“কিন্তু তুমি তো বেদাস্ত-বিশারদ কবি!”
“আমার গ্রন্থকে আমি বেদান্ত বলেই প্রসিদ্ধ করে নিয়েছি মহারাজ, কিন্তু ‘খণ্ডন-খণ্ড খাদ্য’-তে নাগার্জুনের চরণধুলিকেই বিতরণ করেছি সর্বত্র।”
“মনে তো থাকবেই না, তবু বল শুনি নাগার্জুনের মূল কথা কি?”
“সিদ্ধরাজ মিত্রপাদ তো নাগার্জুনের দর্শনেই বিশ্বাস করেন।”
“আমার দীক্ষাগুরু?”
“হ্যাঁ। নাগার্জুন বলেন—পাপ-পূণ্য, আচার-দুরাচার সবই কল্পনা, জগতের সত্তা-অসত্তা কিছুই প্রমাণ করা যায় না। স্বর্গ-নরক, বন্ধন-মোক্ষ সবই ভ্রম। পূজা, উপাসনা এগুলো মূর্খ লোকদের বঞ্চনা করার জন্য; দেবদেবী সম্বন্ধে লোকেত্তর সব ধারণাই অলীক।”
“আমিও তো এই দর্শনকে অনুসরণ করেই জীবন কাটিয়েছি কবি!”
“সকলেই কাটায় মহারাজ, মুর্খেরাই শুধু নগদ ছেড়ে ধারের পেছনে ছোটে!”
“কিন্তু এখন যে আমার নগদকে সামনে ফেলে রেখে শুধু এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে হয় বন্ধু! কিন্তু তোমার এখনও বয়স পেরোয়নি বলেই মনে হয়।”
“আপনার চেয়ে আমি আট বছরের ছোট, তা’ছাড়া একটির বেশী বিয়েও করিনি।”
“বেশী বিয়ে করলে বিয়ের পাকেই ক্লান্ত হয়ে মারা পড়ে মানুষ!”
“আমার ঘরে একটি মাত্র ব্রাহ্মণীই আছে মহারাজ।”
“এবং তোমার ধারণা যে, সমগ্র দুনিয়া তাই বিশ্বাস করবে—কবি শ্রীহর্ষ সেই দাঁতভাঙা একটি বুড়ির প্রতি একান্ত অনুরক্ত!”
“বিশ্বাস করবে এবং করছেও মহারাজ! আমার গ্রন্থে আমি আমার সমাধিস্থ হয়ে ব্রহ্ম-সাক্ষাৎকারর কথা লিখেছি।”
“তোমাদের মাধ্যমিক দর্শনে তা’হলে ব্রহ্ম এবং তাঁর সাক্ষাৎকারের স্থানও আছে?”
“কিসের স্থান ওতে নেই মহারাজ!”
“প্রজাদের দৃষ্টি চিরকালের মতো অন্ধ করে রাখতে হবে তাই সব রকমের সাক্ষাৎকারের কথা তাদের মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া দরকার!”
“ধর্মের ওপর থেকে আপনার বিশ্বাস তবে উবে গেল মহারাজ?”
“সে আমি জানি না, আমি বুঝতেই পারি না, কখন বিশ্বাস আসে কখন চলে যায়। তোমাদের মতো ধর্মাত্মা, ব্রাহ্মণদের আচার-উপদেরশ দেখে-শুনে মন স্থির করাই আমার পক্ষে মুস্কিল। আমি শুধু এইটুকু বুঝি, দান-পূণ্য, দেবালয়-সুগতালয় নির্মাণ ইত্যাদি যা খুশী ধর্মে বলে তা কর; কিন্তু জীবনের নগদ সম্পদকে হাত থেকে চলে যেতে দিও না।”
প্রেম এবং ধর্ম থেকে এঁদের আলোচনা রাজকার্যে এসে পড়ল। শ্রীহর্ষ বললেন, “মহারাজ কি পৃথ্বিরাজকে সাহায্য করতে সত্যিই অস্বীকার করেছেন?”
“তাকে সাহায্য করার কি দরকার আমার? নিজে গায়ে পড়ে ঝড়ের সঙ্গে লড়াই বাধিয়েছে সে,নিজেই ভুগবে তার ফল!”
“আমারও সেই মত মহারাজ, চক্রপণি মিছিমিছি ফালতু বিরক্ত করছে।”
“তার কাজ হল চিকিৎসা করা। সেখানেও সে কিছুই করে উঠতে পারছে না। তিনবার আমি বাজীকরণ চিকিৎসা করিয়েছি, কিন্তু সবই বিফলে গেছে। এখন উনি এসেছেন রাজকার্যে পরামর্শ দিতে!”
