‘মুন্সী, ‘রেখা ভগৎ কথাটা বলেছি তুমি ঠিকই। জমিদার হল জীতার একটা পাল্লা। আর রাজার চেয়ে সে কোন বিষয়েই বা কম?’
রেখা, ‘কম কোন বরং এক-কাঠি বেশি মুন্সীজী। গায়ের পঞ্চায়েতের পরামর্শ কেউ নেয় এখন? রেওয়াজ মতো আমরা এখনও পাঁচজন মোড়ল ঠিক করে দিই, কিন্তু কোনো কাজে হাত দিতে পারে তারা? সবই জমিদার আর তার আমলা-গোমস্তারা করে। গায়ের ভেতর ঝগড়া বাধলে বাদী-বিবাদী দু’জনের কাছ থেকেই তারা জরিমানা আদায় করে। পনের বছরও তো কাটেনি সোবরণ রাউৎ মেয়ে-মরদের ঝগড়ায় কখনও মোষ বিক্রি করতে দেখেছ?’
সোবরণ, ‘আরে ভাই তখন তো সব কিছুই পঞ্চায়েতের হাতে ছিল। গাঁয়ের পঞ্চায়েত কোনো পরিবারকে উচ্ছন্নে যেতে দিত না, খুনের মামলা পর্যন্ত আপোসে মিটমাট করে দিত তারা। বাঁধি আর খালগুলোর অবস্থা দেখনি। মনে হয়, ওগুলোকে দেখবার বা ওগুলোর ভার নেবার এখন আর কেউ নেই। পঞ্চায়েত যদি এখনও সক্রিয় থাকত। তাহলে কি কোনোমতেই এমনটা হতে পারত?’
রেখা, ‘কোনোমতেই হত না সোবরণ রাউৎ। বৃষ্টি বেশি হলে এমন পরিষ্কার নালা নেই, যা দিয়ে অতিরিক্ত জল বেরিয়ে যেতে পারে।’
মুন্সী, ‘পঞ্চায়েতকে ধ্বংস করে কোম্পানী এ-সব তুলে দিয়েছে জমিদারের হাতে।’
রেখা, ‘আর জমিদারেরা যে কি করছে সে তো আমরা দেখতেই পাচ্ছি।’
মুন্সী, ‘আমিও জমিদারের নিমক খাই রেখা ভগৎ। তুমি জানো, মসরিখের জমিদারের পাটোয়ারী আমি। কিন্তু এ অন্যায়ের সম্পত্তি, অন্যায়ের ধন যে খায় সে নির্বাংশ হয়ে যায়। আমাকেই দেখ, সাত ছেলে, ঘোড়ার মতো জোয়ান-সব মরে গেল!’
মুন্সীজীর চোখে জল দেখে সকলেরই হৃদয় সহানুভূতিতে ভরে উঠল।’সব মরে গোল রেখা ভগৎ ঘরে এখন জল দেবার জন্য একটা বাচ্চা মেয়েও নেই। আর আমার মালিক ছাপরার সেই রান্তীর পেছনে কিভাবে ঘুরছে। তার ইন্দ্ৰিয় শিথিল হয়ে পড়েছে।–এই যে দুটো বাচ্চাকে দেখছ, এদের লোকে তার সন্তান বলে জানে কিন্তু আসলে এরা নাপিতের ঔরসজাত।’
রেখা, ‘মালিকদের মধ্যে এ-রকম ঘটনা এখন অনেকেরই হচ্ছে।’
সোবরণ, ‘ক্ষেত গেল, গ্রাম গেল, সাত-সমুদ্র পারের দস্যুরা আমাদের ওপর দেশী ডাকাত লেলিয়ে দিল। পঞ্চায়েত গেল, যে সামান্য ফসল। আমরা ফলাই তাও কেড়ে নেওয়া হয়! আর যদি কখনও ঠিক মতো রোদ-বৃষ্টি হল, সামান্য ফসল ঘরে উঠল, তো মালিক, জমিদার, চৌকিদার, পাটোয়ারী গোমস্তার পেট ভরাতেই সব খতম।’
মুন্সী, ‘পাটোয়ারীদের লুটের কথা আমি জানি সোবরণ রাউৎ কিন্তু এও তোমরা ; জানো, জমিদার মাত্র আটআনা মাইনে দেয় পাটোয়ারীদের মাসে, আটআনা পয়সায় জিভও ভেজানো যায় না–এ কথা কি জমিদার নিজে জানে না?’
