানিয়ে দিয়েছে; আর এও বলেছে যে, সারা গ্রাম বিদ্রোহী হয়ে উঠছে। মালিক সেই রাতের মধ্যেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। তার করণীয় কর্তব্য সম্বন্ধে। সকালে রেখার কাছ থেকে দুধ এল না। পেয়াদা এলে রেখা তার নিজের গরু-মহিষ না থাকার কথা জানাল।
মালিক পাঁচজন গুপ্তপ্রকৃতির পেয়াদাকে হুকুম দিল, ‘যাও হারামজাদার মাগের দুধ দুইয়ে নিয়ে এস।’
গ্রামের কয়েকজন লোক সেখানে উপস্থিত ছিল। তারা ভাবল, পেয়াদারী রেখাকে ধরে আনবে। রেখাকে কোনো কিছু বলার বা শোনার সুযোগ না দিয়ে পেয়াদারা তাকে বেঁধে ফেলল। তারপর দু’জনে ঘরে ঢুকে মঙ্গরীকে ধরে আনল। নিরুপায় রেখা অগ্নিবৰ্ণ চোখে দেখতে লাগল-মঙ্গরীর আর্ত চিৎকারের মধ্যেই তার স্তন টিপে ধরে গ্লাসের মধ্যে সত্যি সত্যিই কয়েক ফোঁটা দুধ বের করল তারা।
পেয়াদারা রেখাকে বেঁধে রেখেই চলে গেল।
লজ্জায় মরে গিয়ে মঙ্গরী সেইখানেই মুখখুঁজে বসে রইল। কিছুক্ষণ পরে রেখা যেন কথা বলার শক্তি খুঁজে পেল। বলল, ‘লজ্জা করিস না মঙ্গরী। আজ আমাদের গ্রামের পঞ্চায়েত বেঁচে থাকলে বাদশাহও এমন বেইজ্জতি কাউকে করতে পারত না। কিন্তু এই বেইজ্জতির মজা আমি দেখাব। যদি আমার দেহে সাচ্চা আহীরের রক্ত থাকে তো এই দেওয়ান এবং রামপুরের মুন্সীর কুলে কাঁদবার কেউ থাকবে না। এই অপমানের প্রতিকার আমার এই হাতই করবে মঙ্গরী। আয়, আমার বাঁধন ছাড়িয়ে দে।’
মঙ্গরী জলভরা চোখেই রেখার বাঁধন খুলে দিল। ঘরের ভিতর গিয়ে রেখা সুখারীকে কোলে নিয়ে তার মুখে চুমা দিতে থাকল। তারপর মঙ্গরীকে বলল, ‘এখন থেকে যা নেবার আছে তা নিয়ে শীগগির পালা। আমি এই ঘরে আগুন লাগিয়ে দিচ্ছি।’
রেখার গলার স্বর মঙ্গরীর অজানা ছিল না ছেলেকে কোলে নিল, আর দু-তিনখান কাপড় সঙ্গে নিল–তারপর রেখার পায়ে লুটিয়ে পড়ল।
রেখা অত্যন্ত কোমল স্বরে বলল, ‘শুধু তোর ইজ্জত নয়, সারা গ্রামের ইজ্জতের বদলা নিতে হবে। চলে যা, আর বড় হলে সুখারীকে বলিস তার বাপ কেমন ছিল। দেরী করিস না, আমি চললাম চুল্লী থেকে আগুন আনতে।’
মঙ্গরী বহু দূর পর্যন্ত ঘরটাকে দেখতে লাগল-যতক্ষণ পর্যন্ত তার চাল থেকে লেলিহান শিখা উঠতে আরম্ভ না করল, ততক্ষণ। লোকেরা গ্রামের প্রান্তে অবস্থিত রেখার ঘরের দিকে দৌড়াতে লাগল, আর রেখা খোলা তলোয়ার নিয়ে দৌড়াল জমিদারের কাছারীর দিকে। নিজেদের জীবন সংশয় দেখে চৌকিদার, পেয়াদারা পালাতে লাগল। মালিক এবং দেওয়ানকে মারবার সময় রেখা বলল, ‘তোমাদের জন্যে কাঁদবার লোকও রাখব না। শয়তানের দল!’
রেখা নিজের কথাকে সত্য প্রমাণিত করল। প্রতিজ্ঞা পূরণের চেয়েও বেশি করল সে। কসাই কর্নওয়ালিস না-জানি কতজন রেখাকে জন্ম দিয়েছিল!
১৮. মঙ্গল সিংহ (কাল : ১৮৫৭ খৃষ্টাব্দ)
এরা দু’জনে আজ টাওয়ার দেখতে গিয়েছিল। সেখানে এরা সেই কুঠুরীগুলো দেখল। যার ভিতর সারা জীবন বন্দী থেকে রাজদ্রোহীরা পচে মরত। বন্দীদের দেহ টানা দিয়ে রাখবার যন্ত্র, কুড়াল এবং অন্যান্য সেই হাতিয়ারগুলো দেখল-যার সাহায্যে রাজা প্রমাণ করত, প্রজার জীবন-মরণ তারই হাতের মুঠোয় এবং পৃথিবীতে সে-ই সত্যিকারের ঈশ্বর–প্রেরিত যুবরাজ কিম্বা যমরাজ। কিন্তু সবচেয়ে যা আকর্ষণ করল। এদের, তা হল সেই স্থান, যেখানে ইংলেণ্ডের অনেক রাজরাণীর ছিন্নশির ধূলিলুষ্ঠিত হয়েছিল। এ্যানি রাসেল আজও তার কোমল হাত মঙ্গীর হাতে রেখেছিল। কিন্তু আজ সেই কোমলতা ভিন্ন রূপে প্রতীয়মান হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, এগারো বছর আগে (১৮৪৫) বৈজ্ঞানিক ফ্যারাডের আবিষ্কৃত ইলেক্ট্রসিটির মতো এক শক্তি এ্যানির হাত থেকে সারা শরীরে প্রবাহিত হয়ে চলেছে। মঙ্গল সিংহ বলল, ‘এ্যানি, তুমি ব্যাটারী না-কি?’
‘এমন কথা কেন বলছি মঙ্গী?’
‘আমি যে সেই রকমই অনুভব করছি! ষোলো বছর আগে যখন আমি ইংলেণ্ডে পদার্পণ করি, তখন মনে হয়েছিল, অন্ধকার থেকে আলোতে এলাম। পৃথিবী এখানে বিশাল-লম্বাচওড়ায় বড় নয়, কিন্তু দূর ভবিষ্যৎ পর্যন্ত বিস্তৃত এক বিরাট জগৎ আমার চোখে পড়ল। চুকন্দরের চিনি (১৮০৮), বাষ্পীয় জাহাজ (১৮১৯), রেলওয়ে (১৮২৫), তার (১৮৩৩), দিয়াশলাই (১৮৩৮), ফোঁটো (১৮৩৯), বিজলী আলো (১৮৪৫)-এ-সব নতুন এবং আশ্চর্যজনক দেখবার জিনিস তো ছিলই কিন্তু যখন আমি কেন্ত্রিজে এ সম্বন্ধে পড়াশুনা এবং রসায়নাগারে এগুলোকে প্রত্যক্ষ প্রয়োগ করবার সুযোগ পেলাম, তখন বুঝতে পারলাম। পৃথিবীর অদৃষ্ট কি বিরাট এক ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে!’