“ও একটা নিরেট মুর্খ, অনর্থক ওকে মাথায় তুলে রেখেছেন যুবরাজ।”
৪
“ঠিক বলেছেন বৈদ্যরাজ! গহড়বারের মূল ঘুণ ধরাতে আরম্ভ করেছে শ্রীহর্ষ। বাবাকে সে অন্ধ কামুক বানিয়ে রেখেছে।”
!বিশ বছর আমি কন্যাকুত্তের রাজবৈদ্য, আমার ওষুধের কিছু গুণ অন্তত আছে।”
“ সে গুণের কথা সারা দুনিয়া জানে বৈদ্যরাজ।”
“কিন্তু বাজীকরণের ব্যাপারে মহারাজ খুশী ননা। অতিকামুক পুরুষের তারুণ্যকে ততদিন পর্যন্ত জীইয়ে রাখা যায় কুমার? এই জন্যই আহার-বিহারে সংযম অভ্যাস করার কথা লেখা হয়েছে। আমি তো মহারাজকে বলেছি যে, আমাকে মল্লগ্রাম (মালাঁও—গোরক্ষপুর) গিয়ে থাকতে দিন। কিন্তু উনি তাতেও রাজী নন।”
“বাবার দোষে আমাকে ছেড়ে যাবেন না বৈদ্যরাজ। গহড়বারের যা কিছু আশা-ভরসা সবটাই আপনার ওপর।”
“আমাকে দিয়ে কিছু হবে না কুমার, হবে হরিশচন্দ্রকে দিয়ে। গহড়বার বংশে যদি জয়চন্দ্রের জায়গায় হরিশ্চন্দ্র থাকতেন তো কত ভালো হত। চন্দ্রদেবের সিংহাসনে হরিশন্দ্রেরই প্রয়োজন ছিল।”
“ অথবা যদি শ্রীহর্ষের জায়গায় বৈদ্যরাজ চক্রপাণি জয়ন্দ্রের প্রাণের বন্ধু হতেন! কিন্তু গহড়বার সুর্য অস্তমিত হওয়া পর্যন্ত আপনাকে থাকতেই হবে বৈদ্যরাজ।”
“অস্তমিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমিও অস্তে যাওয়ার জন্য প্রস্তত কুমার। কিন্তু শুধু গহড়বার সূর্য অস্ত যাবে না, হিন্দুদের সূর্যও অস্ত যাবে। আমরা মল্লগ্রামের ব্রাহ্মণেরা শুধু শাস্ত্র ও ধর্মাচরণেই অভিজ্ঞ নই, অসি চালনাতেও আমরা দক্ষ। এই জন্য আমারও ত্বকীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে চাই কুমার।”
“নিজের জামাইকে সাহায্য করতেও আমার পিতা রাজী নন। পথ্বিরাজ আমার আপন ভগ্নীপতি। তার সঙ্গে সংযুক্তার প্রণয় ছিল এবং নিজের ইচ্ছাতেই সংযুক্তা চলে গিয়েছিল। এতে বাবার অখুশী হওয়ার কারণ থাকতে পারে?”
“পৃথ্বিরাজ বীর, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।”
“ঠিক কথা। বীরত্বের জন্যই ত্বর্কী সুলতানের সঙ্গে লড়তে পারছে। না হলে আমাদের এই কান্যকুজ্বের তুলনায় কতটুকু তার রাজ্য? সুলতানের দৃষ্টি তো দিল্লীর ওপর নয়, কান্যকুব্জের ওপর। দু—শ’ বছর থেকে ভারতের সব চেয়ে বড় রাজ্য কনৌজ। কিন্তু তাঁকে বোঝাবে কে? বুঝবার মতো বুদ্ধির মাথা খেয়ে বসে আছেন বাবা।”
“এসময় যদি তিনি যুবরাজের হাতে রাজ্যের শাসনভার তুলে দিতেন!”
“আমার একবার মনে হয়েছিল বৈদ্যরাজ, যে বাবাকে সিংহাসন থেকে সরিয়ে দিই কিন্তু আপনার শিক্ষার কথা মনে পড়ে গেল। বিশ বছর ধরে আপনার দেওয়া প্রতিটি শিক্ষা আমার কাছে হিতকারী বলে প্রতিপন্ন হয়েছে। এই জন্যেই তাঁর বিরুদ্ধে যেতে পারিনি আমি।”