একখানা মোটা গামছা বিছিয়ে কাঁচালঙ্কা আর মূলো সহযোগে নুন-মাখা ছাতু পরম তৃপ্তির সঙ্গে আহার করে রেখা ভগৎ আর তার চার সঙ্গী এক আমগাছের নিচে কম্বলের ওপর। বসেছিল। রেখার মহিষ বিক্রয় হয়ে গেছে, সে থেকে থেকে ট্যাকে হাত দিয়ে বিক্রির। কুড়িটা টাকা দেখে নিচ্ছে। এই মেলায় এমন সব চোর এসেছে যার যাদুমন্ত্রে টাকা মেরে নেয়। রেখা আর একবার ট্যাকের ওপর হাত বুলিয়ে পরম নিশ্চিন্তের সঙ্গে কথা আরম্ভ করল, ‘আমাদের মোষ তো বিক্রি হয়ে গেল, তিনমাস ধরে খুব খাইয়ে-দাইয়ে আমি ওকে তৈরি করেছিলুম মৌলুভাই। ওরকম মোষের জন্যে বিশ টাকা দাম বেশি নয়। কিন্তু টাকাও আজকাল দেখতে দেখতে উড়ে যায়।‘
মৌলা, ‘ঠিকই! উড়েই যায়! এ ছাড়া টাকা-পয়সার। আজকাল অভাবও পড়ে গেছে চারিদিকে। এই কোম্পানীর রাজত্বে কোনো কিছুরই সুরাহা নেই। আমরা মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে মরে যাই, অথচ আমাদের ছেলেপুলেদের পেট–ভরা খাওয়া জোটে না এক সন্ধ্যাও!’।
রেখা, ‘এতদিন পর্যন্ত আমরা হাকিমকে নজর, বেগার এবং আমলা-পাইককে ঘুষ দেওয়ার ভিতর দিয়েই দিন কাটিয়েছি, কিন্তু জমি আমাদেরই ছিল।‘
মৌলা, ‘জমি-পুরুষ থেকে জঙ্গল কেটে জমি আবাদ করছি আমরা!’
সোবরণ, ‘মৌলুভাই, বাঘাক্ষেতের কথা জানো তো? ওখানে ভয়ানক জঙ্গল ছিল! আমাদের মুরিসূ ঘিনাবন বাবাকে ওখান থেকেই বাঘে ধরে নিয়ে যায়। সেই থেকেই ঐ জায়গার নাম ‘বাঘক্ষেত হয়েছে। প্রাণ দিয়ে আমরা সেই জমি আবাদ করেছি।’
রেখা ভোলাপণ্ডিতের দিকে তাকাল। ভোলাপণ্ডিতের রঙ কালো, পাতলা সাদা কাপড়ের পাগড়ী ঠিক করছিল। রেখা বলল, ‘ভোলাপণ্ডিত, তুমি তো সত্যযুগের কথা। জানো, বলতে পার, প্রজারা এমন দুৰ্দশায় আর কোনোদিন কি পড়েছে?’
মৌলা, ‘জানি আমরা তৈরি করেছি। চাষ-করা, বীজ-বোনা সব কাজে আমরা খেটেছি। অথচ আমাদের গ্রামের মালিক আমরা নই, রামপুরের মুন্সীজী।’
ভোলাপণ্ডিত, ‘অধর্মী রেখা ভগৎ, সর্বত্র অধৰ্ম। রাবণ এবং কংসের অত্যাচারকেও। হার মানিয়েছে কোম্পানী। পুরাণ ধর্মশাস্ত্রে লেখা আছে, রাজা পাবে কৃষকের কাছ থেকে এক দশমাংশ ফসল।’
‘মৌলা, ‘আমি তো অবাক হয়ে যাই পণ্ডিত! কোথাকার কে রামপুরের মুলী! তাকে আমাদের মালিক আর জমিদার বানিয়ে দিয়েছে?’
