‘কিন্তু কমল এ-সবের মধ্যে সত্যতাও কি কিছু নেই। ফ্লোরেন্সের কৃষকের সঙ্গে তুলনা কর ভারতবর্ষের কৃষকের, এখানে কি সেই নগ্ন-জীর্ণ কঙ্কালসার চেহারা কোথাও দেখা যায়?’
‘না প্রিয়ে, আর তার কারণ হল এই যে, এখানে শাহী শান্য-শোকতে কোটি-কোটি টাকা ব্যয় করা হয় না।’
‘ভেনিসের ধনকুবেররা অনেকেই আমাদের কোটিপতিদের হার মানায়।’
‘আমাদের কোটিপতিরা এক লাখের ওপর এক নিশান ওড়ায়! আমি ভাবতাম। চৌবাচ্চা-ভরা এত টাকা আর মোহর অন্ধকারে পড়ে থেকে কি লাভ হয়? টাকা তো এক হাত থেকে আর এক হাতে ঘোরা উচিত। এই গতিশূণ্যতার কারণে মিঠাঁই-মণ্ডা নিজের জায়গায় পড়ে শুকোয়, ফল নিজের জায়গায় পড়ে থেকে পাঁচে। গুদামের কাপড় পোকায় কাটতে থাকে। অথচ এইসব পুঁতে রেখে আমাদের শেঠেরা তার ওপর লাল নিশান ওড়ায়। লোকে বলে, এর যখন একশ’ নিশান রয়েছে, তখনও শেঠ ক্রোড়মল।’
সূর্যের রক্তিম আভা কিছুক্ষণ হল মিলিয়ে গেছে। চারিদিকে এখন অন্ধকারের ছায়া, সমুদ্রলহরী পাথরের গায়ে আছাড় খেয়ে একটানা শব্দ করে চলেছে, তরুণ-তরুণীরা এখনও বালুতটে ছেড়ে উঠতে চাইছে না। সমুদ্রকে সূরৈয়া ও কমল সত্যিকারের সঙ্গী বলে গ্রহণ করে নিয়েছে। যদিও তারা শুধু জলপথেই ভ্ৰমণ করেনি, তবু জানত, তাদের সম্মুখে অবস্থিত এই সমুদ্রের একাংশ ভারতের মাটি স্পর্শ করে আছে। তাই কখনও কখনও তাদের মনে প্রশ্ন উঠত, এপারের সঙ্গে মিলন ঘটানো যায় কি! অনেক রাতে ফিরতি পথ ধরল তারা। অন্ধকার এই রাত এবং সেই সঙ্গে নিজের অবস্থা উপলব্ধি করে। সুরৈয়া বলল, ‘আমাদের বাদশাহ নিজ রাজ্যে শান্তি স্থাপনের জন্যে যথেষ্ট চেষ্টা করেছেন, এবং তাতে বহুলাংশে সফলতাও লাভ করেছেন। কিন্তু সেখানে কি এমন নিঃশঙ্ক হয়ে বেড়াতে পারি আমরা!–কেন পারি না কমল?’
‘এখানে সকলের অবস্থাই ভালো। কৃষকের ক্ষেতে আঙ্গুর, গম এবং অন্যান্য ফসল যথেষ্ট উৎপন্ন হয়।’
‘আমাদের দেশের জমিতেও তো সোনা ফলে!’
’কিন্তু সেই সোনা লুটবার লোকও যে আমাদের দেশে অনেক!’
‘আর একটা জিনিস দেখছ তো কমল, এখানে কারও বাড়ি গেলে সঙ্গে সঙ্গে কেমন মদের বোতল-গ্লাস এনে হাজির করে টেবিলে।‘
‘ভারতবর্ষে কিন্তু আমার বাবার এই জন্যেই বদনাম ছিল যে, তিনি বাদশাহর সঙ্গে বসে মদ্যপান করে থাকেন।’
‘আর আমার বির-রা আমাকে কি শেখাত জান! বলত ‘রাজপুতানীরা বড় নোংরা, তাদের ঘরে শুয়োর রান্না হয়।’ এখন আমার মনে হয়, ওখানকার অন্ধরা এখানে এলে বুঝত যে, দুনিয়ায় ছোট-বড় জাত বলে কিছু নেই।’
‘পান-ভোজনে জাত-পাতের বালাই নেই এখানকার দুনিয়ায়।’
‘ফ্লোরেন্স বেশ একুতাবদ্ধ দেশ, একদিন হয়ত ভারতবর্ষও এমনি একতাবদ্ধ হবে।’
‘সেটা তখনই হবে, যখন আমরা সবাই সমুদ্রকে জয় করতে পারব।’
‘সমুদ্র-বিজয়!’
