মঠের পুরনো মোহান্তদের সমাধিগুলোকে বন্দনা করে গ্রামবাসীরা চলে গেল। রাত বাড়বার সঙ্গে সঙ্গে রূপালী চাঁদের আলো চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। এই সময় কারিগরদের ঘরের দিক থেকে দুটো লোকের সঙ্গে একজনকে আঙিনার দিকে আসতে দেখা গেল। কাছে এলে মৌলানা আবুল-আলাইকে বাবা চিনতে পারল। তার মাথায় সাদা পাগড়ি, পরনে লম্বা চোগা, পায়ে জুতোর ওপর পর্যন্ত পায়জামা। তার কালো দাড়ি হাল্কা হাওয়ায় দুলছে। উঠে দাঁড়িয়ে দুই হাত বাড়িয়ে মধুর স্বরে বাবা বলল, ‘আসুন মৌলানা আবুল-আলাই। আসূসালাম-আলায়কুম।’ মৌলানার শক্ত দুই হাতকে নিজের হাতে নিয়ে তাকে আলিঙ্গন করল।
মৌলানাও অনিচ্ছুকভাবে ‘ওয়ালেকুম সালাম’ বলল!
তাকে খোলা পাটাতনের কাছে নিয়ে গিয়ে বাবা বলল, ‘আমার তখৎ এই নগ্ন পাথর, বসুন।’ মৌলানা বসবার পর বাবাও বাসল, প্রথমে মৌলানাই কথারম্ভ করল।
‘শাহ সাহেব, যখন এখানে কাফেরদের ভিড় লেগেছিল, তখন আমি দাঁড়িয়ে দেখলাম। সেই তামাসা।’
‘তামাসা! একশ’ বার বলুন মৌলানা, কিন্তু ‘কাফের’ বলবেন না। আপনি, নূরের হৃদয়ে যেন শরাঘাত হয় এতে।’
‘এই হিন্দুরা কাফের নয় তো কি?’
‘সকলের ভেতরই ঐ নূর রয়েছে; নূর আর কাফের, আলো আর অন্ধকারের বিবাদের মতো–এরা এক জায়গায় থাকতে পারে না।’
‘আপনার এই সমস্ত তসৰ্ব্ববুফ (বেদান্ত) ইসলাম নয়, ঐন্দ্রজালিক ভেল্কি।’
‘আমরা কিন্তু আপনাদের ভাবধারাকে ইন্দ্ৰজাল বা ভেল্কি আখ্যা দিই না। আমরা ‘এক নদীর বহু ঘাট’-এর অস্তিত্ব স্বীকার করি। আচ্ছা আপনারা সকল মানুষকেই খোদার সন্তান বলে মনে করেন না?’
‘হ্যাঁ, মনে করি।’
‘আর এও মানেন তো যে তিনি সর্বশক্তিমান।’
‘নিশ্চয়ই।’
‘মৌলানা, আমাদের সর্বশক্তিমান মালিকের হুকুম ছাড়া যখন গাছের একটা পাতাও করতে পারে না, তখন আমি বা আপনি আল্লার এই সমস্ত সন্তানকে কাফের বলবার কে? আল্লাহ যদি ইচ্ছা করতেন তাহলে সকলকেই এক পথে চালাতেন। চান না বলেই সকল পথই সমান প্রিয় তার।’
‘শাহ সাহেব, আমাকে আপনার তসকবুফের মিথ্যাগুলো শোনাবেন না!’
‘কিন্তু মৌলানা, এ তো আমি ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকেই বলছি। আমরা সুফিরা আল্লা এবং তাঁর বান্দাদের মধ্যে কোনো পার্থক্যই স্বীকার করি না। আমাদের কলুমা (মহামন্ত্র) হল, ‘অনল-হক (আমিই সত্যদেব), ‘হাম-ও-স্ত’ (সবই ঐ ব্ৰহ্ম)!’
‘এটা কাফেরের ধর্ম।’
‘আপনি এ কথা মনে করেন, আগেও অনেকে এমনি মনে করত, কিন্তু সুফিরা আপন রক্ত ঢেলে এই সত্য প্রতিষ্ঠা করেছে এবং প্রয়োজন হলে ভবিষ্যতেও করবে।’
‘আপনাদের জন্যেই এখানে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হতে পারছে না।’ ‘আগুন এবং তলোয়ারের সাহায্যে তাকে প্রতিষ্ঠা করবার যে প্রচেষ্টা আপনাদের; তাকে আমরা অন্যায় মনে করেছি। ঠিকই কিন্তু তার বিরুদ্ধে তো রুখে দাঁড়াইনি, তবু কতটুকু সাফল্য আপনারা লাভ করেছেন শুনি!’