রেখা, ‘জানে মুন্সীজী, জমিদার অন্ধ নয়, সবই দেখতে পায়। কোম্পানী বাহাদুর ডাকাত-আমাদের ওপর এক নতুন ডাকাত জমিদারকে বসিয়ে দিয়ে গেছে। এতাতেও আমরা বেঁচে আছি কি করে?’
‘সোবরণ, ‘বেঁচে কোথায় আছি রেখা? পেট ভরে ভাত খেতে বা দেহে এক টুকরো কাপড় জড়াতে পারে-এমন লোক ক’টা দেখা যায় দয়ালপুরে?’
মুন্সী, ‘কোম্পানীর এতে কি এসে যায় সোবরণ রাউৎ? সে খাজনা বেঁধে দিয়েই খালাস, জমা দেওয়ার দিন ছাপরা গিয়ে জমিদারেরা টাকার তোড়া জমা দিয়ে আসে। দয়ালপুরে কৃষক মরুক আর বীচুক, কোম্পানীর পাওনা কড়ায়-গণ্ডায় আদায় করে দেওয়া
কাছ থেকে জমিদার পাঁচ টাকা নেবে-এক টাকা কোম্পানীকে দিয়ে বাকী চার টাকা নিজে গিলবে।’
রেখা, ‘হা ভগবান! তুমি কি ঘুমিয়ে আছ, না মরে গেছ? কেন তুমি সুবিচার করছ না? আমরা যে ধ্বংস হয়ে গেলাম!’
সোবরণ, ‘হ্যাঁ, শেষ হয়েই গেলাম রেখা, শোনোনি বারো-পরগণার লোকেরা একজোট হয়ে জমিদারকে তাদের মালিক বলে মানতে অস্বীকার করেছিল? তারা ছাপরা গিয়ে কোম্পানীকে বলেছিল, ‘আমাদের পঞ্চায়েত তোমাদের খাজনা মিটিয়ে দেবে, আমরা জমিদারকে মানব না।’ সাহেব কি জবাব দিয়েছে জানো? ‘অনাবৃষ্টি আর বন্যার সময়ও ঠিকমতো খাজনা দেবে? অনাবৃষ্টি, দুর্ভিক্ষ বা প্লাবনের সময় নিজেদের কাচ্চা-বাচ্চার প্রাণ। বঁচানোই মুস্কিল–তা কি ওরা জানে না, ফিরিঙ্গীর ঐ কথাটা বলতে ভগবানের ভয়ও হল না রেখা! এরপর সে কি বলেছিল জানো? ‘তোমরা তো কঙাল, খাজনা যদি না দাও তো কোম্পানী বাহাদুর কি নেবে তোমাদের কাছ থেকে? আমরা টাকাওয়ালা সম্রােন্ত লোককে জমিদার করে দিই, যাতে আমাদের খাজনা বাকী রাখলে তাদের ঘরবাড়ি নিলাম হয়ে যাবার, মান-সম্ভ্রম নষ্ট হবার ভয় থাকে।’
রেখা, ‘এই জন্যই তো ফিরিঙ্গীগুলোর সারা গায়ে শ্বেতী। বড় নির্দয় ওরা।’
‘সোবরণ, ‘বারো-পরগণাবাসীদের কোনো কিছুই নেই, কাজেই ওরা জীবনের বিনিময়ে লড়াই করে। কোম্পানী যদি বাহাদুরই হত, তবে বাহাদুরের মতোই লোকের সঙ্গে লড়ত। বারো-পরগণাবাসীদের কাছে বন্দুক’ই আছে আর কোম্পানীর লোকদের আছে কামান। এখান থেকে সেখান থেকে কালা-গোরা বহু পল্টনও এসে গেছে তাদের গ্রামের। পর গ্রাম জ্বলিয়ে দিয়েছে, নারী শিশুদেরও ছাড়েনি। বারো-পরগণার লোকদের আর কি করবার আছে?’
মৌলা, ‘চাষবাস তো এইভাবেই নষ্ট হয়ে গেল, তাঁতীদের মুখের অন্নও ঘুচাতে আরম্ভ করেছে সোবরণ রাউৎ। কোম্পানী এখন বিলাত থেকে কাপড় এনে বেচছে।’
মুন্সী, ‘ হ্যাঁ, কলের তৈরি সূতো, কলের তৈরি কাপড়। আমার এই ফতুয়া ঐ কাপড়ের তৈরি। তাঁতের কাপড় এত সস্তায় পাওয়া যায় না। কাজেই মান বাঁচাবার জন্যে এই জিনিসই। কিনতে হয়। এটা মান বাঁচাবারই প্রশ্ন-কিন্তু তুমি অমন করে হাসছ কেন রেখা? সরকারি জাজিমের ওপর বসতে হলে তখন বুঝতে।’