‘রাম রাম ভাই! কিন্তু পথ চলতে যাকে হবেই, তার রোদুর-ছায়ার বিচার করবার সময় কই?’
‘জল খাও ভাই, তোমার যেন মুখ শুকিয়ে গেছে, ঐ ঘটিতে ঠাণ্ডা জল রয়েছে।’
‘কি জাত তোমরা?’
‘আহীর। মঙ্গল চৌধুরী আমার নাম।’
‘চৌধুরী, আমি ব্ৰাহ্মণ, কুয়োটা দেখিয়ে দাও আমাকে।’
‘যদি আমার ছেলেকে দিয়ে জল আনাই-তাহলে হবে না পণ্ডিতজী?’
‘তাই দাও পাঠিয়ে, বড্ড শ্ৰান্ত হয়ে পড়েছি।’
‘ঘীসা, এদিকে আয় তো বাবা।’
মাড়াই বন্ধ রেখে মঙ্গল চৌধুরী গুড় আর কুয়ো থেকে টাটুকা জল নিয়ে আসতে বলল। ছেলেকে। এদের কাছে জিজ্ঞেস করে পথিক জানতে পারুল, দিল্লী এখান থেকে বিশ ক্রোশ দূর; কাজেই আজ আর সে পৌঁছাতে পারবে না। মঙ্গল চৌধুরী অত্যন্ত রসিক লোক। চুপ? করে থাকাই তার পক্ষে সবচেয়ে মুস্কিলের ব্যাপার।
চৌধুরী বলল, ‘আমাদের এখানে এ বছর ভগবানের কৃপায় চমৎকার ফসল হয়েছে। বৈশাখে। ফসল কাটা কঠিন ব্যাপার হবে। ওখানে ফসলের অবস্থা কি পণ্ডিতজী?’ ফসল মন্দ হয়নি চৌধুরী’
‘রাজা ভালো হলে দেবতারাও খুশী হয় পণ্ডিতজী! যখন থেকে নতুন সুলতান তখতে বসেছে তখন থেকেই প্রজারা বেশ সুখে আছে।’
‘তুমি কি সেই রকমই দেখছ, চৌধুরী?’
‘আরে, এই খামারের তো কিছুটা দেখছি। দু’বছর আগে এলে দেখতে পেতে এর চার ভাগের এক ভাগ ফসলও হয়নি।’
‘তাহলে উন্নতি হয়েছে, চৌধুরী!
‘উন্নতি হয়েছে সুলতানের কৃপাতেই পণ্ডিতজী। আগে আমরা কিষাণর না খেয়ে, না-পরে মারতাম আর কয়েকটা বদ লোক রেশমী পোশাক পরে ঘোড়ায় চড়ে ঘুরে বেড়াত। গম এতটুকু হতে না হতেই তাদের ঘোড়া আমাদের ক্ষেতে এসে হাজির হত। কে প্রতিবাদ। করবে? আমাদের গ্রামগুলোর তো। ওরাই ছিল সুলতান!’
এই সময় মঙ্গল চৌধুরীর মতোই হাঁটু পর্যন্ত ধুতি, গায়ে এক ময়লা। ফতুয়া, মাথায় চাপা সাদা-টুপি পরিহিত অপর এক চৌধুরী এসে পড়ল এবং ওদের দু’জনের কথার মাঝেই বলে উঠল, ‘আরো এখন দেখছ তো চৌধুরী, কোথায় চলে গেল তাদের সেই বিরাট ক্ষমতা! এখন ব্যাটারা আবার দান পাবার আশায় বসে আছে। আমাকে বলছিল। সেই ব্ৰাহ্মণ—কি যেন নাম তার, চৌধুরী?’
