রেখা, ‘তোমার কথায় হাসিনি মুন্সীজী, হাসছি। এই জন্যে যে, কোম্পানী বাহাদুর রাজত্বও করেছে, আবার ব্যবসাও চালাচ্ছে। এমনি মজার রাজত্ব!’
ভোলাপণ্ডিত, ‘সত্য, ত্রেতা, দ্বীপর-তিন যুগ পার হয়ে গেছে। কলিযুগের পাঁচ হাজার বছর কেটে গেছে। কিন্তু এমন রাজত্ব কখনও ছিল বলে তো শুনিনি!’
মুন্সী, ‘নাজিমের দরবারে এক মুন্সী কোম্পানীকে ফিরিঙ্গী-ডাকাত আখ্যা দিয়েছে, আর একজন বলেছে, কোম্পানী হল ফিরিঙ্গী ব্যবসাদারদের আড্ডা। ওরা শুধু ব্যবসার জন্যেই নিজেদের দেশ থেকে এসেছে। প্রথমে এখানকার মাল ওখানে নিয়ে বেচত, কিন্তু এখন ওরা বিলাতে বড়-বড় কারখানা খুলেছে—সেখানে নিজেরাই মাল তৈরি করায় আবার নিজেরাই সেটা বিক্রি করে।’
মৌলা, ‘তাহলে বোঝা যাচ্ছে, কারিগরদেরও আর উন্নতির আশা নেই।’
২.
শীতের গঙ্গা সবুজ আকার ধারণ করে এবং তার স্বাভাবিক গাম্ভীর্যময় গতি আরও গভীর রূপ নেয়। এই সময় নৌকাড়ুবির ভয় কম থাকে এই জন্য ব্যাপারীরা এই সময়টাকে ব্যবসায়ের মরসুম বলে মনে করে। এই সময় গঙ্গার পারে ঘণ্টা কয়েক বসে থাকলেই দেখা যাবে, শত শত বড় নৌকা সামনে দিয়ে যাচ্ছে। এগুলোর মধ্যে অধিকাংশতেই, কোম্পানীর মাল বোঝাই থাকে–তার মধ্যে বহু মালই আসে বিলাত থেকে এবং সেগুলো ওপরের দিকে যায়। আর পাটনা, গাজীপুর মির্জাপুরের মতো তেজারতী শহরের ঘাট থেকে দেখা যায়, গঙ্গার চারিধার বড় বড় নৌকায় ভর্তি।
পাটনা থেকে একটি বজরা নিচের দিকে যাচ্ছিল। এতে সোরা, জাজিম ইত্যাদি বহু জিনিস বিলাতে চালান যাবার জন্যে ছিল। এরই একটা নৌকায় যাচ্ছিল বঙ্গসন্তান তিনকড়ি দে আর বিলিতি সাহেব কোলম্যান। পাটনা থেকে কলকাতা যেতে এক সপ্তাহের বেশি সময় লাগে, সুতরাং তিনকড়ি দে আর কোলম্যানের ভিতর ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠল। যদিও প্রথমে একে অপরের সঙ্গে দেখা হলে সঙ্কুচিত হয়ে উঠত। তিনকড়ি দের কাছে জুলক্ষী, আঁটোসাটো প্যান্ট, ফিতায় ঝোলানো বোতাম এবং কালো কোট পরিহিত শ্বেতমুখ ভয় এবং ভক্তির বস্তু ছিল। কিন্তু কোলম্যানই প্রথম আলাপ শুরু করায় তিনকড়ির সাহস বেড়ে উঠছিল। আলাপ-আলোচনায় তিনকড়ি বুঝতে পারল যে, কোলম্যান কোম্পানীর সাহেবদের ঘোরতর বিরুদ্ধে এবং গর্ভনর থেকে আরম্ভ করে কোম্পানীর ছোট বড় কাউকেই গালাগাল দিতে দ্বিধা করে না। তিনকড়িও কোম্পানীর চাকরদের বরদাস্ত করতে পারত না। বিশ বছর কোম্পানীর বড় বড় দপ্তরে সে কেরানীর কাজ করেছে। গরীবের ঘরেই সে জন্মেছিল, কিন্তু সে ছিল তাদেরই একজন যাদের আশা সীমাবদ্ধ এবং লোভ যাদের আত্মসম্মানের সঙ্কীর্ণ গন্তীতে আবদ্ধ। অবশিষ্ট জীবনের মতো খাওয়া পরার মতো সংস্থান করে নিয়েছিল তিনকড়ি। কোনো পুরনো এজেন্টের দয়ায় সে চব্বিশ-পরগণা জেলায় চারখানা গ্রামের