‘ভেনিস সাগর-বিজয়িনী নগরী, সুরৈয়া। ভেনিসের এই খালের পথ, এই সুউচ্চ প্রাসাদসমূহ ঐ সমুদ্র-বিজয়েরই প্রাসাদ। সমুদ্র-বিজয়ে ভেনিস আজ আর একা নয়,–বহু প্রতিদ্বন্দ্বী তার রয়েছে। আমার কিন্তু এ কথাই মনে হয় যে, পৃথিবীতে এখন সমুদ্রজয়ীদের শাসনই প্রতিষ্ঠিত হবে। আমার নিজের মনও ঐ সমৃদ্ৰ-বিজয়ের দিকেই আকৃষ্ট হয়েছে বলে নিজেকে সৌভাগ্যবান বলে মনে করি আমি।’
‘তুমি কি সব অত বই নিয়ে রাতের পর রাত পড়াশুনা কর প্রিয়তম? তাছাড়া বইপত্র পাওয়া কত সহজ এখানে!’
‘আমাদের দেশেও সীসা রয়েছে, কাগজ এবং সুদক্ষ কারিগরও রয়েছে। কিন্তু আমরা এখনও ছাপার কাজ শিখিনি। আমাদের দেশে যদি ছাপাখানা খোলা হয়, তবে জ্ঞানার্জন অনেক সুলভ হয়ে উঠবে। এই যে এত বই পড়ছি, সপ্তাহের পর সপ্তাহ নাবিকদের মধ্যে কাটিয়ে দিচ্ছি, এর ফলে আমি ক্রমেই স্থির নিশ্চিত হয়ে উঠছি যে, সমুদ্র বিজয়ী দেশই বিশ্বজয়ী শক্তিরূপে বিরাজ করবে। প্রত্যহ স্নান না করার জন্য এই সব ফিরিদীদের আমাদের দেশের লোকেরা নোংরা বলে, কিন্তু এদের অনুসন্ধিৎসার প্রশংসা না করে থাকতে পারি না। ঘরে বসে ভূগোলের গল্প রচনা না করে এরা সর্বত্র ঘুরে বেড়িয়ে সম্যক জ্ঞানার্জন করে। এদের তৈরি মানচিত্র তো আমি তোমাকে দেখিয়েছি সুরৈয়া।’
‘সমূদ্র আমার বড় ভাল লাগে কমল!’
‘শুধু ভালো লাগা নয়। সুরৈয়া, সমুদ্রের ওপরই দেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। এই কাঠের জাহাজের ওপর রক্ষিত কামানটিকে দেখছ তো? এই সব জাহাজ বল এক একটা ভাসমান দুর্গ। মোঙ্গলরা তাদের জয়যাত্রার জন্য ঘোড়া এবং বারুদের কাছে সম্পূর্ণ ঋণী। আর এখন পৃথিবীতে যাদের কাছেই এইসব যুদ্ধজাহাজ থাকবে তারাই জয়ী হবে। এই জন্যই আমি এ বিদ্যা অর্জনের সঙ্কল্প করেছি।’
কমল এবং সুরৈয়ার সাধ পূর্ণ হল না। জলপথে ভারতবর্ষের দিকে যাত্রা করেছিল তারা, কিন্তু সেটা ছিল জলদস্যুদের যুগ। সুরাটে পৌঁছাবার মুখে জলদস্যুরা তাদের আক্রমণ করল। সঙ্গীদের নিয়ে কমল তার বন্দুক এবং কামান চালিয়ে যেতে লাগল দস্যুদের ওপর। দস্যুরা ছিল সংখ্যায় অনেক বেশি। কমলের জাহাজ গোলাবিদ্ধ হয়ে জলে ড়ুবে যেতে। লাগল। সুরৈয়া তার কাছেই ছিল, তার ঠোঁটে মৃদুহাসি ফুটে উঠল, তার মুখের শেষ কথা হল—‘সমুদ্র-বিজয়’!
১৭. রেখা ভগৎ (কাল : ১৮০০ খৃষ্টাব্দ)
কার্তিকের পূর্ণিমা। এই সময় গণ্ডক-স্নান (নারায়ণী) এবং হরিহর দর্শনের খুব ভিড়। দূর দূরান্ত থেকে গ্ৰাম্য নর-নারীরা বহু্যত্ন-সঞ্চিত অর্থ এবং ছাতু-চাল নিয়ে হরিহরক্ষেত্রে এসে পৌঁছায়। বাগানের মধ্যে কিছু বলদ, ঘোড়া আর হাতী বঁধু-এ সব দেখে তখন কে ভাবতে পেরেছিল যে, এটাই ভবিষ্যতে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ মেলায় পরিণত হবে!