“এখন আপসোশ করে কোনো লাভ নেই। কি কি ব্যবস্থা করলে বল।”
“পঞ্চাশ জন করে ভাগ করা সৈন্যদলে বোঝাই পাঁচশ নৌকা এখনই এসে পড়বে। গাগা, মোগে, সলখুর নেতৃত্বে গোটা সৈন্যবাহিনীটাকে ভাগ করে আমি আদেশ দিয়ে দিয়েছি যে, চন্দাবর থেকে পুবে সরে এসে তুর্কিদের সঙ্গে যুদ্ধ কর—সম্মুখ-সমরে কম এগুবে, অতর্কিত আক্রমণই বেশী চালাবে এবং পরিস্থিতি প্রতিকুল হয়ে পড়েছে দেখলে পুবদিক হঠে আসবে।”
“কনৌজের রাজপ্রাসাদ….?”
“সেখান থেকে জিনিস সরানো সম্ভব, সরিয়ে ফেলেছি আমি দু’দিনে আগে সঙ্গাতেই অনেকগুলো নৌকা নামিয়ে দিয়েছি।”
“এই জন্যই তোমাকে সেনাপতির রোষ থেকে বাঁচিয়েছিলাম মাধব। না হলে নিজের আগে, তোমাকেই সে মেরে ফেলত। তোমাকে এবং কুমারকে জীবিত দেখে আমি বড়ই সুখী। হিন্দুদের কিছু আশা রইল। শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত আমাদের সমস্ত শক্তি দিয়ে, প্রতি পরমানু পরিমাণ শক্তি বুঝে-শুনে ব্যয় করে লড়তে হবে আমাদের।”
“কতকগুলো নৌকা আসছে বলে মনে হচ্ছে আচার্য?”
“সেনানায়ক আলহন, ওগুলো এলেই ওদের সব এখানে থেকে চলে যাওয়ার আদেশ দিয়ে দেবে।”
“আচ্ছা আচার্য’—বিনীতভাবে বলল আলহন।
“গলুয়ের ভিতরে চল আধব। ওখানে অন্ধকার রয়েছে—ইচ্ছা করেই আমি ওখানকার প্রদীপ নিভিয়ে দিয়েছি।” একটু এগিয়ে তিনি ডাকলেন, “রাধা!”
“বাবা!” এক তরুণী নারীকণ্ঠ থেকে আওয়াজ এল। চক্রপাপি মাধবের দিকে ফিরে বললেন, “কেউ বৈদ্যরাজ বলে, কেউ আচার্য, কেউ বা বাবা! এ-সব মনে রাখাও আমার পক্ষে মুশকিল হয়ে পড়েছে। তোমরা সবাই আমার ছেলেবেলার নাম ‘চক্কু’ বলে আমাকে ডাকবে।”
“উহু। স্ত্রীলোকের অভ্যাস বদলানো শক্ত, এ জন্য আমরা আপনাকে বাবা চক্রপাণি পান্তেয়র জায়গায়,শুধু বাবা বলব।”
“বেশ! চল, বাতি জ্বলে গেছে।”
সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামল দু’জনে। নৌকায় দুই-তৃতীয়াংশ জুড়ে পাটাতন, তার নীচে পর পর দুটো কুঠুরী; নৌকার একদিকে খানিকটা জায়গা খালি। দু’জনে একটা কুঠুরীর ভিতর ঢুকল। প্রদীপের মৃদু আলোয় একটা খাট দেখা যাচ্ছে। আকণ্ঠ সাদা শাল মুড়ি দিয়ে একটা লোক শুয়ে রয়েছে। খাটের পাশে মোড়ার ওপর থেকে এক তম্বী উঠে দাঁড়াল। চক্রপাণি বললেন, “কুমারের কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো ভামা?”
“না বাবা, শ্বাস-প্রশ্বাস নেই এক রকম ভাবেই চলছে।”
“ঘাবড়ে যাওনি তো তুমি?”
“চক্রপাণির ছত্র-ছায়ায় থেকে ঘাবড়াব? গহড়বার বংশ যদি প্রথমেই তাদের এই গুরু দ্রোণেচার্ষাকে চিনতে পারত!”
“আমাদের প্রধান সেনাপতি পরম সহায়ক মহারাজাধিরাজ হরিশ্চন্দ্রের সেনাপতি জানাল মাধব এসে গেছে দেখ।”
“মহাদেবী ভামা, আপনাদের সেবক মাধব সেবার জন্য উপস্থিত”—এই বলে অভিবাদন জানাল মাধব।
“মাধবের সঙ্গে অপরিচিত নই আমি। কুমারের পাশাখেলার সঙ্গীকে কি ভুলতে পারি কখনও?”
