ব্ৰাহ্মণ আর একবার সাহস করে বলল, ‘আরো চৌধুরী, তোমরা তো জানো না, সুলতানের সেনাপতি মালিক কাফুর দক্ষিণে গিয়ে আমাদের মন্দির ভেঙে দিয়েছে, সব দেবমূর্তি পায়ের তলায় গুড়িয়েছে।’
‘আমরা অনেক শুনেছি পণ্ডিত, একবার নয়, হাজারবার শুনেছি যে মুসলমানী রাজত্বে হিন্দুদের ধর্ম বিপন্ন। কিন্তু আমরা দিল্লীর খুবই কাছে থাকি পণ্ডিত, না হলে হয়ত আমরাও বিশ্বাস করে নিতাম। আমাদের বিশ ক্রোশের মধ্যে তো কোনো মন্দির ভাঙা হয়নি, কোনো দেবমূর্তিকেও পায়ের তলায় মাড়ানো হয়নি।’
‘হ্যাঁ, মঙ্গলরাম এ সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা, আমি অনেকবারই দশহরা দেখতে দিল্লী গিয়েছি। কি বিরাট মেলা হয়। সেখানে, অর্ধেকের বেশি সেখানে স্ত্রীলোক। হিন্দুদের মেলা কাজেই মেলার লোক বেশিরভাগই হিন্দু। দেবমূর্তি সাজিয়ে সুলতানের অলিন্দের নিচে দিয়ে নিয়ে শঙ্খ, নাকাড়া আর শিঙা বাজাতে বাজাতে হিন্দুরা যায়।’
‘ঠিক কথাই বলেছ ছেদারাম, এ-সব মিথ্যাই। শেঠ নিক্কামল সুলতান-প্রাসাদ থেকে একশ’ গজ দূরেই এক বড় মন্দির তৈরি করাচ্ছে। কত লক্ষ টাকা লাগবে কে জানে। গতবারে পাথর আসতে দেখেছিলাম। আমি। এ-বারে দেখে এসেছি। এক কোমর সমান দেয়াল উঠে গেছে। সুলতানের যদি ভাঙার ইচ্ছাই থাকবে, তাহলে নিজের চোখের সামনে। মন্দির উঠতেই বা দেবে কেন?’
‘হ্যাঁ চৌধুরী, রাজায় রাজয় লড়াই হয়; লড়াইতে কেউ কারও অপেক্ষায় থাকে না। আগে কিছু হয়ত হয়ে গেছে, তাই নিয়ে এখন হল্লা বাধানো হচ্ছে। একশ বছর আগে আমাদের আশে-পাশে এমনি ঘটনা ঘটেছিল। কিন্তু আজ কোথাও কিছু শোনা যায় না।’
‘আমার মনে আছে যখন আমরা গ্রামের কয়েকজন লোক হাকিমের তাঁবুতে গিয়েছিলাম। সে বলেছিল, আগের সুলতানেরা এক রাত্রি বাস করতে আসত এখানে, আর এখন আমাদের সুলতান লাভদীন, আমাদের সুখ-দুঃখের চিরসাখী-এই জন্য প্রজাদের লণ্ঠন করে না সে, বরং তাদের সুখী দেখতে চায়।’
‘এখন শুধু এটা চাওয়ার কথা নয় বরং চারিদিকেই লোকেরা সুখী হয়ে উঠেছে।’
৪.
দিল্লীর বাইরে এক নির্জন কবর। তার কাছে কিছু নিম এবং তেঁতুলের গাছ জন্মেছে। অগ্রহায়ণের ঠাণ্ডা রাত। কাঠের আগুনের কাছে দুজন ফকির বসেছিল, এর মধ্যে একজন আমাদের পূর্ব-পরিচিত নুরদীন। দ্বিতীয় ফকির নিজের সাদা দাড়ি এবং গোঁফের ওপর হাত বুলাতে বুলাতে বলল, ‘বাবা, পাঁচ বছরের ভিতর আবার হরিখানায় দুধের নদী বয়ে যেতে আরম্ভ করেছে।’
‘ঠিক বলেছ বাবা জ্ঞানদীন, এখন কিষাণদের চেহারা বেশ হাসিখুশী।’
‘ক্ষেত-খামার যখন হেসে ওঠে, তখন মুখের চেহারাতেও হাসি ফোটে।’ ‘আমলারা গেছে, কিন্তু এই বানিয়া-মহাজনেরা মরলে শান্তির বাঁশরী বাজত।’ ‘প্রচুর লোটে ওরা। আর ওদের এই বড়-বড় মঠ, বড়-বড় মন্দির, সদাব্রত সবই এই লুটের অর্থেই চলছে।’
‘জ্ঞানী-ধ্যানী, পীর-পয়গম্বর, মুনি-ঋষি ছাড়া ধর্মের পথে কে চলবে? অথচ তাদের কাছে একটা কম্বল, একটা কৌপীন ছাড়া আর কি থাকে?’
