“চণ্ডাল এবং ব্রাহ্মণের ভেদাভেদও ঘুচিয়ে দিতে হবে।”
“নিশ্চয়ই গুরু দ্রোণ।”
১৫. বাবা নুরদীন (কাল: ১৩০০ খৃষ্টাব্দ)
‘সে সব দিনকাল শেষ হয়েছে, যখন আমরা ভারতভূমিকে দুগ্ধবতী গাভীর চেয়ে বেশি। কিছু ভাবতে পারতাম না। তখনকার দিনে কৃষক, কারিগর, ব্যবসায়ী ও রাজাদের কাছ থেকে আদায় করে অনেক বেশি ধনদৌলত জমা হত আমাদের হাতে স্কুর্তি করে ওড়াতাম আর টাকা পাঠাতাম গোর দেশে। এখন আমরা আর গোরের অধীন নই, স্বাধীন খিলজী শাসক আমরা?’ কথাগুলো বলল একটি তীক্ষ্ণবুদ্ধি যুবক নিজের কালো দাড়ির ওপর হাত বুলোতে বুলোতে। তার সামনে বসে শুভ্ৰশ্বাশ্রমণ্ডিত সৌম্য সম্ভান্ত চেহারার একজন পুরুষ, পরনে সাদা আচকান, মাথায় বিরাট পাগড়ি।
বৃদ্ধ বলল, ‘কিন্তু জাঁহাপনা। মোড়ল, মাতব্বর, প্যাটেল, তালুকদার এদের স্বাৰ্থ যদি ক্ষুন্ন করা হয় তবে তারা বিগড়ে যাবে, আর খাজনা আদায় করার জন্য গ্রামে গ্রামে ফৌজ পাঠাবার সামৰ্থ্য আমাদের নেই।’
‘প্রথমে এই বিষয়ে আপনাকে মন স্থির করতে হবে যে, আপনারা ভারতের অধিবাসী। হয়ে ভারতবর্ষের শাসক রূপে এ-দেশে অবস্থান করবেন–না, উট ও খচ্চরের পিঠে। বোঝাই করে হীরা-মুক্ত লুণ্ঠনকারী গোর-গজনীর দাসু রূপে বাস করবেন!’
‘এখন ভারতবর্ষেই আমাদের বসবাস করতে হবে জাঁহাপনা।’ ‘হ্যাঁ, পূর্বতন শাসকদের মতো আমাদের অস্তিত্বের মূল এখন আর গোরে নেই। দিল্লীতে যদি কোনো বিদ্রোহ, অশান্তি শুরু হয় তবে আরব, আফগানিস্তান থেকে সাহায্য আমরা পাব না, অথবা কোথাও পালিয়ে গিয়েও নিস্তার পাব না।’
‘এ কথা স্বীকার করি জাঁহাপনা!’
‘সুতরাং এই আমাদের ঘর, এখন এখানেই থাকতে হবে, আর এ জন্য আমাদের–এমনভাবে এই ঘর তৈরি করতে হবে যাতে এখানকার লোকে সুখী এবং শান্ত থাকে। এখানকার প্রজাদের মধ্যে ক’জনই বা মুসলমান আছে? একশ’ বছরের ভেতর দিল্লীর আশপাশের জায়গাগুলোকেও আমরা মুসলমান করে তুলতে পারিনি। মোল্লা আবু মোহাম্মদ, আপনি কত দিনের ভেতরে সমগ্ৰ দিল্লী এবং এই দেশকে মুসলমানে রূপান্তরিত করতে পারেন, বলুন তো?’
