‘কাফেরদের সাকার স্বরূপ ধর্ম কেন?’
‘জাঁহাপনা, হিন্দুদের ব্ৰাহ্মণদের ধর্মে ও সিরাজনীহার (স্রষ্টা) আল্লাহ কথাও কিছু আছে, কিন্তু বৌদ্ধধর্ম তো তাঁকে একবারেই অস্বীকার করে।’
‘চেঙ্গিসের বংশ শুধু আজ নয়, কুবলাই খাঁর সময় থেকেই বৌদ্ধধর্মের বিশ্বস্ত অনুচর বলে মনে করে নিজেদের। শুধু তাই নয় চেঙ্গিসের ফৌজে, মোঙ্গলদের মধ্যে বহু সিপাহসালার এবং সৈন্য ছিল। বুখারা, সমরখন্দ বলখ ইত্যাদি ইসলামী দুনিয়ার শহরগুলোর মুসলমানী সভ্যতার সমস্ত কেন্দ্রকে বেছে বেছে নির্মূল করে দিয়েছে তারা; আমাদের নারীদের উচ্চ-নিচ বংশের বিচার না করে যথেচ্ছভাবে দাসীতে পরিণত করেছে; শিশুদের নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছে—আর এই সমস্ত অত্যাচারকে প্ররোচিত করেছিল বৌদ্ধ মোঙ্গলরা। তারা বলত, আরবেরা আমাদের বিহারসমূহ ধ্বংস করেছে, আমাদের এ সবের প্রতিশোধ নিতে হবে। ভেবে দেখুন, যদি মোঙ্গলেরা ভারতীয় বৌদ্ধদের সঙ্গে মিলে হিন্দুদের দলে টানতে পারত তবে ইসলামের অবস্থা কি হত?
‘নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত জাঁহাপনা।’
‘এই জন্যই বালুর চরে আমাদের রাজ্যের ভিত স্থাপন করা উচিত নয়, গোলামদের নকল করতেও আমরা পারি না।’
ওয়াজীর এতক্ষণ পর্যন্ত চুপ করে ছিল, এইবার সে মুখ খুলল, ‘সরকার আলী! গ্রামের আমলাদের ক্ষমতা কমে গেলে অতদূর পর্যন্ত সাম্রাজ্য পৌছাবে কি করে?’।
‘যখন রেশমী-পরা ঘোড়ায়-চড়া আমলারা ছিল না, তখন কি করে কাজ চলত?’
‘আমি সে সম্বন্ধে খোঁজ করিনি।’
‘আমি করেছি। যখন শাসকেরা নিজেদের লুণ্ঠনকারী বলে মনে করল, তখন তারা লুণ্ঠনকারী আমলা নিযুক্ত করল। সব জায়গায় এমনই হয়, কিন্তু তার আগে সমস্ত গ্রামে পঞ্চায়েত থাকত, পঞ্চায়েত গ্রামের মধ্যে লড়াই-ঝগড়া থেকে শুরু করে সরকারের রাজস্ব দেওয়া পর্যন্ত সমস্ত ব্যবস্থাই করত। গ্রামের কোনো এক ব্যক্তিকে নিয়ে রাজার কোনো দুশ্চিন্তা ঘটত না। সে শুধু পঞ্চায়েতের সঙ্গেই যোগাযোগ রাখত এবং জানত যে তার এবং খাজনা-দেনেওয়ালা কৃষকের মাঝে সম্বন্ধ স্থাপিত করবার জন্য এই পঞ্চায়েত রয়েছে।’
‘তাহলে জাঁহাপনা, একশ’ বছরের বেশি মৃত এই পঞ্চায়েতগুলোকে আবার আমাদের বাঁচিয়ে তুলতে হবে?’
‘এ ছাড়া দ্বিতীয় পথ নেই। যদি ইসলামী সাম্রাজ্যকে এ দেশে শক্তিশালী করে তুলতে হয়, তাহলে সূৰ্বতোভাবে প্রজাসাধারণকে সুখী ও সন্তুষ্ট রাখবার চেষ্টা করতে হবে, দিল্লীর সাম্রাজ্যে ইসলামী শরীয়তের জায়গায় সুলতানী শরীয়ত চালু করতে হবে। ইসলামের প্রচার মোল্লাদের কাজ, তাদের আমরা বৃত্তিদান করতে পারি। সুফিদেরও কাজ তাই এবং ভালোভাবেই কাজ করে যাচ্ছে তারা। তাদের মঠগুলোকে আমরা নগদ টাকা দিতে পারি অথবা সরকারি খাজনা থেকে রেহাই দিতে পারি।’
২.