“আর যার অমিত বীর্ষ গহড়বার বংশের ধূলি-লুণ্ঠিত লক্ষ্মীকে পুনরায় তুলে ধরবার শক্তি রাখে ভামা!”
“আপনার মুখে “ভামা” ডাক কত মধুর শোনায় বাবা!”
“নিজের বাবার কথা মনে পড়ে যায় বোধহয়, না?”
“না বাবা, রাজকুলে আমাদের অন্য রকম আবহাওয়ার সৃষ্টি করতে হবে। উঃ কি মিথ্যা ঠাট, কি ভণ্ডামি! মানুষের মধ্যে সহজ সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে। আমার শ্বশুরের সঙ্গে পুরাতন রাজকুলের নীতিকেও শেষ করে দিতে হবে।”
“শেষ হয়ে গেছে পুত্রী। বহুদিন আগেই শেষ হয়ে গেছে তা। কুমারের অন্তঃপুর দেখেছ তো তুমি?”
চোখের জল মুছে ভামা বলল, “আপনিই আমাদের মানুষ করেছেন বাবা।”
“না পুত্রী, কুমার হরিশ্চন্দ্রের জায়গায় এ যদি অন্য কেউ হত, তবে আমাকে শুধু শূণ্য চেয়েই থাকতে হত। এ সব কিছুই কুমার হরিশ্চন্দ্র…”
“বাবা!”
কুমারের চোখের পাতা অর্ধ উম্মীলিত হতে দেখা গেল। দৌড়ে তার কাছে গিয়ে ভামা বলল, “চন্দ্র আমার! রাহুর গ্রাসমুক্ত চাঁদ!”
“ঠিক বলেছ ভামা! কিন্তু এইমাত্র যেন বাবার গলার স্বর শুনতে পাচ্ছিলাম আমি?”
“বাবা?”
“সে বাবা নয়, যিনি গহড়বারের সূর্যকে ডুবিয়ে দিয়েছেন; এইবার যাকে তুমি বাবা বলে ডাকলে, আর আমিও যাকে বাবা বলেই ডাকব।”
প্রদীপের আলোয় কুমারের পাংশু চেহারা দেখে তার কপালে হাত রেখে চক্রপাণি বললেন, “শরীর কেমন আছে কুমার?”
“শরীর এত ভালো যে, মনে হয়, আমি যুদ্ধক্ষেত্রে থেকে আহত হয়ে ফিরিনি।”
“ক্ষত কিন্তু খুব সাঙ্ঘাতিক ছিল কুমার!”
“হবে, কিন্তু আমার পীষুবপাণি বাবাও যে কাছে ছিল আমার!”
“একটু কম কথা বল কুমার।”
“বাবা চক্রপাণির মুখের প্রতিটি কথা হরিশ্চন্দ্রের কাছে ব্রক্ষবাক্যতুলা।”
“কিন্তু এমন হরিশ্চন্দ্র চক্রপণির কোনোই কাজে আসবে না যে!”
“ এ হল শুধু হরিশ্চন্দ্রের শ্রদ্ধার কথা; কিন্তু বুদ্ধি-বিবেচনার প্রশ্ন যেখানে, সেখানে হরিশ্চন্দ্র ব্রহ্মবাক্যকেও যাচাই না করে গ্রহণ করবে না।”
“আর বাবা চক্রপাণিকে পেয়ে…—একটু জল।”
তাড়াতাড়ি গ্লাসে জল গড়িয়ে দিল ভামা। নৌকা চলতে শুরু করেছে দেখে বাবা বললেন, “আমরা দ্বিতীয় রাজধানী বারাণসী চলেছি কুমার। সেনাপতি মাধব সৈন্যবাহিনীকে যথারীতি আদেশ দিয়েছে। সৈন্যরা এদিক থেকে তুর্কীদের গতিরোধ করবে। ওদিকে বারাণসীতে গহড়বার লক্ষ্মীর জন্য নতুন সৈন্য সংগ্রহ করব আমরা।”
“না বাবা, আগে যেমনটি বলতেন আপনি, সেই হিন্দু রাজলক্ষ্মী পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার আয়োজন করুন। পুনঃপ্রতিষ্ঠিত এই রাজলক্ষ্মী এ-বার হিন্দুর রাজলক্ষ্মী হবে। হিন্দুর বাহুবলে জয় করেই একে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।”