‘যতদিন পর্যন্ত গরীবের শ্রমে বড় হওয়া লোক থাকবে ততদিন পর্যন্ত মানুষ ভাইভাই হতে পারবে না। আর সুলতানও মানুষে মানুষে শক্রিতা বাড়িয়ে তোলবার একটা যন্ত্র মাত্র, অথচ তার মান-মৰ্যাদাও জনসাধারণের শ্রম-বিনা টিকতে পারে না।’
‘সেই দিনের আশায় আমরা থাকব বন্ধু; যেদিন এই সমস্ত গোলকধাঁধাঁর খেলা শেষ হয়ে যাবে এবং পৃথিবীতে প্রেমের রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হবে।’
১৬. সুরৈয়া (কাল : ১৬০০ খৃষ্টাব্দ)
বর্ষর কর্দমাক্ত বারিধারা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। সমতলভূমির ওপর দিয়ে মন্থরগতিতে জলের ধারা গড়িয়ে চলেছে, বেগে ছুটে চলেছে ঢালু জমির ওপর দিয়ে, আর উচ্ছল আবেগে ফুলে উঠে বিস্তৃত পাহাড়ী জলস্রোতের রূপ ধারণ করছে নদী-নালাগুলোর বুকে। বৃক্ষগুলি যেন এখনও পর্যন্ত জলভরা মেঘ ধরে রেখেছে, ওগুলো থেকে এখনও বড়-বড় ফোঁটা ঝরে পড়ছে টুপ্টাপ শব্দে। প্রবল বর্ষা এখন গুড়ি-গুড়ি বর্ষণ ধারায় রূপান্তরিত হয়েছে।
এক শমীবৃক্ষ থেকে কিছুটা দূরে শ্বেতবসনা এক তরুনী দাঁড়িয়েছিল। তার মাথার ওপর থেকে সাদা চাদর খসে পড়েছে এবং দ্বিধাবিভক্ত ভ্রমরকৃষ্ণ কেশের মধ্য দিয়ে। হিমালয়ের গভীর অরণ্যানীতে প্রবাহিত গঙ্গার রূপালী ধারার মতোই সিঁথির সরল রেখা দেখা যাচ্ছে। কানের পাশে কুঞ্চিত কালো কুন্তল থেকে এখনও দু-এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ছে। তরুণী তুষার শুভ্ৰ গন্তীর মুখমণ্ডল থেকে বড়-বড় কালো চোখ দুটো যেন দূরস্থিত কোনো চিত্রপট নিরীক্ষণ করছে। আজানুলম্বিত রেশমী পোশাক জলে ভিজে বুকের সঙ্গে সেঁটে রয়েছে, যার নিচে লাল কীচুলীতে বাধা সুগোল স্তনযুগল স্পষ্টভাবে উপচে পড়ছে মনোরম ভঙ্গিমায়। সরু কোমর থেকে গোড়ালি পর্যন্ত পায়জামা-তাঁর আঁটোসাটো নিম্নাং জঙ্ঘা প্রদেশের সুডৌল আকৃতি পরিস্ফুট হয়ে রয়েছে। কৰ্দমাক্ত সাদা মোজার ওপর লাল রঙ-এর জুতো। জলে ভিজে সে দুটো আরও নরম এবং সম্ভবত হেঁটে চলারই অনুপযুক্ত হয়ে পড়েছে।
একটি তরুণকে তরুণীর দিকে এগিয়ে আসতে দেখা গেল। তার পাগড়ী, আচকান সবই সাদা এবং ভিজে। কাছে এসে সে লক্ষ্য করল তরুণীর দৃষ্টি দূরে নিবদ্ধ। পায়ের শব্দ না করেই তরুণীর পাশে দু’হাত দূরত্বের মধ্যে এসে গেল সে। কিছু দূরে প্রবাহিত নালার কৰ্দমাক্ত জলধারা তরুণী স্থির দৃষ্টিতে দেখছিল। তরুণ ভেবেছিল, তার সহচরী এ-বারে তাঁর দিকে ফিরে তাকাবে। কিন্তু এক-এক মিনিটে এক একটা যুগ অতিবাহিত হয়ে চলল, তরুণীর দৃষ্টি তবুও নিশ্চল। কপালের ওপর থেকে গুঁড়ি-গুঁড়ি জলকণাগুলো মুছে ফেলবারও অবকাশ হল না তার। আর অপেক্ষা করতে না পেরে ; ধীরে ধীরে তরুণীর কাঁধের ওপর তার হাতটি রাখল। তরুণী মুখ ফেরাল, দূর-নিবদ্ধ দৃষ্টি ফিরে এল তার, উজ্জল হয়ে উঠল বড়-বড় কালো চোখ দুটো, রক্ত অধরপুটে মৃদু হাদির রেখা ফুটে বেরুল এবং ভিতর থেকে চিক্চিক করে উঠল সুসজ্জিত দন্তরাজি। তরুণের হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে সে বলল, ‘ ‘তুমি কতক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে রয়েছ কমল?’