‘হ্যাঁ, কর্নওয়ালিস।’
‘ঠিক বলেছ। বিলাতের পয়লা নম্বরের কসাই জমিদার। এখানে এসে সে দেখল, যতদিন কৃষকেরা জমির মালিক থাকবে ততদিন অনাবৃষ্টি ও প্লাবনের সময় ঠিক মতো খাজনা আদায় হবে না। সে এ কথাও ভাবল, সাতসমূদ্র তেরনদীর পারের দেশ থেকে আগত ইংরেজদের এ দেশের কিছু লোকের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে হবে-আর তা হবে এমন সব লোকের সঙ্গে, যাদের স্বাৰ্থ ইংরেজদের স্বার্থের সঙ্গে একসূত্রে বাঁধা। জমিদার হল ইংরেজদের সৃষ্ট। কৃষক-বিদ্রোহে ইংরেজদের যেমন বিপদ, তেমনি জমিদারের বিপদ। জমিদারী, সম্পত্তি এবং সম্ভ্রম চলে যাওয়ারও সমূহ আশঙ্কা। এই জন্য ছোট-ছোট কৃষকদের মালিক বলে স্বীকার না করে যদি পঁচিশ-পঞ্চাশটা গ্রামের বড়-বড় মালিক জমিদার সৃষ্টি করা যায়, তবে তারা সুসময়-দুঃসময় সর্বদাই কাজে আসবে। এইভাবে বিলাতের এই কসাই ভারতবর্ষের কৃষকদের গলা কেটে রেখেছে।’
‘কেটে যে রেখেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই’-নিজের জমিদারীর কৃষকদের কথা মনে পড়ল তিনকড়ির।
‘জায়গীরদারদের জুলুমে সারা দুনিযার লোকই মরছে; তবে এদের দিনও ফুরিয়ে এসেছে। ফ্রান্সের রাজা-রাণীকে কয়েক বছর আগেই প্রজারা মেরে ফেলেছে। তাদের ক্ৰোধাগ্নিতে বহু জমিদার পুড়ে খাক হয়ে গেছে। জমিদারী প্রথা তুলে দেওয়া হয়েছে। সেখানকার লোকেরা সকল মানুষের জন্য সাম্য, মৈত্রী এবং স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে। সে সময় আমি ফ্রান্সে ছিলাম। ফ্রান্সের রাজপ্ৰসাদের ওপর ফ্রান্সের প্রজাতন্ত্রের তেরঙা ঝান্ডা আমি নিজের চোখে উড়তে দেখেছি। ইংলণ্ডেও ফ্রান্সের মতোই অবস্থা হত, কিন্তু একটা ব্যাপার তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে।’
‘কি ব্যাপার সাহেব?’
‘দেখছি না বিলিতি কারখানার তৈরি জিনিসে ভারতবর্ষের বাজার ছেয়ে গেছে? তোমাদের এখানে তাঁতীরা বেকার হয়ে পড়েছে আর আমাদের দেশের ব্যবসায়ীরা কারখানা খুলে তাতে জমিদারের অত্যাচারে খেতে-না-পাওয়া লোকদের কাজ দিয়েছে! তাদের তৈরি মাল এখানে পৌঁছাচ্ছে। এতদিন পর্যন্ত আমাদের দেশেও হাত দিয়েই কল চালানো হত, কিন্তু এখন স্টীম-ইঞ্জিন তৈরি হচ্ছে, আর ঐ কলের কাপড় অনেক সন্তায় পাওয়া যায়। ফলে তোমাদের দেশের কারিগররা তো একেবারেই ধ্বংস হয়ে গেল। তবে এখন এই সব কারখানায় মজুর হয়ে পেট চালাবার মতো কাজ তারা পেতে পারে। যদি এই কারখানাগুলো খোলা না হত, তবে আমাদের দেশেও ফ্রান্সের দশাই হত। মানুষকে মানুষের মতো বেঁচে থাকতে দিতে হবে, মিঃ দে। অপরকে যে পশু বলে মনে করে, নিজেকেই তার ছেলেপিলেসহ পশু হতে হয়।’
‘ঠিক বলেছ সাহেব। আমি নিজের কর্মচারী এবং চাকরীদের মানুষ বলেই মনে করতাম না। কিন্তু একই ব্যবহার যখন সাহেবরা করতে লাগল আমার সঙ্গে, তখন বুঝতে পারলাম যে, মানুষকে অপমান করা কত বড় পশুর কাজ।’
‘দাস-প্রথা তুলে দেবার জন্য বিলেতে প্রবল চেষ্টা হচ্ছে।’
‘বিলাতেও দাস-প্রথা চলতে দেওয়া হয়?’