‘সিব্বা।’
‘এখন কেন সিকবা বলছি, সে সময় তো পণ্ডিত শিবরাম বলতে! বলছিল, ‘চৌধুরী ছেদারাম, দু’মণ গম দাও, হাতে পয়সা হলে দাম দেব।’ মুখের ওপর তো না বলা যায় না, কিন্তু আমার তখনকার কথামনে পড়ল, যখন এই ব্ৰাহ্মণটা ভদ্রভাবে কথাও বলতে জানত না। ‘আরে ছিদে’ ছাড়া অন্য কোনো রকম সম্ভাষণ তার মুখ থেকে শুনি নি।’
‘আর এখন? তুমি হলে চৌধুরী ছেদারাম, আর আমি চৌধুরী মঙ্গলরাম। মঙ্গে’ আর ছিদে থেকে কোথায় চলে এসেছি আমরা আড়াই বছরের মধ্যে।’
‘আমি বলব, এ সবই সুলতানের দয়া, তা না হলে আমরা সেই মঙ্গে’ আর ছিদেই রয়ে যেতাম।’
‘সেই কথাই তো আমি বলছিলাম পণ্ডিতজীকে। আমাদের পঞ্চায়েতও ফিরে পেতাম, না। আমরা, দিনও চলত না আমাদের।’
‘চৌধুরী মঙ্গলরাম, তুমি কলম ধরতে জানো না, অথচ তুমি গ্রামের পঞ্চায়েতের সবকাজকর্মচালাও। আমলাদের কথা ছেড়ে দাও, এইসব বানিয়ারাও এক টাকা দিয়ে দুটাকার ফসল তুলে নিয়ে যেত। জ্যৈষ্ঠ মাস পার হতে না হতেই আমাদের ঘরে ইঁদুর চরে বেড়াত।’
‘আমরা তো তাই বলছি, আমাদের সুলতান লক্ষ বছর বেঁচে থাকুক।’
ব্ৰাহ্মণ পথিক অজ্ঞ আহীরদের মুখে এই তারিফ শুনতে শুনতে বিরক্ত হয়ে পড়ল, কিছু একটা বলার সুযোগ খুঁজতে লাগল সে। গুড় আর জল খাওয়ার পর সে আরও উতলা হয়ে উঠল! চৌধুরীদের কথা শেষ হচ্ছে না দেখে মাঝখানেই সে বলে উঠল, ‘সুলতান আলাউদ্দিন তোমাদের পঞ্চায়েত ফিরিয়ে দিয়েছে…’
‘হ্যাঁ পণ্ডিত মুখে ফুল-চন্দন পড়ােক। কিন্তু পণ্ডিত, জানি না কে আমাদের সুলতানের নাম অলাভদীন দিয়েছে। আমরা তো নিজেদের গায়ে লাভদীন বলি তাকে!’
‘তোমাদের যা খুশী নাম রাখ চৌধুরী! কিন্তু জানো, সুলতান হিন্দুদের ওপর কি ভয়ানক অত্যাচার করছে?’
‘আমাদের মেয়েরা গায়ে চাদর না দিয়েও রাত দিন বুক ফুলিয়ে ক্ষেতে-খামারে ঘুরে বেড়ায়। কই, কেউ তো তাদের টেনে নিয়ে যায় না!’
‘ইজ্জতওয়ালা ঘরের ইজ্জত নষ্ট করে তারা।’
‘তাহলে আমরা হলাম। সব বেইজ্জতওয়ালা কিন্তু তোমাদের সেই চোথামারা ইজ্জতওয়ালা কারা, পণ্ডিত?’।
‘তুমি অভদ্রভাবে কথা বলছি, চৌধুরী মঙ্গলরাম!’
‘কিন্তু পণ্ডিত, তোমার বোঝা উচিত যে, যখন থেকে আমরা পঞ্চায়েত ফিরে পেয়েছি, তখন থেকে আমাদের ইজ্জতও ফিরে এসেছে। এখন আমরা বুঝি, বড়-বড় আমলার দল হয়েছে, তারা সকলেই অত্যাচারী, তাছাড়া তাদের অধিকাংশই ছিল হিন্দু।’
চৌধুরী ছেদারাম বলে উঠল, ‘আমাদের বলা হয় হিন্দু-মুসলমান-এরা দু’জত আলাদা। কিন্তু দেখনি চৌধুরী, নিজেদের হিন্দু ব্ৰাহ্মণ-বলা এইসব লোকেরা নিজেদের ধ বৌদের সাত-পর্দায় ঢাকা বেগম বানিয়ে রাখছে।’
‘হ্যাঁ! অথচ আমার ঠাকুর্দা বলত যে, কনৌজ এবং দিল্লীর রাণীকে খোলা মুখে ঘোড়ায় চড়তে দেখেছে।’
ব্ৰাহ্মণ বলল, ‘কিন্তু চৌধুরী, সে সময় আমাদের ইজ্জত নষ্ট করবার মতো কোনো সলমান এ দেশে ছিল না।’
‘আজও আমাদের ইজ্জত ক্ষেতে-খামারে ঘুরে বেড়ায়, কেউ নষ্ট করে না তাকে।’
‘আর যদি কখনও নষ্ট হয়ে থাকে তো সে ঐ ব্ৰাহ্মণ সিকাবাদেরই চালে।’
‘বেকার বসে-খাওয়া এইসব লোক অন্যের ইজ্জত নষ্ট করা ছাড়া আর কি করবে!’
‘এ হিন্দু-মুসলমানের প্রশ্ন নয়। পণ্ডিত, এ হল যারা পরের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খায় তাদের কাজ। পাকা হিন্দু আমরাই পণ্ডিত। আমাদের মেয়ে-বউরা কোনোদিন সাত পর্দার আড়ালে থাকবে না।’