বর্ষা শেষ হয়ে গিয়েছে, কিন্তু এখনও খালবিলগুলি জলে ভরে আছে। বড়-বড় বাঁধ দেওয়া ধানের ক্ষেতে জল জমে আছে, তার ভেতর সবুজ-সবুজ ধানের শিষ দুলছে। চারিদিকে সুদূর বিস্তৃত মগধের সবুজের মাঝখানে বড় হিলসা (পাটনা) গী। অবস্থিত, সেখানে কিছু ব্যবসায়ীদের ইটের পাকা বাড়ি, বাকি সব কৃষক এবং কারিগরদের খোলা বা খড়ের ঘর। এ ছাড়া ব্ৰাহ্মণদের কিছু বাড়ি আছে, তাদের অবস্থা অপেক্ষাকৃত ভালো। হিলসার মন্দিরসমূহ প্রায় একশ’ বছর আগে মহম্মদ বিন-বখতিয়ার খিলজির সৈন্যরাই বিধ্বস্ত করেছিল, তারপর থেকে সেই ভগ্নস্তুপগুলোকে যেখানে-সেখানে পূজা করছে হিন্দুরা। গায়ের পশ্চিম প্রান্তে বৌদ্ধদের মঠ, তার প্রতিমাগৃহ ভেঙে-চুরে গেলেও ঘর এখনও পর্যন্ত বাসযোগ্য। ভিতরে ঢুকে কেউ বলতে পারবে না যে, বৌদ্ধভিক্ষুরা তাদের ছেড়ে চলে গেছে।
সেদিন সন্ধ্যার সময় মঠের বাইরে পাথরের ছোট এক ঋটাতনের ওপর আধাবয়সী। এক পুরুষ বসে ছিল। বাদামী এক কৌপীনে তার শরীর ঢাকা। মাথা এবং ক্ৰ কামানো গোফ-দাড়ি খুব ছোট ছোট-মনে হয় এক সপ্তাহ আগে কামানো হয়েছিল। হাতে কাঠের মালা। দিনটা ছিল আশ্বিনের পূর্ণিমার দিন, গ্রামের নর-নারী সকলে খাবার, কাপড় এবং অন্যান্য জিনিসপত্র নিয়ে এসে কৌপীন-পরা পুরুষের সামনে, রেখে হাত জোড় করে দাঁড়িয়েছিল। পুরুষটি স্থিত মুখে হাত তুলে আশীৰ্বাদ করছিল সবাইকে।
এ সব কি? হিলসার পুরনো বৌদ্ধ মঠ নষ্ট হয়ে গেলেও মঠের বাইরের ভক্তগণের হৃদয়ে শ্রদ্ধার ভাব ঠিকই ছিল। আজ হিলাসায় কৌপীনধারী বাবাকে দেখে কি বৌদ্ধভিক্ষু ছাড়া অন্য কিছু বলা যায়! সে অবিবাহিত, তার পূর্বতন চারজন গুরুও অবিবাহিত ‘ কেীপীনধারী ছিল। হিন্দু অথবা বৌদ্ধ থেকে মুসলমান হওয়া দশ-পাঁচ ঘর কারিগর একে সন্ন্যাসীর সমাধি বলত; ব্ৰাহ্মণ এবং কিছু ব্যবসায়ী একে মঠ বলত না, কিন্তু গ্রামের বাকি। সকলে এখনও মঠ বলে। এই বাবার আগের সন্ন্যাসীদের কোনো জাতবিচার ছিল না, আর নতুন বাবাগণেরও জাত নেই। এরা কৌপীন পারত, অবিবাহিত থাকত। অসুস্থ হলে এরা ঔষধ-পথ্য দেয়, মরন ও শোকের সময় এরা অলখ-নিরঞ্জন নির্বাণের উপদেশ দিয়ে সান্ত্বনা। প্রদান করে। এই জন্য আজ শরতের পূর্ণিমার নির্বাণ দিনে লোকে আগের মতোই এই মুসলিম ভিক্ষুদেরও পূজা দেয়। আর কারিগর মুসলমানেরা আগে যেমন বৌদ্ধ-ভিক্ষুদের আপন পূজ্য গুরু বলে মান্য করত, এখন তেমনি বাবা এবং তার কৌপীনধারী চেলাদের মান্য করে। r