‘বহুযুগ থেকে-সেই তখন থেকে, স্ৰষ্ট যখন সবেমাত্র জলের ভিতর থেকে বিশ্বসৃষ্টি শুরু করেছেন, পৃথিবী যখন তরল্যাবস্থায় ছিল এবং পর্বত বৃক্ষ বা প্ৰাণীসমূহের ভর বহন
‘থাম, কমল! তুমি তো সব সময়ই কাব্য কর।’
‘হায় সুরৈয়া, সত্যি কথাই তুমি বলেছ, মনে হচ্ছে আমার অদৃষ্ট কবিতা নেই।’
‘সুরৈয়া অন্য কোনো রমণীকে সঙ্গে রাখা পছন্দ করে না।’
‘এই হৃদয়ও তো ঐ কথা বলে। কিন্তু, তুমি অমন তন্ময় হয়ে কি ভাবছিলে?’
‘সবচেয়ে কাছে হল সুরাট, এখান থেকে মাত্র এক মাসের রাস্তা।’
‘আর এই জল কোথায় যায়?’
‘বাঙলার দিকে। সে আরও অনেক দূর, সম্ভবত দু’মাসের পথ।’
‘বেচারা, এই কাদাগোলা জলকে এতটা পথ চলতে হবে! আচ্ছা কমল, তুমি সমুদ্র দেখেছ?’
‘বাবার সঙ্গে একবার উড়িষ্যা গিয়েছিলাম আমি, তখন দেখেছি প্রিয়ে!’
‘কি রকম দেখতে?
‘দিগন্ত-বিস্তৃত এক কালো মেঘ যেন পড়ে রয়েছে সামনে।’
‘এই জলধারার অদৃষ্টও সমুদ্র সন্দর্শন রয়েছে! আচ্ছা ওখানে গিয়েও এর ঘোলা রঙ এমনটিই থাকবে?’
‘না। সুরৈয়া ওখানে একটি মাত্র রঙই দেখা যায়-ঘন নীল বা কালো।’
‘তুমি যদি নিয়ে যাও তো আমিও একদিন সমুদ্র দেখতে পাই।’
‘সুরৈয়া, তুমি আজ্ঞা করলে এই জলের সঙ্গেই যাত্রা করতে আমি প্রস্তুত।’
দুহাত দিয়ে কমলের গলা জড়িয়ে ধরে তার ভেজা গালে নিজের সিক্ত গাল চেপে ধরল। সুরৈয়া, তারপর কমলের উৎফুল্ল চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘সমুদ্রে আমাকে যেতেই হবে, কিন্তু এই জলের সঙ্গে নয় কমল।’
‘মলিন জলধারার সঙ্গে নয়-তাই না প্রিয়তম?’
‘মলিন বলছি কেন কমল, আকাশ থেকে যখন পড়ে তখন কি এ মলিন ছিল?’
‘না। সুরৈয়া, চন্দ্ৰসূর্যের চেয়েও তখন নির্মল ছিল। তোমার ঐ সুন্দর অলকগুচ্ছ কেমন উজ্জল করে তুলেছে এই জলের ধারা। চাঁদের মতো শুভ্ৰ তোমার দুটো গাল কেমন মনোরম করে তুলেছে! আকাশ থেকে সোজা তোমার যে-সব অঙ্গে পড়েছে, সে সমস্ত স্থানেই তোমার সৌন্দর্যকে উজ্জ্বলতর করে তুলেছে।’
‘তাহলে তো এর এই মলিনতা নিজস্ব নয়। সাগর সঙ্গমের যাত্ৰাপথ রোধ করে। দীড়িয়েছে যে, তারই সঙ্গে সংঘর্ষে এই মলিনতা প্রাপ্ত হয়েছে। সোজা সাগরের জলে ঝরেপড়া ফোঁটাগুলোও কি এমনি হয় কমল?’
‘না প্রিয়তমা।’
‘এই জন্যেই তো এই মলিনতাকে আমি এর দোষ মনে না করে ভূষণ বলেই মনে করি। তুমি কি বল কমল?’
তোমার অধর আমার মনের কথাকেই ব্যক্ত করছে। সুরৈয়া।’
২.
