আবুল ফজল, ‘না রে বীরু, আমার ওপর মিছামিছি। রাগ করিস না, তোর গল্পগুলোকে তাই বড় ভয় করি আমি।’
বীরবল, ‘ হ্যাঁ, আমিই আইন-ই-আকবরীর মতো পুথি লিখে রেখে দিয়েছি কিনা!’
আবুল ফজল, ‘আইন-ই-আকবরী পড়ার মতে ক’টা লোক পাওয়া যাবে, আর বীরবলের গল্পগুলোকে মুখে মুখে ছড়াবার লোকই বা কত হবে?’
টোডরমল, ‘এ তো বীরু নিজেও জানে।’
আবুল ফজল, ‘যাহোক। তোমার আশবৃফিওয়ালা গল্প শোনাও বীরু!’
বীরবল, কিন্তু তোমরা সকলে তো প্রথমেই ধরে নিয়েছ যে, এ গল্প আশবৃফি দিয়ে কিনিনি আমি, আমার নিজের মগজ থেকেই বেরিয়েছে।’
‘আকবর, ‘কোনটা আসল আর কোনটা জাল সে আমরা বুঝতে পারি।’
বীরবল, ‘যেন আমার সব গল্পের ওপরেই ছাপ মারা আছে! বেশ, যা তোমাদের মর্জি। গল্প তো শুনিয়ে দিই। আমি। তবে গল্পের সারাংশটুকুই বলব শুধু–
‘আকবরের একবার খুব সখা হল হিন্দু হবার। বীরবলকে সে এই কথা জানাল; বীরবল বড়ই বিপদের মধ্যে পড়ল। বাদশাহকে সে না করতেও পারে না, অথচ তাকে হিন্দু বানাবার ক্ষমতাই বা তার কোথায়? দিন কয়েক গা ঢাকা দিয়ে থাকল। একদিন সন্ধ্যায় বাদশাহ-মঞ্জিলের খিড়কির কাছে ‘হিছ-ছো-ও’, ‘হিছ-ছো-’ করে জোর আওয়াজ হতে লাগল। বাদশাহ-মঞ্জিলের এই দিকটাতে এমন সময় কখনও কাপড় কাঁচার শব্দ শোনা যায় না। কৌতূহল বেড়ে গেলবাদশাহর। এক মজুরের পোশাক পরে যমুনাতীরে এল। পোশাক যতই বদলাক, বীরুর চোখে ধরা না পড়ে পারল না। সে যাহোক। ওখানে কাপড় আছড়ানো হচ্ছিল না, মোটাসোটা এক গাধাকে সোডা-সাবান দিয়ে রগুড়ে ধোয়া হচ্ছিল।’
‘মুচকি হাসিটুকু লুকিয়ে গলার আওয়াজ বদলে বাদশাহ জিজ্ঞেস করল, ‘কি করছ হে চৌধুরী?’
‘নিজের কাজ করছি ভাই, তোর কি দরকার তা দিয়ে?’
‘বড় অসময়ে ঠাণ্ডায় হাওয়ার মাঝে দাঁড়িয়ে রয়েছে। চৌধুরী-অসুখ করবে।’
‘কি করা যাবে, এই হল বাদশাহের হুকুম!’
বাদশাহ এবার হেসে উঠে স্বাভাবিক স্বরে বলল, চল বীরবল, আমি বুঝতে পেরেছি যে, মুসলমানের হিন্দু হওয়া গাধার ঘোড়া হবারই সামিল’।’
‘ভাই ফজল, এই গল্প শুনে মনে হয়, যেন আমার দেহের ভেতর সাপ ঢুকেছে।’
‘আকবর, ‘জীবন সায়াহ্নে, এসে আমাদের এইসব গল্প শুনতে হচ্ছে! আমাদের সারা জীবনের একাগ্র সাধনার পরিণাম কি শেষে এই দাঁড়াবো!’