‘আপনারা ওদের ধর্মকেও সত্য বলে মনে করেন?’ ‘হ্যাঁ, কারণ মহানৃ সত্যকে কুলুঙ্গীতে তুলে রাখার শক্তি নিজের ভিতর অনুভব করি না। আমরা, ইসলাম যদি তার শহীদদের কাছে সত্যি হয় যদি তসৰ্ব্ববুফ প্রতিভাবন প্রেমিকের কাছে সত্যি হয়, তাহলে হিন্দুরাও আপনাদের তলোয়ারের নিচে হাসতে হাসতে গর্দান এগিয়ে দিয়ে হিন্দু ধর্মকেই সাচ্চা প্রমাণিত করেছে।’
‘হিন্দু-মার্গ সাচ্চা! হিন্দুদের মার্গ পূবের, আমাদের হল পশ্চিমের, সম্পূর্ণ উল্টো।’
‘এতই যদি উল্টো হবে তবে আজ সন্ধ্যায় গ্রামের মুসলমান মঠকে পূজা দিয়ে গেল কেন হিন্দুরা? আপনি মুসলমানদের মধ্যে হিন্দুয়ানীর গন্ধ-মাত্র সহ্য করতে চান মৌলানা?’
‘না, সহ্য করা চলবে না।’
‘তাহলে সধবা মুসলমান স্ত্রীদের সিন্দুর মুছিয়ে দিন গিয়ে।’
‘মোছাব।’
বাবা হেসে বললেন, ‘সিন্দুর মোছাবে! এই জুম্মন, বল দেখি আমাকে, তোমার বিবি সলিমা কি মেনে নেবে ব্যাপারটা?’,་
‘না বাবা। মৌলবী সাহেব জানেন না, সিন্দুর শুধু বিধবাদের কপাল থেকেই মোছা যায়।’ পাশেই দণ্ডায়মান জুম্মন উত্তর দিল।
বাবা তার কথা বলে যেতে লাগল, ‘ক্ষমা করুন মৌলানা আবুল-আলাই, আমরা সুফিরা কোনো সুলতানের ভিক্ষা অথবা কোনো আমীরের দয়ার দান নিয়ে এখানে বসিনি। আমরা কৌপীন আর লেংটি পরে এখানে এসেছিলাম। কোনো হিন্দুই আমাদের বিরুদ্ধে অস্ত্ৰ-ধারণ করেনি। এই মঠটাকেই ধরুন, আগে এটা বৌদ্ধ-বিহার ছিল। আমার পূর্বতন পঞ্চম গুরু বৌদ্ধ-শ্রমণদের চেলা ছিলেন। তিনি এসেছিলেন–বুখারা থেকে এবং বৌদ্ধ শ্রমণদের বেদান্ত দ্বারা আকৃষ্ট হয়ে তাদের চেলা হয়েছিলেন। বেদান্তের বাণী সর্বক্ষেত্রেই এক; বাইরের পোশাকের এর কোনো পরিবর্তন হয় না–সে পোশাক বৌদ্ধদেরই হোক, হিন্দুর হোক বা মুসলমানেরই হোক। আমাদের ঐ গুরুর পরে এই মঠ মুসলমান নামধারী ফকিরদের জিন্মায় রয়েছে। পোশাক বদলানোর ওপর আমরা কোনো জোর দিইনি, আমরা লোককে প্রেম শিখিয়েছি, যার ফলে দেখতে পাচ্ছেন গ্রামের খুব কম লোকই আমাদের ঘৃণা করে দূরে সরে থাকে। পণ্ডিতগণের মধ্যে জড়তা ছিল, প্রেমের পথ তারা চিনতে পারেনি, আপনারাও যেমন চিনতে পারছেন না। আজ-আর এই জন্যেই জুম্মনের বাপ-দাদাকে হিন্দুর বদলে মুসলমান নাম ধারণ করতে হয়েছিল, তাই এদের কাছে আপনাদের খাতির রয়েছে।’
৩.
চৈত্র মাস শেষ হয়ে গিয়েছে। গাছে নতুন পাতা গজিয়ে উঠেছে। এ বছর খুব আম হয়েছে, আম গাছগুলোতে তাই পুরনো পাতাই রয়ে গেছে। নিচে খামারের উঠেন। সেখানে দুপুরের গরম আবহাওয়ার মধ্যেও দু’জন কৃষক মাড়াই করছে। এমন সময় একজন পরিশ্রান্ত পথিক ঘর্মািসক্ত হয়ে খামারের এক গাছের নিচে এসে বসল। তার মুখচোখের চেহারা দেখে তাকে ভিনদেশী বুঝতে পেরে মঙ্গল চৌধুরী তার কাছে এসে বলল, ‘রাম রাম ভাই, এই রোদুরে হাঁটা যথেষ্ট শক্তির কাজ।’