জমিদারী পেয়েছিল, যার আয়ের তুলনায় খাজনা ছিল অনেক কম। কিন্তু এই দয়াটুকু পাবার জন্য এমন কাজ তিনকড়ি করেছিল, যার পাপ জন্ম-জন্মান্তরে মোচন হবে না বলে তার বিশ্বাস। সাহেবকে খুশী করবার জন্যে গ্রামের এক সুন্দরী ব্ৰাহ্মণ তরুণীকে তুলে দিয়েছিল সাহেবের হাতে। সাহেবরা সে সময় খুব কমই বিলেত থেকে নিজেদের মেম সঙ্গে করে আনত। কারণ ছ’মাসের বিপদ ঘাড়ে করে সমুদ্ৰ-যাত্রা বড় সহজ ব্যাপার ছিল না।
তিনকড়ির বয়স পঁয়তাল্লিশ। তার সুঠাম কালো দেহের কাঠামো খুবই বলিষ্ঠ। রোজ সকালে উঠে সে আয়নায় নিজের মুখ দেখত। আর হাতের আঙ্গুলগুলো পরীক্ষা করত, • কোনদিন তার দেহে কুণ্ঠ রোগ ফুটে বেরুবে-সেই আশঙ্কায় সে থাকত, কারণ ব্ৰাহ্মণীর সতীত্বনাশের এই শাস্তি তার কপালে আছে বলে তার মনে হত। সাহেবদের খিটমিটি, ‘ গালাগালি আর পায়ের ঠোক্কর সয়ে সয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল! তাই চাকরির বয়স থাকলেও কাজে ইস্তফা দিয়ে সে গ্রামে ফিরে আসছিল। বিশ বছর নীরবে সহ্য করা অপমানের আগুনে তার অন্তর জ্বলে যাচ্ছিল। যখন সে কোলম্যানকে নিজের চাইতেও কোম্পানীর বড় শত্রু বলে বুঝতে পারল, তখন ধীরে ধীরে দু’জনের আলাপ চলতে লাগল। কোলম্যান একদিন বলছিল, ‘ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী তৈরি করা হয়েছিল বাণিজ্যের জন্য, কিন্তু পরে এরা লোককে লুট করতে শুরু করে। দেখছি না, যত সাহেব এখানে আসে, সবাই দুদিনের ভেতর লাখপতি হয়ে দেশে ফিরে যায়। ছোট-বড় সবারই এই অবস্থা। ক্লাইভ এই কাজই করেছে, কিন্তু তাকে কেউই ধরেনি। চেৎসিংহের রাণীরা অনাহারে মরে যাওয়া সত্ত্বেও লোভের তাড়নায় ওয়ারেন হেষ্টিংস তাদের কথা ভাববার অবকাশই পায়নি। আর অযোধ্যার বেগমদের কাঙাল বানিয়ে ছেড়েছে সে। কিন্তু আমাদের দেশবাসীরা তাকে ছাড়েনি। শাস্তির হাত থেকে সে বেঁচে গেছে, কিন্তু যা কিছু সে রোজগার করেছিল, কয়েক বছরের মামলায় সবই সে খুইয়েছে।’
‘মোকদ্দমা কে চালাল সাহেব?’
‘পাৰ্লিয়ামেণ্ট। আমাদের দেশে রাজা নিজের খুশীমতো চলতে পারে না। খুশীমতো চলার অপরাধে এক রাজার গর্দন আমরা কুড়াল দিয়ে কেটে ফেলেছি, আর সে কুড়াল এখনও রয়েছে। পার্লিয়ামেণ্ট হল পঞ্চায়েত বুঝলে মিঃ দে! এদের অধিকাংশ সদস্যকেই দেশের ধনী-মানীরা নির্বাচিত করে, আর কিছু বড়-বড় জমিদার বংশগত অধিকারে এর সদস্য হয়।’
‘জমিদারী প্ৰথা কতদিন থেকে চলে আসছে?’
‘আমাদের দেশে এ প্রথা কয়েক শ’ বছর ধরে চলে আসছে। আমাদের দেশের দেখাদেখি ভারতবর্ষে জমিদারী প্রথা কায়েম হয়েছে। সেখানেও জমির ওপর থেকে কৃষকের অধিকার ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। এ দেশে জমিদারী প্ৰথা কায়েম করেছে যে গভর্নর, তার নাম জানো?’