আবুল ফজল, ‘আমরা শুধু আমাদের কালের ঝক্কিই বহন করতে পারি, কিন্তু আমাদের এই প্রচেষ্টার সাফল্য-অসাফল্য নির্ভর করছে বসন্তোৎসবরত ঐ সব যুবক যুবতীদের ওপর।’
টোডরমল, ‘কিন্তু আমরা মুসলমানকে হিন্দু বা হিন্দুকে মুসলমান বানাতে চাইনি।’
আবুল ফজল, ‘আমরা দু’জনকেই এক করে দেখতে চেয়েছি-এক জাতি এক প্রাণ বানাতে চেয়েছি।’
বীরবল, ‘মোল্লা আর পণ্ডিতেরা কিন্তু আমাদের ধারায় চিন্তা করে না। আমরা চাই ভারতবর্ষকে শক্তিশালিরূপে দেখতে। ভারতের অস্ত্ৰে তীক্ষ্ণতা আছে, ভারতীয় মস্তিষ্কে প্রতিভা রয়েছে, যুবকদের রয়েছে সাহস। কিন্তু ভারতবর্ষের দোষ, ভারতের দুর্বলতা হল তার ভিতরকার অনৈক্য, তার বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকার প্রবণতা।’
আকবর, ‘এই তো আমার একমাত্র আকাঙ্ক্ষা ছিল বন্ধু, এতদিন পর্যন্ত আমরা এরই জন্যে সংগ্ৰাম করে এসেছি। আমরা যে সময় কাজ আরম্ভ করি।-চারিদিক অন্ধকারাচ্ছন্ন তখন, কিন্তু এখন তো আর তা বলা চলে না। এক পুরুষে যতটা করা সম্ভব আমরা সেটা যথাযথভাবে করেছি। কিন্তু এই গাধা-ঘোড়ার গল্প আজ পাথরের মতো চেপে বসেছে আমার অন্তরে।’
আবুল ফজল, ‘ভাই জালাল, নিরাশ হওয়াও আমাদের উচিত নয়। বৈরাম খায়ের সময়ের সঙ্গে তুলনা কর আজকের। সে সময় কি যোধাবাই তোমার স্ত্রী হয়ে হারেমে বসে বিষ্ণুর মূর্তি পূজা করতে পারত?’
আকবর, ‘তফাৎ সত্যিই আছে ফজল, কিন্তু লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে এখনও বহু দূর যেতে হবে আমাদের। ফিরিঙ্গি পাদরীদের কাছে আমি শুনেছি, তাদের দেশে সবচেয়ে বড় বাদশাহও একটির বেশি স্ত্রীলোককে বিয়ে করতে পারে না। এই প্রথা আমার কত ভালো লেগেছে, তা সেই সময়ের আমার কথাবার্তা থেকে তুমি বুঝে থাকবে টোডর। আমিও যদি এ দেশে এমন ব্যবস্থার প্রবর্তন করতে পারতাম! কিন্তু এ বড় বিড়ম্বনার কথা যে, মন্দ কাজ করবার স্বাধীনতা বাদশাহের যতটা আছে, ভালো কাজের সময় ততটা নেই। যদি সম্ভব হত তবে সেলিমের মা ছাড়া আর কাউকে আমার হারেমে রাখতাম না। এ ব্যবস্থা যদি সেলিমের জন্য করতে পারতাম আজ!’
বীরবল, ‘প্রেম কেবল একজনের সঙ্গেই হতে পারে জালাল। মনোহর হংস-দম্পতি যখন দেখি, তখন বুঝতে পারি তাদের জীবন কত সুন্দর। আনন্দের দিনে যেমন পরস্পরের সাখী ওরা, বিপদের দিনেও ঠিক তেমনি।’
আকবুর, ‘আমার চোখ থেকেও একবার জল ঝরেছিল বীরু ভাই! সে-বার সিংহ। শিকারে গুজরাট গিয়েছিলাম। হাতীর পিঠে চড়ে বন্দুকের সাহায্যে সিংহ মারা কোনো বাহাদুরীর কাজ নয়। এ কথা আমি নিশ্চয়ই স্বীকার করব–সিংহের মতো থাবা এবং নখ যখন তোমার নেই, তখন ঢাল-তলোয়ার নিয়ে তার সামনে এগোতে পার তুমি, এর চেয়ে বেশি শক্তিশালী অস্ত্র নেওয়া বীরত্বের পরিচায়ক নয়। আমি কিন্তু বন্দুকের সাহায্যেই সিংহটিকে মারলাম। গুলি ওর মাথায় গিয়ে লাগল, আৰ্তনাদ করে সেখানেই পড়ে গেল। ঠিক সেই মুহূর্তে ঝোঁপের ভিতর থেকে বেরিয়ে এল। তার সিংহিনী। অপরিসীম। ঘৃণার দৃষ্টিতে সে একবার আমার দিকে তাকাল, পরীক্ষণেই মৃত সিংহের গলা চাটতে লাগল। তৎক্ষণাৎ আমি শিকারীদের গুলি ছোড়া বন্ধ করতে বললাম এবং হাতী ফিরিয়ে আনলাম। আমার মনে সেদিন এত বড় আঘাত লেগেছিল যে, সিংহিনী যদি হামলাও করত। আমার ওপর তবু হয়ত বন্দুক তুলতাম না। আমি। বহুদিন পর্যন্ত বেদনাভিভূত হয়ে পড়েছিলাম আমি এবং সেই সময়েই বুঝতে পেরেছি যে, ঐ সিংহের যদি হাজার-পাঁচশ’ সিংহী থাকত, তবে অমান করে সেদিন গাল চাটত না কেউ।’