“কান্যকুব্জের সিংহাসন জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে কুমার। সামান্য ভুল পদক্ষেপেই সমগ্র ইমারত ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। পিতাপুত্রের কলহের সময় এখন নয়।”
“এখন কি করা যায় বৈদ্যরাজ? আমাদের সমস্ত সেনাপতি ও সেনানায়কেরা ভীরু এবং অযোগ্য। তরুণ সেনানায়কদের মধ্যে অবশ্য যোগ্য এবং সাহসী কিছু লোক আছে, কিন্তু বুড়োরা পথ বন্ধ করে বসে আছে। মন্ত্রীদের ঐ একই অবস্থা, তারা রাজার প্রশস্তি গাওয়াকেই শুধু আপন কর্তব্য বলে জ্ঞান করে।”
“রাজান্তঃপুরে মেয়ে-বোনকে পাঠিয়ৈ যারা পদলাভ করে তাদের এই অবস্থাই হয়। কিন্তু অতীত নয়, ভবিষ্যতের চিন্তাই আমাদের করতে হবে এখন।”
“আমার হাতে ক্ষমতা থাকলে সমস্ত হিন্দু তরুণের হাতে অস্ত্র তুলে দিতাম।”
“কিন্তু এ হল বংশানুক্রমিক ত্রুটি, যাতে শুধু রাজপুতকেই যুদ্ধের অধিকারী করে রাখা হয়েছে। মহাভারতে দ্রোণ এবং রুপের মতো ব্রাহ্শণরাও যুদ্ধ করেছে’ কিন্তু পরে শুধু এক জাতির…”
“এই জাত-বেজাতের ব্যাপারটাও আমাদের সামনে এক বিরাট বাধা।”
“সবচেয়ে বড় বাধা, কুমার। পূর্বজগণের দ্বারা অনুষ্ঠিত সৎকাজের জন্য সর্বানুভব করা এক জিনিস কিন্তু চিরদিনের জন্য হিন্দুদের সহস্রভাগে ভাগ করে রাখা মহাপাপ।”
“এর ফল এখন ভুগতে হচ্ছে। কাবুল এখন আর হিন্দুদের হাতে নেই, লাগোরও গেছে, এ-বার দিল্লীর পালা।”
“আজ যদি আমরা পৃথ্বিরাজের সঙ্গে এক হয়ে যুদ্ধ করতে পারতাম?”
“উঃ, কি দুর্ভাগ্য, বৈদ্যরাজ!”
“দুর্ভাগ্যের বোঝা ভারী হয়ে আামদের নৌকা ডুবতে যাচ্ছে কিন্তু মোহাচ্ছন্ন আমরা! কিছুটা বোঝা নামিয়ে দিয়ে নৌকা হাল্কা করতে চাইছি না।”
“ধর্ম থেকে অজীর্ণ হয়েছে, বৈদ্যরাজ।”
“ধর্মের ক্ষয়রোগ! কি অত্যাচারই না আমরা করেছি? কোটি-কোটি বিধবাকে প্রতি বছর আগুনে পুড়িয়েছি। নর-নারীকে নিয়ে পশুর মতো বেচা-কেনা করেছি। দেবলয় এবং বিহারে সোনা-চাঁদি আর হীরামোতির বাহার বসিয়ে স্বেচ্ছ লুণ্ঠনকারীদের আমন্ত্রণ জানিয়েছি, আর শুত্রুর সঙ্গে মোকাবিলা করার সময় আত্মকলহে ডুবে থেকেছি। আপন ইন্দ্রিয়লালসা চরিতার্থ করার জন্য প্রজাদের শ্রমার্জিত সম্পদকে নিষ্ঠুরভাবে লুণ্ঠণ করেছি আমরা।”
“শুধু লালসা নয় বৈদ্যরাজ, উদ্মত্ততা। নিজের কাম-সুখ চরিতার্থ করতে প্রিয়তমা সহৃদয়া একজন স্ত্রী-ই যথেষ্ট, আর ইন্দ্রিয় লোলুপতাকে প্রশমিত করতে পঞ্চাশ হাজারও কিছুই নয়।এখানে ভালোবাসার কোনো স্থান থাকতে পারে না। গত সংক্রান্তির দিন বাবা যখন আপন অন্তঃপুরবাসিনী স্ত্রীলোকদের অনেককেই ব্রাহ্মণদের দান করে দিলেন, তখন তারা কেউই মহারাজের জন্যে একফোঁটা চোখের জলও ফেলেনি বরং ভিতরে ভিতরে খুশীই হয়েছে। ভামা আমাকে এ কথা বলেছে।”
“দান গ্রহণকারী ব্রাহ্মণের ঘরে খুব বেশী হলে একটি বা দুটি সতীন থাকতে পারে, ষোল হাজারের ভীড়ে সেখানে থাকবে না। অবশ্য একেও আমি দাসত্ব বলে মনে করি। স্ত্রী লোক কি একটা সম্পত্তি যে, তাকে এইভাবে দান করা যাবে?”
