‘তাহলে এখন নিজেই দেখলেন তো মোল্লাসাহেব, যে কাজে সাম্রাজ্যের মঙ্গল সাধিত হয়, তাতে ইসলামেরও মঙ্গল।’
‘কিন্তু এক বিষয়ে আমার আর্জি আছে জাঁহাপনা! আপনি হলেন আমিরউলু-মোমিনীন (মুসলমানদের নায়ক).’
‘সেই সঙ্গে হিন্দুদেরও সুলতান আমি, ভারতবর্ষে মুসলমানদের সংখ্যা তো খুব কম, সম্ভবত হাজারে একজন!’
‘হিন্দুরা অবিরাম ইস্লামের অপমান করে চলেছে। এদের এই আচরণ ভবিষ্যতে আরও বেড়ে যেতে পারে। কাজেই এই অপমানকর আচরণ বন্ধ করতে হবে এবং সে কাজটা আপনারই।’
‘অপমান? কেন তারা কি পবিত্র কোরান পদদলিত করেছে?’
‘না, এত বড় সাহস কেমন করে তাদের হবে।’
‘তবে কি মসজিদকে অপবিত্র করেছে তারা?’
‘না, না, সেও সম্ভব নয় তাদের পক্ষে।’
‘না, জাঁহাপনা! বরং যারাই আমাদের সুফিগণের সংস্পর্শে এসেছে, খোদী-রসূলকে তারা ঋষির মতোই দেখছে। কিন্তু এরা যে আমাদের চোখের সামনে বসেই এদের কাফের ধর্ম পালন করে চলেছে!’
‘যখন তাদের কাফের বলেই মনে করেন, তখন তাদের কাফেরোচিত আচরণে আপত্তি কেন? আমার চাচা সুলতান জালালউদ্দিন আমার মতো মনস্থির করতে পারেননি যে, নিজেকে তিনি ভারতবর্ষের স্থায়ী শাসক রূপেই গণ্য করবেন, না। সমগ্র ভারত মুসলমান নাহওয়া পর্যন্ত এক অস্থায়ী শাসক বলে মনে করবেন। কিন্তু তিনি একবার আপনার মতো এ প্রশ্নকারীকে কি জবাব দিয়েছিলেন জানেন?’
‘না হুজুর-আলা!’
‘বলেছিলেন, ‘বেওকুফ দেখতে পাওনা আমার মনূজিলের সামনে দিয়ে প্রতিদিন হিন্দুরা শাখ বাজিয়ে ঢোল পিটিয়ে নিজেদের মূর্তিপূজোর জন্য যমুনার তীরে যায়, আমার চোখের সামনেই তারা তাদের কাফের-ধর্মের অনুষ্ঠান করে, আমার এবং আমার শাহীরোবকে (বাদশাহী মর্যাদা)। খাটো করে দেখে, তারা আমার ধর্মের দুশমন (হিন্দু) যারা আমার রাজধানীতে আমারই চোখের সামনে বসে বিলাস-ব্যসনের মধ্য দিয়ে জীবন : কাটাচ্ছে এবং ধন-দৌলত আর উন্নত অবস্থার জন্য মুসলমানদের সঙ্গে নিজেদের ঠাটঠমক আর অহঙ্কার জহির করছে। আমার কাছে এ লজ্জার কথা। ধনদৌলত সমস্তই আমি তাদের হাতে তুলে দিয়েছি। তাই আমি নিজে দান হিসেবে তাদের দেওয়া সামান্য খড়কুটো নিয়েই খুশী রয়েছি।’—আমার মনে হয় এর চাইতে ভালো জবাব আমিও দিতে পারি না।’
‘কিন্তু সুলতানে-জমানা, ইসলামের প্রতিও তো সুলতানের কর্তব্য রয়েছে।’
‘এমন অপরাধও যে করেছে, যার সাজা হল ফাঁসি, সেও ইসলামের শরণে এলে আমি
তাকে গোলামী থেকে মুক্ত করে দেবার হুকুম দিতে পারি। কিন্তু সরকারি খাজনা থেকে তার খরিদ-মূল্য দিয়ে। এই দেশে কোটি কোটি টাকা গোলাম রাখায় ব্যয় হয়েছে কাজেই ও ছাড়া সমস্ত গোলামের মুক্তির কথা তো আপনি বলতেই পারেন না।’
‘না জাঁহাপনা, গোলাম রাখার ফরম্যাজ তো আল্লাহ্ তালাও দিয়েছেন।’
‘না, যদি আপনি বলেন তো আমি তখতের বিনিময়েও মুসলমান-অমুসলমান সমস্ত দাস-দাসীর মুক্তির ফরমান জারি করতে পারি।’
‘কিন্তু তাহলে শরীয়তের বিরুদ্ধাচরণ করা হবে।’
‘শরীয়তের বিরুদ্ধাচরণের কথা ছাড়ুন মোল্লাসাহেব, এই মুহূর্তে আপনি নিশ্চয় কোনো প্রিয় দাসীর কথা ভাবছেন! সবচেয়ে বেশি গোলাম রয়েছে মুসলমানদেরই ঘরে।’
‘আল্লাহতালা মোমিনদের এই অধিকার স্বীকার করে নিয়েছেন!’