ভোলাপণ্ডিত, ‘সবই উল্টে গেছে মৌলু, প্রথমে প্রজাদের ওপর একজন রাজা ছিল। কৃষকেরা শুধু একজন রাজাকেই জানত। রাজা বহুদূরে আপন রাজধানীতে থাকত। শুধু ফসলের এক দশমাংশ পেলেই সে খুশী, তাও যখন ফসল হত তখন। কিন্তু এখন ফসল। হোক আর না হোক, নিজের হাড়মাংস বেচে, মেয়ে-বোনকে বেচে জমিদারের খাজনা ঠিক মতো দিতেই হবে।’
রেখা, ‘আর এই খাজনার কোনো হদিস পাওয়া যায় না পণ্ডিত। বছর-বছর খাজনা বেড়েই চলেছে! জিজ্ঞেস করবারও কেউ নেই যে, এমন অন্যায় কেন হচ্ছে।’
মুন্সী সদাসুখলাল পাটোয়ারী এসেছিল হরিহরক্ষেত্রে স্নান করতে, আর সস্তায় পেলে একটা গরু কিনতে। কিন্তু এ বছরের দুর্মুল্যতা দেখে কাঁপুনি ধরে গেছে তার। তার গায়ে ময়লা ছেড়া এক ফতুয়া এবং মাথায় টুপি। কানে এখনও খাগের মলম-দেখে মনে হয়, এখানেও বুঝি হিসাব লিখতে হবে তাকে। মসরিখের জমিদারের পাটোয়ারী বলে সে। ভাবছিল, এই আলোচনায় তার অংশগ্রহণ করা উচিত। কিনা। কিন্তু আলোচনা যখন গ্ৰাম্য রাজনীতি নিয়ে, তখন মুখ-কানওয়ালা মানুষের পক্ষে চুপ করে থাকা মুস্কিল!
দ্বিতীয়ত, দয়ালপুর গ্রাম তার মালিকের জমিদারীতে নয়। কাজেই দয়ালপুরের–কৃষকদের কথাবার্তায় অংশগ্রহণ করায় কোনো ক্ষতি আছে বলে সে মনে করল না। কলমটাকে আঙ্গুলে ঘোরাতে ঘোরাতে মুন্সীজী বলল, ‘কেউ জিজ্ঞেস করতে পারে কিনা বলছ পণ্ডিত? কে জিজ্ঞেস করবে? এখানে তো সবাই পরের ধন লুট করে খায়। যত পার। লুটে খাও। কোনো রাজা নেই। নাজিম সাহেবের দরবারে আমার মাসতুত বোনের এক জামাই থাকে, অনেক গোপন তথ্যই সে জানে। একশো-দুশো ফিরিঙ্গি ডাকাতের দল জেকে বসেছে। এই দলকেই তারা নাম দিয়েছে কোম্পানী।’
রেখা, ‘ঠিক বলেছ মুন্সীজী, ‘কোম্পানী বাহাদুর’ শুনে-শুনে আমরা ভেবেছিলাম,, কোম্পানী কোনো রাজা হবে বুঝি, কিন্তু আসল কথাটি আজ বুঝলাম।’
মৌলা, ‘সেই জন্যেই তো যেদিকে তাকাও সেই দিকেই দেখবে লুট চলছে। ন্যায় অন্যায়ের খোঁজ-খবর করবার কি কেউ আছে? এই রামপুরের মুন্সীজীর সাত পুরুষের কখনও দয়ালপুরের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক ছিল না।’
সোবরণ, ‘আমার তো মৌলুভাই মাথায় ঢোকেনা যে, এই রামপুরের মুন্সী আমাদের গাঁয়ের মালিক হয়ে গেল কি করে! শুনতে পাচ্ছি দিল্লীর বাদশাহের সঙ্গে কোম্পানীর না-কি
মুন্সী, ‘দিল্লী নয় সোবরণ রাউৎ, মকসুদাবাদের (মুর্শিদাবাদের) নবাবের কাছ থেকে এই অঞ্চল কোম্পানী লিখিয়ে নিয়েছে। দিল্লীর তখৎ থেকে আমাদের এই অঞ্চলকে মাকসুদাবাদ আগেই ছিনিয়ে নিয়েছিল, সোবরণ রাউৎ।’
সোবরণ, ‘আমাদের এত কথা মনে থাকে না মুন্সীজী, আমরা তো শুধু দিল্লীর কথাই জানতাম। আচ্ছা মকসুদাবাদের হাতেও যখন রাজ্য এল, তখনও তো একটাই রাজা ছিল? আমাদের যেমন জুটত তেমনই খাজনা দিতাম। কিন্তু এখন একে দুই রাজার রাজ্য বলবে, না কি বলবে?’
রেখা, ‘দুই রাজাই হয়েছে সোবরণ ভাই–এক কোম্পানী-রাজ আর দ্বিতীয় রামপুরের মুন্সীজীর রাজ। জীতার এক পাল্লায় পিষলে বীচার আশা কিছুটা থাকে, কিন্তু দুপাটে পড়লে বাঁচা একেবারেই অসম্ভব। আর এ ব্যাপার তো আমরা নিজেদের চোখেই দেখতে পাচ্ছি। মুন্সীজী তুমিই বল! আমরা তো গেয়ো মুৰ্থ, আনাড়ী, তুমি এবং ভোলাপণ্ডিতই আমাদের মধ্যে জ্ঞানী।’ e