আবুল ফজল, ‘আমাদের দেশকে কত দূর পথ অতিক্রম করতে হবে, অথচ আমাদের গতি কি মন্থর! তাছাড়া এও তো আমাদের জানা নেই যে, আমরা অসমর্থ হয়ে পড়লে আমাদের ভার বহন করবার মতো কেউ রয়েছে কিনা!’
আকবর, ‘আমি চেয়েছিলাম হিন্দু, মুসলমান দুই জাতির মধ্যে রক্তের সম্পর্ক স্থাপিত হোক। এই সম্পর্কের কথা স্মরণে রেখেই প্ৰয়াগে ত্ৰিবেণী তটে কেল্লা তৈরি করিয়েছি আমি। গঙ্গা-যমুনা ধারার এই সঙ্গম আমার অন্তরেও এক বিরাট মিলনের স্পৃহা জাগ্রত করে তুলেছে। কিন্তু কত সামান্য সফলতা লাভ করেছি তা এখনও দেখতে পাচ্ছি না। বস্তুত যে কাজ শুধু বংশ পরম্পরাই অনুষ্ঠিত হতে পারে, এক পুরুষের মধ্যে তাকে গড়ে তোলা যায় না। একটা বিষয়ে চিরকালই আমার গর্ব থেকে যাবে যে, আমি যেমন বন্ধু পেয়েছি, তেমন বন্ধু খুব কম লোকের ভাগ্যেই জোটে। আকবর আর যোধাবাই মেহেরুন্নিসার মতো মিশ্র। বিবাহ ঘরে ঘরে দেখতে চাই আমি। অথচ এমন আর একটিও দেখতে পেলাম না।’
টোডরমল, ‘হিন্দুরাই এ বিষয়ে বেশি পশ্চাৎপদ বলে প্রমাণিত হয়েছে।’
বীরবল, ‘আর এখন তারা গাধাকে ঘষে-মেজে ঘোড়া বানাবার গল্প তৈরি করছে। কিন্তু, হিন্দু মুসলমানের যদি এতই তফাৎ থাকবে, তো ঘোড়া গাধা হয়ে যাচ্ছে কি করে! হাজার হাজার হিন্দুকে মুসলমান হয়ে যেতে দেখা যাচ্ছে না কি?’
আকবর, ‘আমি তো সব সময়েই এটা দেখব বলে অপেক্ষা করে আছি যে, হিন্দু তরুণীরা নাম এবং ধর্ম ত্যাগ না করেই মুসলমান তরুণীদের বিয়ে করুক।’
আবুল ফজল, ‘এখানে আমি তবে একটা সুসংবাদ শোনাই জালাল! আমরা যে কাজ করে উঠতে পারিনি, আমার সুরৈয়া সে কাজ করেছে।’
সকলে উৎসুক নয়নে আবুল ফজলের দিকে তাকাল।’
তোমরা আরও কিছু শোনবার জন্যে উদ্গ্ৰীব হয়ে উঠেছ তো? আমাকে একটু বাইরে। থেকে আসতে দাও’–বলে আবুল ফজল বাইরে গিয়ে থামের পাশে দাঁড়িয়ে কি দেখল, তারপর ফিরে এসে বলল, ‘শোনার চেয়ে চোখে দেখাই ভালো, এস আমার সঙ্গে।’ সকলে থামের কাছে গেল। অশোক গাছের নিচে পাথরের ওপর উপবিষ্ট যুগল মূর্তির দিকে আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে আবুল ফজল বলল, ‘ঐ দেখ আমার সুরৈয়াকে।’
টোডরমল ‘আর ঐ আমার কমল! দুনিয়া আর আমাদের কাছে অন্ধকার নয়। ফজলু ভাই’–বলে টোডরমল দুহাতে আবুল ফজলকে জড়িয়ে ধরে আলিঙ্গন করল।
এরা দু’জন যখন আলিঙ্গন-মুক্ত হল, তখন চার জনেরই চোখে জল। আকবর মৌনতা ভঙ্গ করে বলল, ‘তরুণদের এই বসন্তোৎসবের ব্যবস্থা অনেক বছর হতেই আমি করেছি।’ কিন্তু এত বছর পরে আজই প্রথম আসল বসন্তোৎসবের অনুষ্ঠান হল। আমার মন চাইছে,–ওদের দু’জনকে ডেকে কপালে আশিস-চুম্বন দিয়ে দিই। আমি। ওরা যদি জানে যে, গঙ্গাযমুনার সঙ্গমের মতো। ওদের ঐ মধুর মিলনকেও অন্তরের সঙ্গেই সমর্থন করি আমরা, তবে খুবই ভালো হয়।’
আবুল ফজল, ‘সুরৈয়া জানে, তার বাপ-মা এই প্রণয়কে সুখের বলে মনে করে।’
টোডরমল, ‘কমল সেটা জানে না। কিন্তু তুমি বড় ভাগ্যবান ফজলু। কারণ সুরৈয়ার মা তোমার সঙ্গে একমত। কমলের মা এবং সুরৈয়ার মা-দু’জনে যদিও অন্তরঙ্গ সখি, তবুও কমলের মা কিন্তু-কিছুটা প্রাচীনপন্থী, যাহোক, তাতে ক্ষতি নেই। কমল আর সুরৈয়াকে আমি প্ৰাণভরে আশীৰ্বাদ করব।’
আকবর, ‘সবচেয়ে আগে আমাকেই আশীৰ্বাদ করতে দেওয়া উচিত।’
বীরবল, ‘আর আমাকে তোমার সঙ্গে নেবে না জল্লু?’