সম্মুখে উপবিষ্ট তৃতীয় বৃদ্ধ দাঁতহীন ঠোঁটের নিচ থেকে নাভি পর্যন্ত প্রলম্বিত সাদা দাড়ির গোছা ঠিক করতে করতে বলল, ‘আমি নিরাশ হইনি। সুলতানে-জমানা। তবে। অশীতি বর্ষের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি যে, যদি জবরদস্তি করে মুসলমান করাতে চাই
‘এ জন্য ভারতে অধিষ্ঠিত মুসলমানেরা সমগ্ৰ ভারতবর্ষ মুসলমান হয়ে যাবার দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারে না। এক শতাব্দী আমরা এই ভাবেই কেটে যেতে দিয়েছি, এবং নিজেদের প্রজা-সম্বন্ধে কোনো কিছু না ভেবে যথাশক্তি শুধু জমির খাজনা বাণিজ্য শুল্ক এবং রাজস্ব আদায় করতেই চেয়েছি। তার পরিণাম হল-নবাবের খাজনা বাবদ এক টাকা আনে তো পাঁচ টাকা যায় তাহশীল আদায়কারীর পেটে। দুনিয়ার আর কোথাও দেখেছেন, গ্রামের কর্মচারীরা রেশমী পোশাক পরে ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়ে বের হয়, ইরানের তৈরি তীর-ধনুক ব্যবহার করে! না-ওয়াজির-উল-মূলক আমার রাজ্যে এই ধরনের অবাধ লুণ্ঠন এখনই বন্ধ করতেত হবে।’
‘কিন্তু হুজুর! বহু হিন্দু, মুসলমান হয়েছে এই লোভেই। এ-বার তাহলে সে পথও বন্ধ, হয়ে যাবে।’–মোল্লা বলল।’
‘ইসলামও যদি এই ধরনের লুট এবং ঘুষের ব্যাপার সমর্থন করত, তবু সরকারী খাজনা এবং সরকারি সম্পত্তির স্বার্থে সে-সব বরবাদ করে দেওয়া হত। তাছাড়া যে সরকারের কর্মচারীরাই লুট করে তার আর আশা-ভরসা কি?’
‘রাজ্যের ভিত এদের দিয়ে মজবুত হতে পারে না, স্বীকার করতেই হবে জাঁহাপনা। কিন্তু আমি শুধু বিদ্রোহ ও বিপদের কথাই ভাবছিলাম।’–ওয়াজির বলল।
‘গ্রামের আমলারা তাই করে বসবে। যদি তাদের ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হয়, এ কথা ঠিক। কিন্তু গ্রামে আমলার সংখ্যা বেশি—না কৃষকের সংখ্যা বেশি?—কৃষকের। আমলা তো প্রতি একশ’ কৃষকে মাত্র একজন। এই একশ’ কৃষকের রক্ত চুষেই ঐ একজন ঘোড়ায় চড়ে, রেশমী পোশাক পরে আর ইরানী তীর-ধনুক ব্যবহার করে। এই ধরনের রক্তচোষা বন্ধ করে আমরা কৃষকের অবস্থায় উন্নতি করব! তাদের সরকারের অনুগত করে তুলব। একজনকে অখুশী রেখে একশ’ লোককে খুশী করে তোলাই কি ভালো কাজ হবে না?’
‘ঠিকই বলেছেন হুজুর! এ বিষয়ে আমারও এখন আর সন্দেহ নেই যদিও হিন্দুস্থানের মুসলমান সুলতাগণের মধ্যে এক নতুন পন্থী আপনি অনুসরণ করতে যাচ্ছেন। এই পথেই হয়ত সাফল্য লাভ করা যাবে। এতে গ্রামের উচ্চশ্রেণীর কিছু লোককে শুধু অখুশী করে তুলব আমরা।’
‘গ্রামে এবং শহরে উচ্চশ্রেণীর সামান্য কিছু লোক অখুশী হয়ে উঠলে কিছু যায় আসে। না। এখন শাসনকার্যের পাকাপোক্ত ইমারতের বুনিয়াদ তৈরি করতে হবে।’
‘মোল্লা কি যেন চিন্তা করে বলল, ‘হুজুরআলী, আমিও এখন বুঝতে পারছি, গাঁয়ের সমগ্র কৃষকশ্রেণীর সুখ-সুবিধার প্রতি নজর রাখলে সরকারের পক্ষে সেটা লাভজনক হবে। গ্রাম এবং শহরের তাঁতীদের প্রতি সামান্য নজর দিয়েছি আমরা। পঞ্চায়েতকে মজবুত করে তুলতে তাদের সাহায্য করেছি, যাতে বেনে-মহাজনদের লুটের হাত থেকে রেহাই পায়। তারা। আগে প্রত্যেক আমলা এদের দিয়ে বেগার খাঁটিয়ে নিজেদের জন্য কাপড় তৈরি করাত, আমরা সে-সব বন্ধ করে দিয়েছি। এখন। আজ তার পরিণাম দেখতে পাচ্ছি-ধুনুরী, তাঁতী আর দর্জির ভিতর এমন লোক এখন আর দেখাই যায় না। যারা ইস্লামের আওতায় চলে আসেনি।’