‘তা’হলে ফ্রান্সে রাজপরিবারের জায়গায় ব্যবসায়ীদের রাজ্য স্থাপিত হয়েছে?’
‘হ্যাঁ, এবং ইংলেণ্ডের ব্যবসাদারেরাও সোরগোল বাঁধিয়ে দিয়েছে। তাদের বক্তব্য, যখন আমরা সাতসমুদ্র তের নদী পারে ভারতবর্ষের রাজ্য চালাতে পারছি, তখন আর ইংলেণ্ডে। পারব না!’ এ জন্য রাজ-শক্তিকে তারা নিজেদের হাতে তুলে নিতে চায়, যদিও রাজাকে সরিয়ে দিয়ে নয়।’
‘আপনি বলেছিলেন, ইংলেণ্ডের রাজার হাতে শাসন-ক্ষমতা নেই।’
‘হ্যাঁ! এটা গোর-ব্যবসায়ীদের চালাকি। আমার খুব দেশ-ভ্রমণের সখ ছিল। সুবি পেয়ে আমি কোম্পানীর চাকরি নিলাম। চাকরি যদি না করতাম তবে ব্যবসায়ীরা আমাকে সন্দেহ করত এবং দেশ পর্যটন আমার পক্ষে অসুবিধাজনক হয়ে পড়ত! তাই আমি দু’বছর কোম্পানীর দাসত্ব রূপ নরকে ছিলাম।’
‘ভালো মানুষের কাছে এটা সত্যিই নরক। এখানে সে-ই শুধু থাকতে পারে, যে সকল পাপেই সিদ্ধহস্ত, সমস্ত অপমান সহ্য করে শুধু টাকা রোজগারের জন্যেই যে সৃষ্টি হয়েছে। কর্নওয়ালিসের এক অনুচরের কৃপায় পাপের প্রতিদান হিসাবে চারটি গ্রামের এক জমিদারী। আমি পেয়েছিলাম, কিন্তু তার প্রতিফলও পেয়েছি আমি-আমার বউ, ছেলে মেয়ে সব মরে গেছে। ঐ জমিদারীর নামে আমার প্রাণ কাঁপে, আমিও আজ। আপনার সঙ্গে একমত। সাম্যমৈত্রী-স্বাধীনতার রাজ্যই পৃথিবীকে স্বর্গে পরিণত করতে পারে।’
‘কিন্তু এই একমত হওয়াতে বা তার আশা করাতে কিছু হবে না। এর জন্য ফ্রান্সের মতো সহস্ৰ সহস্ৰ লোককে আত্মবলি দিতে হবে। এই আত্মবলি চুপি চুপি দিলে কাজ হবে না। ভারতবষীয় সিপাইরাও তো ইংরেজের জন্যে লাখে লাখে আত্মবলি দিচ্ছে। এই আত্মবলি দিতে হবে নিজেদের মঙ্গলের জন্য এবং সব জেনে বুঝে।’
‘জেনে, বুঝে আত্মবলি!’
‘জানা-বোঝার মানে হল, ভারববাসীর পৃথিবী সম্পর্কে জ্ঞান দরকার। বিজ্ঞান মানুষের হাতে জোরালো শক্তি যুগিয়ে চলেছে। এই বিজ্ঞানের বিশেষ জ্ঞান দিয়ে মানুষ বন্দুক বোমা বানিয়েছে, নিজেকে সবল করে তুলছে। এই বিজ্ঞানই তোমাদের দেশকে ধ্বংস করে ইংলণ্ডে নতুন কলকারখানা এবং নতুন শহর তৈরি করে চলেছে। বিজ্ঞানের শরণতোমাদেরও নিতে হবে।’
‘তারপর?’