আকাশের নীলিমার ছায়া সরোবরের অতল জলরাশিকে আরও নীল করে তুলেছে। অমল-ধবল শ্বেত পাথরের ঘাট আরও যেন সাদা হয়ে উঠেছে এই নীলিমার পটভূমিকায়। সবুজ দুর্ব ঘাসের মধ্যে সূক্ষ্মপত্রযুক্ত সবুজ বৃক্ষরাজি বড়ই সুন্দর দেখাচ্ছিল। বিশেষ করে এই বসন্তের মধ্যাহ্নবেলায়। বহু দূর প্রসারী বৃক্ষশ্রেণীর লতা-মণ্ডপ এবং ঝর্ণাধারায় সুসজ্জিত মনোরম উদ্যান। শাহীবাগ আজ তরুণ-তরুণীদের বসন্তোৎসবের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে এবং উন্মুক্ত এই উদ্যানে স্বর্গবিহারীদের মতো তারাও পরমানন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
পুস্করিণী থেকে দূরে বাগানের ধারে লালপাথরের ছাউনীর বাইরে চার ব্যক্তি দাঁড়িয়ে আছে। সকলের মাথায়ই এক ধাঁচের পাগড়ী-সামনের দিকে কিছুটা প্রসারিত; হাঁটু পর্যন্ত লম্বা একই রকমের গলাবন্ধ জামা, একই রকমের সাদা কোমরবন্ধনী। সকলের একই রকমের গোফ, অধিকাংশই সাদা হয়ে গিয়েছে। কিছুক্ষণ এরা বাগানের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর এগিয়ে এসে চারিদিক-খোলা ছাউনীর নিচে গদীর ওপর বসে পড়ল। চারিদিকে এক অখণ্ড নিঃস্তব্ধতা বিরাজ করছিল, এই বৃদ্ধের দল ছাড়া আর কেউই সেখানে নেই।
নীরবতা ভঙ্গ করে একজন বলে উঠল, ‘বাদশাহ সালামত!…’
‘কি ব্যাপার ফজল, এখনও কি আমি দরবারে অধিষ্ঠিত রয়েছি? আমি কি কখনও সাধারণ মানুষের মতো সহজভাবে থাকতে পারি না?’
‘ভুলে যাই…’
‘নাম ধরে ডাকো-বল জালাল বা আকবর, না হয়। শুধু বন্ধু বল!’
‘এ বড় মস্কিল বন্ধু জালাল, দু’রকমের জীবনযাপন করতে হয় আমাদের।’
‘দু’রকম নয়, চার রকম ভাই ফজলু!’
‘ভাই বীরু! তোর তারিফ করি আমি, সব সময়েই যেন সমস্ত কিছুর জন্য তৈরি থাকিস তুই, আমি তো যখন এক দুনিয়া থেকে অন্য দুনিয়ায় চলে আসি তখন মনটাকে। তৈরি করে নিতে অনেক সময় লেগে যায়। কি ভাই টোডর, ঠিক বলিনি?’
‘হ্যাঁ ভাই ফজলু, আমিও তাজব বনে যাই, কি অদ্ভুত মগজ ওর…’
‘বীরবলকেই হিন্দুস্থানের সমস্ত লোক ভারতের প্রতিটি ক্ষেত্রে কর্ণধার বলে জানে!’
‘কিন্তু টোডরমলও তো তাই! সেও কি সব জায়গায় পর্যবেক্ষণ চালায়নি?’
বীরবল, ‘চালাক বা না-চালাক, দুনিয়া আমার কথাই জানে, আর আমার এই মগজের প্রশংসা আমাদের জালুও করে।’
আকবর, ‘নিশ্চয়ই আর এ ব্যাপার শুধু সেই সব কাহিনীতেই শেষ নয়, বাদশাহ জালালুদ্দিন আকবরের বিভিন্ন বেশে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ানো সম্বন্ধে যা প্রচলিত।’
বীরবল, ‘এ এক চমৎকার স্মৃতি মনে করিয়ে দিলে জল্লু ভাই। ঐ কাহিনীর সঙ্গে সঙ্গে আমিও মারা যেতে বসেছি। বীরবল এবং আকবরের নামে যে কোনো রকমের কাহিনী রচনা করে বলে বেড়ানো এক সখের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন বহু কাহিনী আমি জমিয়ে ফেলেছি-প্ৰত্যেকটির জন্য আমি এক-এক আশরাফি মূল্য ধার্য করেছি।’
আকবর, ‘এই আশরাফির জন্যে কাহিনীগুলো তোমার মগজ থেকেই সোজা বেরিয়ে আসে না তো?’
বীরবল, ‘হতে পারে, কিন্তু তাতে কোনো তফাৎ নেই। সে ক্ষেত্রেও তো এ কথা বোঝা যাবে যে, কি রকম সব অর্থহীন কাহিনী আমাদের দু’জনের নামে রটানো হচ্ছে। রাগ করিস না ফজলু ভাই, শেঠ ছদামীমলের মতো আমি কঞ্জুষ নই।’