‘কিন্তু দেখতে বড় সুন্দর কমল।’
‘এই দেখ সুরৈয়া-এটার কি রং বলতে পার?’
‘গোলাপী।’
‘ঠিক যেমন তোমার দুটি গাল।’
‘ছোটবেলায় তুমি এমনি করেই বলতে, কমল।’
‘ছোটবেলোয় সুরৈয়াও যে ঠিক এমনিই ছিল।’
‘ছোটবেলায় তোমাকে বেশ মিষ্টি লাগত কমল।’
‘আর এখন?’
‘এখন খু-উ-ব মিষ্টি।’
‘আগের চেয়ে বেশি! কেন?’
‘কেন জানি না, যখন থেকে তোমার গলার স্বর বদলাতে লাগল, তোমার ঠোঁটের ওপর সূক্ষ্ম কালো গোঁফের রেখা দেখা দিতে লাগল, মনে হয় তখন থেকেই আমার প্রেম গম্ভীর হয়ে উঠল আরও।’
‘আর তখন থেকেই কমলকে দূরে-দূরে রাখতে আরম্ভ করলে তুমি।’
‘দূরে? দূরে রাখতে?’
‘নয় কেন-আগে আগে কেমন লাফিয়ে আমার গলা জড়িয়ে ধরে ঝুলতে।’
‘ও সব নালিশের ফিরিস্তি কমল, তার চেয়ে নতুন কোনো খবর বল।’ ‘
‘নতুন খবর হল, আমাদের প্রেমের ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে গেছে।’
‘কোথায়?’
‘দু’জনের বাড়িতে! আলি হজরৎ বাদশাহ সলামত পর্যন্ত জেনেছেন!’
‘বাদশাহ সালামত পর্যন্ত!’
‘ভয় পেলে না-কি সুরৈয়া?’
‘না, প্রেমের কথা তো একদিন প্রকাশিত হবেই। কিন্তু এখনই কি করে হল?’
‘এত কথা আমিও জানতাম না, কিন্তু শুনেছি কাকা-কাকিমাই একে প্রথম সমর্থন জানিয়েছেন, তারপর বাবা এবং বাদশাহ সলামত এবং সকলের শেষে মা।’
’মা?’
‘মা’র সম্বন্ধে সকলের ভয় ছিল। জানো তো, মা বড় প্রাচীনপন্থী?’
‘কিন্তু এখনও আমার গালের ওপর থেকে,কাকিমার চুমুর দাগ মোছেনি!’
‘হ্যাঁ, সকলের ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে! বাবা যখন তার কাছে বললেন তখন মা
‘তাহলে আমাদের প্রেম সকলের সদর-সমর্থন পেয়েছে?’
’আমাদের আপনজন সবার কাছেই পেয়েছে কিন্তু বাইরের দুনিয়া একে মানতে হয়ত রাজি নয়!’
‘এই বাইরের দুনিয়ার তুমি পরোয়া কর, কমল?’
‘একেবারেই নয়। সুরৈয়া, পরোয়া করি আমি শুধু ভবিষ্যৎ দুনিয়ার-যার জন্য এ পথ প্রদর্শন করতে যাচ্ছি আমরা আজ!’
‘বৌদিও সব কথা জানে কমল, রাত্রে তার ঘরে গিয়েছিলাম, ঠাট্টা করে আমায় বলল, ‘ঠাকুরঝি, আমি যে নন্দাইয়ের আশায় বসেছিলাম–আজ আমার সে সাধ পূর্ণ হতে চলেছে–তোমার নাম অবশ্য করেনি।’
‘এর মানে দাদাই বলেছেন বৌদিকে, আর ওদের দু’জনেরও বেশ সমর্থন রয়েছে আমাদের প্রেমে।’
‘তাহলে তোমার শ্বশুরকুলের সবাই তোমার অনুকুলেই কমল?’
’তোমারও বাহাদুরি-তুমি আমার মায়ের সমর্থন আদায় করেছ।’
‘কাকিমার পূজা-পাঠের কথাই তোমরা চিন্তা করেছ কমল, কিন্তু যদি জানতে যে আমাকে তিনি কত ভালোবাসেন, তবে সম্ভবত তাঁর সম্বন্ধে কোনো রকম সন্দেহই পোষণ করতে না।’
‘আমরা জানতাম বলেই তো তাঁর ওপর প্রয়োগ করার জন্য তোমাকেই চরম অস্ত্র রূপে ঠিক করে রেখেছিলেন বাবা। কিন্তু সে অস্ত্র প্রয়োগ করবার আগেই কেল্লা-ফাতে হয়ে গেল। এখন তো আমাদের বিয়েই হতে চলেছে।’
‘কোথায়?’