‘তারপর ভারতবর্ষের ছোঁয়াছুঁয়ি, জাত-পাত, হিন্দু-মুসলমান-সব কিছুর ভেদাভেদ মেটাতে হবে। দেখছি না, আমরা জাত-বিচার করি না।’
‘হ্যাঁ সেটা ঠিক কথা।’
‘ইংরেজদের মধ্যে ধনী দরিদ্র ছাড়া আর কি কোনো জাত-বিচার আছে?’
‘না। কিন্তু তারপর?’
‘সহমরণ বন্ধ করতে হবে। প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ স্ত্রীলোককে আগুনে পোড়ানো—তুমি কি মনে কর, একে ভগবান কোনোদিন ক্ষমা করবেন?’
কলকাতায় পৌঁছে পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে-এই চিন্তায় কোলম্যান ও তিনকড়ি দে বিষণ্ণ বোধ করল। সবশেষে কোলম্যান বলেছিল, ‘বন্ধু আমরা উনবিংশ শতাব্দীতে এসে পড়েছি। পৃথিবীতে প্রচণ্ড ওলট-পালট চলেছে। এতে আমাদের অংশগ্রহণ করতে হবে। আর এ জন্য প্রথম প্রয়োজন হল, ছাপাখানা এবং সংবাদপত্র চালু করে দুনিয়ার হালচাল। সম্বন্ধে জনসাধারণকে ওয়াকিফহাল করা।’
এ বছর বর্ষা হয়নি। জ্যৈষ্ঠের মাটি শুকনো পড়ে রয়েছে। আউশ বা রবিশস্য এক ছটাকও হয় নি। পরিবারের পর পরিবার মরে গিয়েছে অথবা তল্পিতল্পা গুটিয়ে পালিয়েছে। শীর্ণ লম্বা বিলের জল শুকিয়ে গেলে দেখা গেল, পঁচিশ মাইল দূর-দূরান্তের লোককে তার : গহ্বরে মারে পড়ে থাকতে। এরা পদ্মমূল খুঁজতে এসেছিল। আর এর জন্য কতবার নিজেদের মধ্যে ঝগড়া হয়েছে তার ঠিক নেই। পরের বছর বর্ষা যখন এল, প্রথম ফসলে রেখা হাত লাগল। গমের বীজ বুনতে বুনতে মঙ্গরীকে দেখে বিস্মিত হচ্ছিল সে। একটা বছরে যেন পৃথিবীতে কত পরিবর্তন ঘটে গেছে বলে মনে হচ্ছে। অধিকাংশ লোকই মরে গিয়েছিল, বহু পরিবারের লোকজন দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল। রেখা এই ভেবে আশ্চর্য হল, কি করে তারা দুটি প্রাণী দেহ,মনকে এক করে রেখে এক সঙ্গেই বেঁচে আছে! অতীতে। অনাবৃষ্টির ফলে দুর্ভিক্ষ হয়েছে কিন্তু এত কষ্ট সম্ভবত রেখার পূর্বর্তী কৃষকদের ভোগ করতে হয়নি। সে সময় একমাত্র গর্ভনমেন্টই ছিল, আর দুর্দিনে তাকে খাজনা কম দিলেও চলত। এখন কোম্পানীর সরকারের নিচে জমিদারের জবরদস্ত সরকার রয়েছে, যাদের লস্কর-পেয়াদার কবল থেকে একটা খড়-কুটোও রেহাই পায় না। কোনো ফসল দেড়মাস বাঁচিয়ে রাখা যায় না, ফলে ভবিষ্যৎ আকালের জন্যে কৃষকেরা কিছুই সঞ্চয় করে রাখতে পারে না।
অগ্রহায়ণ মাসে মঙ্গরী যখন একটি ছেলের জন্ম দিল, তখন আরও বিস্মিত হল রেখা। তার নিজের বয়েস পঞ্চাশ হয়েছে বলে নয়, কারণ মঙ্গরীর বয়েস ত্রিশ বছর এবং আরও কয়েকটি মৃত সন্তানের জননী হয়েছিল সে। তার বিস্মিত হবার কারণ হল, দুর্ভিক্ষের দিনে যখন নিজের অস্থিচর্মকে জীইয়ে রাখাই মুস্কিল তখন মঙ্গরী এক নতুন প্রাণীকে কেমন করেজীইয়ে রেখে জন্ম দিল!