“আমাদের চেষ্টা করতে হবে সমবেতভাবে তুর্কীদের মোকাবিলা করার।”
“সে-সব তো মহারাজের হাতে। ভণ্ড শ্রীহর্ষ তাঁর কানের পাশে লেগে রয়েছে।”
৫
অষ্টমীর রাত। সবে মাত্র চাঁদ উঠেছে; গোটা পৃথিবীটা আলোকিত হয়ে উঠতে এখনও দেরী। চারিদিকে অখণ্ড নিস্তব্দতা, তারই বুক চিরে মাঝে মাঝে পেচকের ভীতিপ্রদ ডাক শোনা যাচ্ছে। নিঃসীম এই নিস্তব্দথার মাঝে দু’জন লোক তীর থেকে দ্রুত যমুনার জলে নেমে পড়ল। মুখে আঙ্গুল দিয়ে তিনবার শিস দিল তারা। যমুনার অপর দিক থেকে একটি নৌকা আসতে দেখা গেল। নীরব-প্রবাহিত জলস্রোতে ধীরে ধীরে দাঁড় টেনে মাঝারি গোছের এক নৌকা পারে এসে ভিড়ল। লোক দু’জন নিঃশব্দে নৌকায় উঠে পড়ল। ভিতর থেকে কে যেন জিজ্ঞাসা করল,“সেনানায়ক মাধব?”
“হ্যাঁ আচার্য, আলহনও আমার সঙ্গে এসেছে। কুমার কেমন আছেন?”
“এখন পর্যন্ত তো জ্ঞান হয়নি; তার অবশ্য আমি সামান্য ওষুধ দিয়ে রেখেছি। কি জানি, জ্ঞান হলেই যদি রণক্ষেত্রে ফিরে যেতে চায়!”
“কিন্তু আচার্য, আপনার আদেশ কখনও অমান্য করতে পারেন না তিনি।”
“ সে আমিও বিশ্বাস করি; কিন্তু এই-ই ভালো, ক্ষতের ব্যাথাও এতে কমে যাবে।”
“ক্ষততে ভয়ের কিছু নেই তো, আচার্য?”
“না সেনানায়ক, ক্ষত আমি সেলাই করে দিয়েছি এবং রক্তস্রাব বন্ধ হয়ে গেছে। দুর্বলতা খুবই আছে, কিন্তু ভয়ের কিছু নেই আর। এ-বারে বল কি-কি কাজ শেষ করে এলে তুমি? মহারাজের শব রাজান্তুঃপুরে পাঠিয়ে দিয়েছ?”
“হ্যা।”
“এখন তবে রাজান্তঃপুরের স্ত্রীলোকেরা মহারাজের সঙ্গে সহমরণে যাবে!”
“যার যাওয়ার সে যাবে।”
“আর সেনাপতি, তার খবর কি?”
“বুড়ো সেনাপতি তো মরতে মরতে শেষ পর্যন্ত উঠে দাঁড়াল। অবস্থা সঙ্গীন দেখে বহু সেনানায়ক পালিয়েছে, কিন্তু পালাবার কৌশল তারা জানে না। আমি আশা করি না যে, ওদের মধ্যে কেউ বেচেঁ আছে।”
“এ-সব ব্যাপার যদি তিন বছর আগে ঘটত এবং কুমার হরিশ্চন্দ্র যদি আমাদের রাজা আর তুমি মাধব কান্যকুব্জের সেনাপতি হতে!”
দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে মাধব বলল, “আপনার প্রতিটি কথা তীক্ষ্ণ ক্ষুরধার, আচার্য। মহারাজকে আপনি অনেক করে বুঝিয়েছিলেন যে, পৃথ্বিরাজের সঙ্গে এক হয়ে ত্বকীদের বিরুদ্ধে লড়াই করা উচিত, কিন্তু সে সবই অরণ্যে রোদন হয়েছে।”