‘পণ্ডিতের কাছে নয়, মোল্লার কাছেও নয়। আমাদের আপনি পয়গম্বরের কাছে, যিনি ভারতবর্ষে নতুন ত্রিবেণীর দুর্গ নির্মাণ করেছেন।’
‘যিনি খাল, বিল, নদীনালাকে পবিত্র সমুদ্র পরিণত করতে চান! কিন্তু কবে কমল?’
‘পরশু, রবিবার সুরৈয়া।’
‘পরশু!’ সুরৈয়ার চোখের জল শিশির বিন্দুর মতো টলটল করে উঠল। তা মুছে দিয়ে তার চোখে চুমু দিল কমল। ওদের দু’জনের কেউই তখন জানতে পারল না, আরও চারটি চোখে তাদের মতো লুকিয়ে আনন্দাশ্রু বর্ষণ করেছ।
৪.
বসন্তের হাল্কা হাওয়া, প্রাক-সন্ধ্যার অস্তগামী সূর্যকিরণের লাল আভায় অগ্নিবৰ্ণ সাগরসব মিলিয়ে অপূর্ব এক দৃশ্য! সমুদ্রের বালুকাবেলায় বসে দুটি তরুণ হৃদয় এই দৃশ্য উপভোগ করছিল। উপভোগের এমনি এক পরম মুহূর্তে একজন বলল, ‘কি সুন্দর এই সমুদ্র।’
‘আমরা সকলেই যে সমুদ্রের সন্তান তাতে কোনো সন্দেহ আছে প্রিয়ে?’
‘না গো আমার কমলবরণ কমল, আমরা স্বপ্নেও ভাবিনি যে এমন এক স্বৰ্গলোককে সমুদ্র আপন গর্ভে লুকিয়ে রেখেছিল।’
‘পরিপূর্ণভাবে না হলেও ভেনিসকে মানুষ স্বর্গে পরিণত করে ফেলেছে, এতেও কোনো সন্দেহ নেই।’
‘সাধুজী যখন বলতেন যে, আমাদের দেশের কুলবধুরা এবং কুলকন্যারা পুরুষের মতোই অবগুণ্ঠনহীন স্বাচ্ছন্দ্যে একদা ঘুরে বেড়াত, তখন তাঁর কথা আমি বিশ্বাস করতে পারিনি। আজ দু’বছর হয়ে গেল আমরা এই স্বৰ্গরাজ্যে বাস করছি, এই ভেনিসের সঙ্গে দিল্লীর তুলনা করত। প্রিয়।’
‘যদি কেউ বলে যে, ফ্লোরেন্সের মতো সমৃদ্ধ রাজা রাজাহীন অবস্থায় টিকে থাকতে পারে। তবে আমরা সে কথা বিশ্বাস করতাম। কখনও!’
‘আর ভেনিসের মতো-নগরীকে কোনো রাণী কি পরিচালনা করতে পারে!’
‘দিল্লীতে কি আমরা এমন স্বচ্ছন্দে ঘুরে বেড়াতে পারতাম, সুরৈয়া!’
‘বোরখা ছাড়া? না প্ৰিয়তম, পাল্কির ভিতর আবরু রেখে সেখানে চলাফেরা করতে হয়। আর এখানে-হাত-ধরাধরি করে চললেও কেউ আমাদের দিকে তেমন দৃষ্টি দেয় না।’
‘গুজরাটে কিছু অনাবৃতমুখী কুলাঙ্গনাদের আমি দেখেছি। শুনেছি। দক্ষিণেও পর্দা প্রথা নেই।’
‘এ থেকেই বোঝা যায়, ভারত-ললনারাও একটা সময়ে পর্দামুক্ত ছিল। আমাদের দেশ আবার কখনও কি আমন হতে পারবে কমল?’
‘আমাদের পিতৃপিতামহরা তো আজীবন চেষ্টা করছেন। এই ছোট্ট দেশ ফ্লোরেন্স, মাত্র তিন দিনেই যাকে অতিক্রম করা যায়, তার দিকে একবার চেয়ে দেখ সুরৈয়া! এখানকার লোক কেমন গর্বের সঙ্গে মাথা উচিয়ে চলে। কারও সামনে মাথা নত করা বা কুর্নিশ করা এদের কাছে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত।’রাজা’ শব্দটা শুনলে তারা থুথু ফেলে, রাজা এদের কাছে এক শয়তান অথবা অগ্নিশ্বাসনিক্ষেপকারী এক দৈত্য বিশেষ।’