’কিন্তু দাস-দাসীরাও যদি মোমিন হয়! তা হলেও আমাদের মনে হয় আপনি এই দুনিয়ার মুক্ত হাওয়ায় ওদের নিশ্বাস নিতে দেবেন না এবং বেহেস্তের আশায় ওদের বসিয়ে রাখবেন।’
‘আমার আর কিছু বলার নেই ইসলামী সাম্রাজ্যে ইসলামী শরীয়তের শাসন চালু হওয়ার উচিত, আমি শুধু এই টুকুই বলতে চাই।’
‘কিন্তু এই চাওয়াটুকুই যে বিরাট এর জন্য ইসলামী সাম্রাজ্যের অধিকাংশ প্রজাকেই মুসলমান হতে হবে। আপনাদের সামনে–আপনিও শুনুন ওয়াজির সাহেব, আমার সাফ মতামত। সুলতান মামুদের মতো এক বিদেশী সুলতান জবরদস্ত সৈন্যবাহিনী নিয়ে শান্তিপূর্ণ শহরসমূহ লুণ্ঠন করতে পেরেছিল, লুটের মাল উট এবং খচ্চরের পিঠে বোঝাই করে নিয়ে যেতে পেরেছিল, কিন্তু সে রকম কোনো কাজ করা কাচ্চাব্বাচ্চা নিয়ে দিল্লীতে অধিষ্ঠিত আমার মতো লোকের ক্ষমতার বাইরে। আমার সরকার কায়েম হয়েছে হিন্দু প্রজাদের রাজস্বের ওপর, কায়েম হয়েছে হিন্দু সিপাই, সেনানায়কদের ওপর নির্ভর করে—আমার সেনাপতি হিন্দু; পাঁচ হাজার সৈন্যের সেনানায়ক চিতোরের রাজা আমার সপক্ষে।’
‘কিন্তু জাঁহাপনা গোলাম সুলতানও তো দিল্লীতেই থাকতেন।’
‘আপনি বাধা দেবেন না! আমাকে চঞ্চল এবং বদমেজাজী বলা হয়, কিন্তু এইসব বিরোধী মতামত শোনা থেকে আমাকে বিরত করতে পারে না। গোলামদের সরকার এক রাতের পাখীর বাসার সামিল ছিল। মোঙ্গলদের সৃষ্ট তুফানে হিন্দুস্থানের ইসলামিক রাজত্ব কোনো মতে বেঁচে গেছে। হিন্দুরা জানত না যে, মোঙ্গলদের মতো দুশমন, মুসলমানেরা কখনও দেখেনি। তারা যদি মোঙ্গলদের সামান্য উৎসাহও দিত। তবে ভারতের মাটিতে নতুন ইসলামী সাম্রাজ্য দাঁড়াতেই পারত না। আপনারা জানেন না যে, চেঙ্গিসের বংশ দুনিয়ার সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্য চীনের ওপর আধিপত্য করছে!’
‘জানি হুজুর-আলা।’–মোল্লা বলল।
’ঐ বংশ বৌদ্ধধর্মকেই অনুসরণ করে।’
‘বৌদ্ধধর্ম! এত সব মঠ-মন্দির জ্বলিয়ে, মাটিতে মিশিয়ে দেবার পরও কাফেরদের সাকার স্বরূপ ধর্ম ভারতের মাটি থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় নি!’