মাঘ মাসে রামপুরের জমিদার হাতী-ঘোড়া, পাইক-পেয়াদা সঙ্গে নিয়ে দয়ালপুরে এল। রেখা শুনেছিল, জমিদারের ঘরে একটি ছেলেমেয়েও শুকিয়ে যায়নি। দুর্ভিক্ষের সময়ে তার ঘরে সাত বছরের পুরনো চাল খাওয়া হয়েছে। জমিদারের কাছারি ছিল গ্রামের এক প্রান্তে, তার সামনে পঁচিশ একর জমি জুড়ে এক আমবাগান তৈরি করা হচ্ছিল। তাতে প্রয়োজনীয় জল-ঢালা ও মাটি খোঁড়ার কাজে দয়ালপুরবাসীদের বেগার দিতে হত। প্রতি ঘরের লোকের ওপর মালিক পঞ্চাশটি করে আমগাছের চারার ভার দিয়ে রেখেছিল। চারাগাছা শুকিয়ে গেলে একটির জন্য পাঁচ সিকি দণ্ড দিতে হত। রেখার পরবর্তীরা জমিদারের অত্যাচারকে সনাতন বলে মেনে নিতে আরম্ভ করেছিল। তাদের কাছে সোবরণ রাউৎ এবং রেখা ভগতের বাণত জমিদারের রূপ এবং গ্রামে পঞ্চায়েতের কাজ-এ সবই গল্প বলে মনে হত। আকালের পর মালিকের পেয়াদারা আরও উদ্ধৃঙ্খল হয়ে উঠেছিল। তারা ভাবত, কৃষকের মনোবল ভেঙে দিতে এবং মালিকের দাপট বাড়িয়ে তুলতেই আকালের আগমন হয়। আগ্রহায়ণ মাসে যখন রেখার চালে লাউগাছের ফল ধরতে শুরু করল, তখন থেকেই জমিদারের পেয়াদারা ঘোরাঘুরি করতে আরম্ভ করে। লোকে বলত, আকালের পর রেখার মেজাজ চড়ে গেছে। রেখার কাছে ওটা ভুল বলে মনে হত–কিন্তু কথাটা সত্যিই। বস্তুত, আকালের পরে গ্রামের অন্যান্য মানুষদের আত্মসম্ভ্রমবোধ যতটা নিচে নেমে গিয়েছিল, তার তুলনায় রেখা ছিল অনেক ওপরে। এই জন্যই তার ব্যবহার অন্যের কাছে রুক্ষ বলে মনে হত। পাইক-চৌকিদারকে নিজের ঘরের কাছে ঘুরতে দেখলে রেখা ভয়ানক রেগে যেত, যদিও মুখে সেটা প্রকাশ করত না। একদিন চৌকিদার দেওয়ানজীর জন্য লাউ পোড়বার জন্যে রেখার ঘরের চালের ওপর উঠল। রেখা ঘরে বসে ছেলে সুখারীকে কোলে নিয়ে আদর করছিল। চালের ওপর মচুমচ শব্দ হতেই সুখারীকে মাদুরের ওপর রেখে বাইরে এল। দেখল চৌকিদার চালার ওপর উঠে। লাউ, ছিড়ছে। তিনটি ইতিমধ্যেই ছিঁড়েছে, চতুর্থটি ছিড়বার জন্যে হাত বাড়িয়েছে। রেখার দেহে যেন আগুন জ্বলে উঠল। অর্ধেক গ্রাম শুনতে পায়, এমনি জোরে চীৎকার করে সে বলল, ‘কে হে?’