করি, শীগগিরই এর বিরুদ্ধে আইন পাশ হয়ে যাবে।’
‘ধনীরা তো এ সব চায়ই না, আর আমাদের পার্লামেন্টে ধনীদেরই প্রভুত্ব, কিন্তু এখন। তাদের মধ্যেই কিছু লোক একে খারাপ বলে মনে করছে। যাই হোক না কেন, মানুষ কেনাবেচার যারা পক্ষপাতী নয়। তারাও পাপ-পূণ্যের বিচারেই যে একে উঠিয়ে দিতে চায় তা নয়। তারা সম্পূর্ণ অন্য কারণে চাইছে। আজকাল অনেক কারখানায় দাসেরা কাজ করছে,–তারা যে সব যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজ করে তার দাম অনেক, অথচ মূল্যবান যন্ত্রগুলির ওপর কোনো মমতা নেই দাস-শ্রমিকদের, তাই সূক্ষ্ম কাজের ভার দাসদের দেওয়া যায় না। যার। জীবন-মরণ নিয়ে তুমি রাতদিন খেলা করছ, সে তো সুযোগ পেলেই তোমার ক্ষতি করে প্ৰতিশোধ নিতে চাইবে।’
‘মা আর তার শিশুকে আলাদা করে যখন আমি বেচিতে দেখি, তখন আমার কাছে সেটা নিতান্তই অসহ্য মনে হয়।’
‘অসহ্য যার মনে হয় না, সে মানুষই নয় মিঃ দে!’
‘আমি ভাবছি ফ্রান্সের রাজাহীন রাজ্যের কথা-তাকে কি বলে সাহেব?’
‘প্রজাতন্ত্র।‘
‘প্রজাতন্ত্র কি রাজতন্ত্রের চেয়ে ভালো?’
‘প্রজাতন্ত্র সব চেয়ে ভালো ব্যবস্থা! শাহ শাহজাদা, বেগম আর শাহজাদীদের জন্যেই দেশের সম্পদের অধিকাংশ নিঃশেষ হয়ে যায়! পঞ্চায়েতী রাজ্যের সরকারের কাছ থেকে অধিক ন্যায়, নিরপেক্ষতা এবং সহানুভূতি পাওয়া যায়।’
‘ হ্যাঁ, আমি আগে আমার নিজের গ্রামের পঞ্চায়েতের কাজ দেখতাম, ওতে সত্যিই! বেশি ন্যায়নিষ্ঠা দেখা যেত। আর ব্যয়ের বাহুল্যে কেউই ধ্বংস হয়ে যেত না। কিন্তু যখন থেকে কর্নওয়ালিসের জমিদারেরা এসে পঞ্চায়েতকে ড়ুবিয়ে দিল, তখন থেকে লোকে শেষ
‘এ কথা ঠিকই বলেছ মিঃ দে, কিন্তু ফ্রান্সের জনতার উদ্দেশ্য প্রজাতন্ত্রের চেয়েও মহৎ ছিল, তারা মানুষ মাত্রেরই সাম্য, স্বাধীনতা এবং মৈত্রী এই তিন মূল ভিত্তির ওপর রাজ্য প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিল।’
‘আমাদের দেশের জন্যেও?’
‘তোমরা কি মানুষ নও?’।
‘সাহেবদের চোখে তো আমরা সত্যিই মানুষ নই!’
‘যতদিন পর্যন্ত সমগ্র দুনিয়ার সাদা-কালো সমস্ত জাতির শাসনব্যবস্থা সাম্য-মৈত্রী স্বাধীনতার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত না হবে, ততদিন মানুষ, মানুষ হিসেবে গণ্য হতে পারে না। কসাই কর্নওয়ালিস তার নিজের জাতের গোরা কৃষকদের মানুষ বলে মনে করত না। ফ্রান্সের রাজা, জমিদাররা তো খতম হয়ে গেছে, কিন্তু বানিয়ার দল-ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর জাতভাইরা রাজ্য দখল করে নিয়েছে, যার জন্য সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার আসল তেরঙা ঝাণ্ডা ফ্রান্সেও উড়তে পারেনি।’