আকবর, ‘নিশ্চয়ই, এমন ধোবী কোথায় পাওয়া যাবে?’
বীরবল, ‘আর এমন ঘোড়া বনে যাওয়া গাধাই বা কোথায়!’
আকবর, ‘আমাদের এই মিলন আজ কত মধুর। মাসে একদিনও যদি এমন আনন্দ লাভ করা যেত।’
৩.
ছাদের ওপর চারিদিকে দরজাযুক্ত এক সুসজ্জিত কামরা। কামরার ভেতরের দিকটায় ছাদ থেকে লাল, সবুজ সাদা, ঝাড় টাঙানো। দরজাগুলোতে দু’পাল্লা করে পর্দা দেওয়া। ভেতরের দিককার পর্দাগুলো বুটিদার গোলাপী রেশমের। মেঝের ওপরও সুন্দর ইরানী গালিচা পাতা। কামরার মাঝখানে সাদা গদির ওপর অনেকগুলো তাকিয়া বালিশ। গদির ওপর বসে দুটি তরুণী দাবা খেলছে। এদের মধ্যে একজন আমাদের পূর্ব পরিচিত। সুরৈয়া। আর লাল ঘাঘরা, সবুজ চেলী এবং হলদে ওড়না পরা অপর তরুণীটি বীরবলের তের বছরের কন্যা ফুলমতী। তারা খেলার চাল দেবার চিন্তায় এত মগ্ন হয়ে আছে যে, গন্দিরওপর এগিয়ে আসা পায়ের শব্দ শুনতে পেল না।’সুরৈয়া!–ডাক শুনে দু’জনেই চোখ তুলে তাকাল এবং তারপর উঠে দাঁড়াল।’কাকিম।’–বলে উঠে দাঁড়াল সুরৈয়া, আর কমলের মা তার গলা জড়িয়ে ধরে গালে চুমু দিল। সুরৈয়ার মা বলল, ‘তোর জন্যে রঙিন মাছ নিয়ে এসেছে কমল-যা পুকুরে ছেড়ে আয়। ততক্ষণ আমি মুনীর সঙ্গে খেলছি।’
‘মুন্নী বড় হুঁসিয়ার মা, আমাকে দু’বার মাত করে দিয়েছে। ছোট মেয়ে বলে ওকে উড়িয়ে দিয়ে না’ –এই বলে তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সুরৈয়া।
প্রাসাদের পিছনের দিককার বাগানে পুকুরের ধারে কমল দাঁড়িয়ে ছিল। তার সামনে নতুন এক মাটির হাঁড়ি। কাছে এসে নিজের হাতের মধ্যে কমলের হাত নিয়ে সুরৈয়া বলল, ‘লাল আর গোলাপী মাছ নিয়ে এসেছি কমল?’
‘ হ্যাঁ, সোনালী রঙেরও এনেছি।’
‘দেখি একবার’–বলে সুরৈয়া সামনে ঝুঁকে হাঁড়িটা ঝাকাতে লাগল।
‘এগুলোকে আমি পুকুরে ছেড়ে দিচ্ছি, সেখানে থাকলে দেখতে আরও সুন্দর লাগবে। পুকুরের স্বচ্ছ জলের মধ্যে ওগুলোকে দেখ সুরৈয়া।’
ঠোঁটে এবং চোখে হাসি ফুটিয়ে পুকুরের কাছে এসে দাঁড়াল সুরৈয়া। কমল হাঁড়ি উপুড় করে মাছগুলো পুকুরে ছেড়ে দিল। পুকুরের স্বচ্ছ জলে তাদের লাল, গোলাপী, সোনালী রঙ সত্যিই বড় সুন্দর মনে হতে লাগল। কমল গম্ভীর স্বরে, বোঝাতে লাগল, ‘এগুলোকে আমি পুকুরে ছেড়ে দিলাম, এখানে দেখতে আরও সুন্দর লাগবে। এখনও এগুলো ছোট সুরৈয়া, কিন্তু বয়স হলেও ছয় আঙ্গুলের বড় হবে না।’